Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিশ্বে শান্তি আসবে কীভাবে

Icon

মোনায়েম সরকার

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বে শান্তি আসবে কীভাবে

ফাইল ছবি

সারা বিশ্বে এখন যে অশান্তির বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, এর জন্য মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নীতি-আদর্শ নেই। তাদের নীতি একটাই-কীভাবে টাকা ও সম্পদ লুণ্ঠন করা যায়। এ টাকা-সম্পদ লুণ্ঠন করতে গিয়ে তারা দেশে দেশে যুদ্ধ বাধাচ্ছে, অন্যায়ভাবে লাখ লাখ নিরীহ লোক হত্যা করছে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে গিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি এখন এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, আমেরিকার কূটকৌশলের কারণে যে কোনো সময় পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। সারা পৃথিবীর মানুষ এখন আমেরিকার ক্ষমতার কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমেরিকাকে শক্তিহীন করতে হবে। ধনে-সম্পদে-অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আমেরিকাকে শক্তিহীন করতে না পারলে কখনোই পৃথিবীতে শান্তি আসবে না।

‘শক্তি’ চলমান স্রোতের মতো। এক জায়গায় শক্তি কখনো স্থির থাকে না। পৃথিবীতে অতীতে অনেক দেশই শক্তিমান হয়েছিল, আবার তাদের পতনও প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীর মানুষ। একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এতটাই বিশাল ছিল, সেসময় বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হয় না। কথাটি ঐতিহাসিকভাবে সেসময় ঠিক থাকলেও আজকের প্রেক্ষাপটে রূপকথার গল্পের মতোই শোনায়। যে ব্রিটিশ সরকার একসময় এত প্রতাপশালী ছিল, আজ তাদের শান্ত-ভদ্র মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর দেশে দেশে এ সাদা চামড়ার সুন্দর মুখের মানুষগুলো কী পরিমাণ অত্যাচার আর নির্যাতন করেছে।

আমেরিকা এমন একটি দেশ, যার নিজের দেশেই ঠিকমতো গণতন্ত্র নেই। অথচ সারা বিশ্বে সে গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়ায়। তার দেশেও নির্বাচনে কারচুপি হয়, নির্বাচনে জনগণের রায়কে অস্বীকার করে সেখানে জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পার্লামেন্ট ভবনে আক্রমণ করা হয়, ভাঙচুর ও শান্তিপ্রিয় লোকজন হতাহত করা হয়। যাদের দেশে নিজেরাই জনগণের ভোটের রায় মেনে নেয় না, তারা যখন অন্যদেশের সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তির্যক মন্তব্য করে, তখন সেটা খুবই হাস্যকর শোনায়। কিন্তু তারা যেহেতু নিজেদের পৃথিবীর ‘মোড়ল’ বলে দাবি করে এবং যে কারণেই হোক পৃথিবী তা মেনে নিয়েছে, তাই যে কোনো দেশের যে কোনো বিষয়ে কথা বলা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।

অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলা বন্ধ করা উচিত আমেরিকার। পৃথিবী এখন আর আগের জায়গায় নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে প্রতিদিনই পৃথিবী পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরিবর্তন অনেক দেশকেই এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি। এর ফলে আমেরিকার মতোই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বিশ্বের আরও অনেক দেশ। তারা কিছুতেই নীতিহীন আমেরিকার কথায় ওঠবস করতে চাইছে না। সে কারণেই আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতা ও সম্পদলোভী আমেরিকা। তবে পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা যদি কঠিনভাবে একবার আমেরিকাকে গলা চেপে ধরে, তাহলে তার বাঁচা কঠিন হয়ে পড়বে।

