ক্লাসে এক ছাত্র প্রশ্ন করেছিল, স্যার বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয় কেন? বুঝলাম ওদের কাছে একটু গোলমেলে মনে হতেই পারে। কারণ ওদের বেড়ে ওঠার সময় থেকে ওরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলোর বাড়বাড়ন্ত দেখেছে। নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভ-লোভের উদ্দেশ্য সামনে রেখে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। ধর্মীয় সংঘাত ছড়াতে দেখেছে। দীর্ঘদিনের হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আড়াল করে বাংলাদেশকে ‘মুসলমানের দেশ’ বলে ইতিহাসকে খণ্ডিত করে বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখেছে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুন্দর ক্যানভাস ওদের কাছে অচেনা লাগবেই।
আমি বাঙালির উৎসব বিষয়টি পড়াতে গিয়ে ঈদুলফিতরের কথা বলি। ওরা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে আমাদের ছেলেবেলার কথা বলি। মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের পরিবারগুলোর সাধারণ চিত্র অনেকটা একই রকম ছিল। ঈদের একদিন বা দুদিন আগে অনেক কিছুর সঙ্গে কটি মোরগ কিনে আনতেন আব্বা। তা থেকে দুটি আলাদা করে রাখা হতো। ঈদের আগের রাতে ওগুলো এবং খাসির মাংস আলাদাভাবে রান্না করে মিটসেফে রাখা হতো বোনদের হিন্দু বান্ধবী আর আব্বার হিন্দু বন্ধুদের জন্য। আমাদের জন্য তো মোরগের মাংস এবং গরুর মাংস রান্না হবেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বলে যাতে দ্বিধায় না পড়তে হয় তাই অমন ব্যবস্থা। এভাবেই আনন্দ ভাগ করে নিত হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। হিন্দু, বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশে ইসলাম প্রচারে সুফি সাধকদের আগমন ঘটতে থাকে এগারো শতকের মাঝপর্ব থেকে। তেরো শতকের শুরু থেকে বহিরাগত মুসলমান সুলতানদের অধিকারে চলে আসতে থাকে গোটা বাংলা। মুসলিম শাসক ও সাধক কারও মধ্যেই সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি ছিল না। আল্লাহপ্রেম ও মানবপ্রেমকে একীভূত করে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সুফি-সাধকরা, তাতে বাঙালি মানসে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত হয়েছিল। তাই সাম্প্রদায়িকতার কালো কাপড়ে জড়ানো কট্টর লেবাসি ধর্মীয় নেতাদের শত চেষ্টায়ও এদেশের মানুষের মননে জড়িয়ে থাকা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ফিকে করে দেওয়া যায়নি।
শুধু ঈদ কেন, এ প্রসঙ্গ ধরে আমরা শারদীয় পূজার দিকে দৃষ্টি দিই। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও উৎসবের আমেজ কাটতে আরও কিছুদিন লেগে যায়। এ উৎসবের আনন্দ থেকে প্রতিবেশী মুসলমান যে একেবারে বিযুক্ত থাকে, তেমন কিন্তু নয়।
আমার মনে পড়ছে করোনাকালের আগের কথা। ঈদুলফিতরের দিন আমাদের একটি টিভি চ্যানেল সাধারণ মানুষের অনুভূতি জানতে চাওয়া নিয়ে অনুষ্ঠান করছিল। উন্মুক্ত লোকালয়ে অনুষ্ঠান। এক পর্যায়ে মাইক্রোফোনে এক ভদ্রমহিলা এলেন। শাখা-সিঁদুরে বোঝা গেল তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য। সঙ্গে স্বামী ও দুই সন্তান আছে। অফিস ছুটি তাই আনন্দ করতে বেরিয়েছেন। মুসলমান প্রতিবেশীর মতো ঈদের আনন্দ তাকেও ছুঁয়ে গেছে। জানালেন রাতে তার স্বামীর মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে ঈদের দাওয়াত খেতে যাবেন। তারা জানেন এদিন তাদের খাওয়ানের জন্য ভিন্ন আয়োজন করা হবে। আসলে এটিই আবহমান বাংলার চিত্র।
আমাদের ছেলেবেলার কথা স্মরণে আনতে পারি। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অনেক হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত চলে গেছেন। এসব বাড়িতে আমার বোনদের বান্ধবী অনেক দিদি ছিলেন। আদর-স্নেহ পেয়ে তাদের দূর সম্পর্কের মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ছোটরা যেমন কর গুনে ঈদের অপেক্ষা করতাম, একইভাবে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা আর স্বরস্বতী পূজার জন্যও দিন গুনতাম। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখা, ঢাকির জাদুকরী হাতে মনমাতানো ঢাকের বাদ্যে মাতোয়ারা হওয়া আর প্রসাদ খাওয়ার লোভ তো ছিলই। ঈদের মতো মহররমের মিছিলেও একসময় ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ ছিল। ইরাক-ইরানসহ অনেক দেশে শিয়া-সুন্নির মধ্যকার দ্বন্দ্ব হানাহানির পর্যায়ে চলে যায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আঠারো শতক থেকে ঢাকায় মহররম পালিত হচ্ছে। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে সুন্নি মুসলমানের অংশগ্রহণ এদেশে স্বাভাবিকই ছিল। আঠারো-উনিশ শতকের নথিতে দেখা যায়, একটি সাংস্কৃতিক প্রণোদনা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেও শরিক হতো মহররমের মিছিলে। বিশ্বাস ছিল, দুলদুলের প্রতীক ঘোড়ার পায়ে দুধ ঢেলে মনোবাঞ্ছা করলে তা পূরণ হয়। অনেক হিন্দুও ইচ্ছা পূরণের আশায় দুলদুলের পায়ে দুধ ঢালত।
মুসলমান পিরের সমাধিতে হিন্দুর যাওয়া, প্রার্থনা করা এদেশে একটি সাধারণ চিত্র। গ্রামগঞ্জের নানা জায়গায় এখনো ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার নদীতে কলার ভেলায় রঙিন কাগজের ঘর বানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো হয়। এই ‘ভেলা ভাসানো’ উৎসবে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সুন্দরবনের সঙ্গে জীবিকা জড়িয়ে আছে এমন মুসলমান বাওয়ালি, কাঠুরে বা জেলেরা বনের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কল্পনায় বনবিবি আর ব্যাঘ্র দেবতা গাজীর নাম জপ করে। অন্যদিকে হিন্দু বাওয়ালি, কাঠুরে ও জেলে একই অধিকর্ত্রী দেবী হিসাবে বনদুর্গা আর ব্যাঘ্র দেবতা হিসাবে দক্ষিণ রায়ের নাম জপ করে।
এসব বাস্তবতা এদেশের দীর্ঘকাল ধরে লালিত সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই প্রকাশ করছে। ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে আমি আমার লেখায় বহুবার বলার চেষ্টা করেছি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে এদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অপচ্ছায়া খুব স্বচ্ছন্দে ডানা মেলতে পারবে না। এদেশের সাধারণ মানুষের মানসিক গড়ন সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধিকে সমর্থন করে না। তারপরও এ সত্য মানতে হবে, অন্ধকারের জীব, যারা ধর্মকে আধ্যাত্মিকতার গাম্ভীর্য আর সৌন্দর্যে না দেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়, তারা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করে। অন্য দল অতটা বুঝে নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও কূপমণ্ডূকতার কারণে ধার্মিক না হয়ে এক ধরনের ধর্মান্ধ হয়ে যায়। ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন না করে অনালোকিত এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ধর্মনেতার বয়ান শুনে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। প্রথম শ্রেণির ধর্ম-বণিকদের চেনা যায়, ফলে এদের প্রতিহত করাও সম্ভব। কিন্তু অতি ধীরে হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষের পক্ষে সমাজ কলুষিত করার ক্ষমতা বেশি বলে আমি মনে করি। প্রথমে তারা নিজ পরিবারকে প্রভাবিত করে, পরে প্রতিবেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
আমার পরিচিতি একজন চল্লিশোর্ধ্ব তরুণের কথা বলব। সরকারি অফিসের মাঝারি কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করেছেন। সেই অর্থে শিক্ষিত। কিন্তু তার আলাপচারিতায় মনে হয় আলোকিত নন। নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করেন, সেই অর্থে ধার্মিক। তবে ধর্মচর্চা করেন বলে মনে হয় না। একজন শিক্ষিত মানুষ যদি ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান হন, তবে তার কর্তব্য ধর্মীয় বাণীর তাৎপর্য অনুধাবন করা, নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানা, আর এই জানাকে স্পষ্ট করার জন্য অন্য ধর্মের বাণীকে উপলব্ধি করা। অর্থাৎ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করা। অন্তত অন্য ধর্ম সম্পর্কে ঈর্ষাভাব জাগার আগেই।