আমেরিকা মানবতার কথা বললেও তারা মোটেই মানবিক নয়। তাদের দেশে স্কুলে বন্দুকধারী দুর্বৃত্তরা ঢুকে যেভাবে নির্বিচারে শিশু-কিশোরদের হত্যা করে, তা অন্য কোথাও সচরাচর দেখা যায় না। একটি সভ্য দেশে এ রকম নির্বিচার হত্যাকাণ্ড কেউ মেনে নিতে পারে না। অথচ এ বর্বরতাই সেখানে স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে দেখা দিচ্ছে। বর্ণবাদী আচরণে বিশ্বের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে আমেরিকা। সাদা-কালো মানুষের ভেদাভেদ সেখানে নগ্নরূপ ধারণ করেছে। দিনে-দুপুরে সেখানে কালো মানুষদের হত্যা করছে সাদা মানুষরা। রাষ্ট্রীয় মদদে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হত্যা করছে কালোদের। বর্ণবাদী আচরণ প্রদর্শন করে যারা মানবতার মুখে চুলকালি লেপন করে, তাদের মুখে মানবিকতার উপদেশ শুনলে কার না হাসি পায়। আমেরিকা বুঝতে পারছে না, তাদের পাগলামি দেখে বিশ্ববাসী হাসছে। এ হাসি যখন বিরক্তিতে রূপ নেবে, তখনই সারা বিশ্বে শুরু হবে আমেরিকাবিরোধী লড়াই। যার পূর্বাভাস এখন কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে।

আমেরিকা একটি ইতিহাস-ঐতিহ্যহীন জাতি। এ জাতির প্রকৃতপক্ষেই কোনো ইতিহাস নেই, যাদের ইতিহাস এখনো তিনশ বছর অতিক্রম করেনি, অথচ তারা তিন হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সভ্যতাকেও বোমার আঘাতে অবলীলায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। আরব বসন্তের নামে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আমেরিকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। মিসর, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ অসংখ্য দেশ মার্কিন আগ্রাসনের কারণে মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। এসব সমৃদ্ধ দেশের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমান রূপের এতটাই পার্থক্য চোখে পড়ে, নতুন প্রজন্মের মানুষকে বোঝানোই যাবে না, মার্কিন আগ্রাসনের পূর্বে এসব দেশ সম্পদে ও সম্মানে কত মর্যাদাবান ছিল। সুন্দরকে অসুন্দর বানানো, শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই আমেরিকা এগিয়ে যাচ্ছে, এটি এখন পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পেরেছে বলেই আমেরিকার বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

দেশে দেশে শান্তিপ্রিয় মানুষ আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সত্যি সত্যিই যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবী বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায় সেদিন আমেরিকার অহংকার চূর্ণ হতে বাধ্য। আমেরিকার অহংকারী বুকে পদাঘাত করার সময় এসেছে। বানরের হাত থেকে অগ্নিমশাল কেড়ে না নিলে অরণ্য যেভাবে দাবানলে পুড়ে, আমেরিকার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে না নিলে সেভাবেই আগুনে পুড়ে ছারখার হবে সমগ্র বিশ্ব।

এদেশের কর্তাব্যক্তিরা অবলীলায় মিথ্যা কথার কাব্য রচনা করে বিশ্ববাসীর মগজ ধোলাই করতে সর্বদা ব্যস্ত। ৯/১১-এর সময়ে তারা যে কী পরিমাণ মিথ্যাচার করেছে পৃথিবীর মানুষ তা ভুলে যায়নি। ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে কল্পিত কাহিনি তৈরি করে, মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্রের জিকির তুলে যেভাবে সেই দেশটিকে ধ্বংস করা হলো-সেই ইতিহাস কোনোদিনই পৃথিবীর মানুষ ভুলবে না। আজ যদিও প্রমাণ হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনের হাতে কোনো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ছিল না, কিন্তু এ কথায় আর কোনো লাভ নেই। ইরাকের সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে গাদ্দাফির দেশ লিবিয়ায়ও।