এই বন্ধুটি বেশ কিছুদিন ধরে আক্ষেপ করছিলেন সরকারি দপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের বড় বড় পদে ‘কেবল হিন্দু কর্মকর্তা’ নিয়োগ পাচ্ছেন। আমি প্রথমে গা করিনি। বর্তমান সময়ের রাজনীতি আমাদের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করছে। তাই ভিন্ন রাজনীতির দল ক্ষমতায় থাকলে সেই সরকারকে নানাভাবে সমালোচনা করতে ভালো লাগে। আমি বন্ধুর বিষোদ্গারের কারণ তেমনটিই মনে করেছিলাম। কিন্তু একইভাবে বারবার আক্ষেপ করায় আমি জানতে চাইলাম, যে হিন্দু কর্মকর্তাদের পদায়ন হচ্ছে, তারা কি যোগ্যতার বিচারে হচ্ছেন না? তিনি নীরব রইলেন। আমি বললাম, এদেশের নাগরিক যদি হয়ে থাকেন আর যোগ্যতার কারণে যদি পদ পেয়ে থাকেন, তবে তাদের ধর্মপরিচয় খোঁজা তো নিরর্থক। তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, এদেশে বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান, তাই মুসলমানের অধিকারটি বেশি থাকতে হবে। আমার কাছে কথাগুলো একটু বিসদৃশ লাগল। আমার চারপাশের পরিবেশে অমন করে ভাবতে দেখি না কাউকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অমন সংকীর্ণ চিন্তা কাজ করে বলে আমার মনে হয় না। অথচ নাগরিক পরিবেশে বাস করা, সার্টিফিকেটে শিক্ষিত এক সরকারি চাকুরে অমন করে ভাবছেন কেন! পরে মনে হলো, এ মানসিকতার মানুষগুলো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হয়তো তেমন আলোকিত নন। তাই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশে একুশ শতকের ডিজিটাল যুগেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা প্রকাশ করছেন কণ্ঠ উঁচিয়ে। যে সংকীর্ণতার স্থান তার নিজ ধর্মেই নেই।
মানুষকে সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের চেষ্টা করতে হয় জানার জগৎ শানিত করে। আমি কাছে থেকে লক্ষ করেছি, পশ্চিম বঙ্গের মানুষের ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্যের খোঁজ আমরা যতটা রাখি, ওপারের মানুষ আমাদের সম্পর্কে তেমনটা রাখতে পারেন না। এর অনেক কারণ আছে। কলকাতায় কোনো বই বা জার্নাল প্রকাশিত হলে কলেজ স্ট্রিটের দোকানে আসার আগেই বাংলাদেশের বুক স্টলে চলে আসে। কালেভদ্রে বাংলাদেশের বইয়ের দেখা মেলে কলকাতার বইয়ের দোকানে। কলকাতার সব টিভি চ্যানেল আমাদের ড্রইং রুমে। আমাদের কোনো চ্যানেল দেখার সুযোগ নেই পশ্চিমবঙ্গে। আমার এক সাংস্কৃতিককর্মী ছাত্র যথার্থই মন্তব্য করল সেদিন, এই যে রোজা আর ঈদ যায়, এ নিয়ে কলকাতার অধিকাংশ টিভি চ্যানেল তেমন কোনো অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন মনে করে না। অথচ আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দুর্গাপূজার বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত খবরে ও অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতা মাতিয়ে রাখে। অর্থাৎ এদেশের মানুষ দুই সম্প্রদায়ের অধিকার অভিন্ন ভাবতে অভ্যস্ত বলেই আমাদের মধ্যে এ স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কলকাতার চ্যানেলে মুসলমানের উৎসবের খবর-প্রতিবেদন জায়গা করে নিতে যে পারছে না, সে তথ্য আমরা পেলেও আমাদের চ্যানেল ওপারের মানুষ দেখতে না পাওয়ায় পুজো নিয়ে এ দেশে যে এত আয়োজন হয় তার খোঁজ আবার তারা পাচ্ছেন না। পেলে হয়তো কলকাতার চ্যানেলেও এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ত।
আমার বরাবরই মনে হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ ধরে রাখতে পারলে এদেশের ধর্ম-বণিক রাজনীতিকদের অপতৎপরতা আর জঙ্গিবাদ কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য অনালোকিত জনগোষ্ঠীকে আলোতে আনতে হবে আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com