আমেরিকার কূটকৌশলের মূলকেন্দ্র পেন্টাগন, সিআইএ আর ন্যাটোর মতো জবরদস্তিমূলক আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। পেন্টাগন আর সিআইএ যে ব্যবস্থাপত্র রচনা করে, ন্যাটো মূলত সেটাই বাস্তবায়ন করে। এতদিন ন্যাটোকে আমেরিকার রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করেছে আমেরিকা। ইদানীং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্ররাই ন্যাটো জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। অস্ত্র ব্যবসায়ী আমেরিকা বিশাল অস্ত্রের মজুত করেছে সারা বিশ্বে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। যুদ্ধবাজ আমেরিকার মনোভাব বুঝতে পেরে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে শান্তিকামী রাষ্ট্রনায়করা। যতই দিন যাচ্ছে, ততই আমেরিকাবিরোধী জোট শক্তিশালী হয়ে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে-এ চেষ্টা সফল হলে অচিরেই আমেরিকা মুখ থুবড়ে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ এশিয়ার দেশে দেশে আমেরিকাবিরোধী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে। ইউরোপের মানুষও বুঝতে পারছে, আমেরিকা তাদেরও যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব নড়েচড়ে উঠলে আমেরিকা পালানোর পথ খুঁজে পাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিংশ শতাব্দীর দেশে দেশে আমেরিকা একসময় অনুগত স্বৈরাচারী সামরিক সরকার বসিয়েছিল। হিসাব করা যায়, সে সময় ৭০ থেকে ৭৭টি দেশে আমেরিকার আশীর্বাদপুষ্ট সামরিক সরকার ছিল। এসব সামরিক সরকার ছিল মূলত আমেরিকার এজেন্ট। গণতান্ত্রিক চেতনা শক্তিশালী হওয়ার ফলে অনেক দেশই এখন আর সামরিক সরকার পছন্দ করছে না। এ কারণে সেসব দেশের অভ্যন্তরে গোলযোগ সৃষ্টির জন্য নতুন করে ফর্মুলা দিচ্ছে আমেরিকা। এসব ফর্মুলার মধ্যে রয়েছে মৌলবাদ, অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যা, গুম প্রভৃতি। দূর থেকে কলকাঠি নাড়িয়ে কোনো দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র আমেরিকার মতো আর কোনো দেশ করতে পারে না। আমেরিকার রিমোট কন্ট্রেল রাজনীতি বন্ধ করতে হলে আগে তাকে শক্তিহীন ও অর্থহীন করতে হবে। বিশ্ববাসী ঐক্যবদ্ধ না হলে এককভাবে কোনো রাষ্ট্র আমেরিকাকে তেমন কাবু করতে পারবে না। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান কিংবা এ রকম আরও শক্তিশালী রাষ্ট্র যদি সমঝোতার ভিত্তিতে আমেরিকার আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাহলেই কেবল তাকে হটানো সম্ভব।

আমেরিকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নেই বলেই এরা অন্য কারও ইতিহাস-ঐতিহ্য মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু একবিংশ শতকে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ শেকড় সন্ধানী হচ্ছে। তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে মনোযোগী হচ্ছে। মানুষ যত বেশি ঐতিহ্য-সন্ধানী হবে, ততই ঘৃণা জাগবে আমেরিকার প্রতি। সম্পদশালী আমেরিকা বিশ্বের মেধাবীদের অর্থের বিনিময়ে কিনে যদি ভেবে থাকে চিরদিনই তারা এভাবে শান্তিতে থাকবে, তবে সেটা ভুল হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই এখন অর্থ পাচার রোধের মতো মেধা পাচার রোধে মনোযোগী হচ্ছে। এটা যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, আমেরিকার পতন তাহলে ত্বরান্বিত করা যাবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

পৃথিবীর মানুষ এখন মূলত একটি মানবিক বিশ্বব্যবস্থা কামনা করছে। এ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় বাধা আমেরিকা। আমেরিকা অন্যের দেশে যুদ্ধ লাগালেও নিজেদের ভূমি নিরাপদ রাখতে বদ্ধপরিকর। দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে, মানুষ হত্যা ও সম্পদ লুণ্ঠন করে এর দাপট এত বেড়ে গেছে, কথায় কথায় যে কোনো রাষ্ট্রকে শাসাতে এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করতে দ্বিধা করছে না। আমেরিকার এ স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিবর্তন করতে হলে তাকেও বয়কটের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিশ্ববাসীকে। আমেরিকাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত করতে না পারলে, শান্তি শুধু দূর থেকেই মানুষকে হাতছানি দেবে-কাছে আসবে না। মানুষের পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য করতে হলে অমানুষের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে। দানবীয় শক্তির পতন হয়ে মানবিক শক্তির উদ্বোধন ঘটলেই পৃথিবী সুন্দর ও শান্তিময় হবে।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম