
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৬ এএম
পাটকল ইজারা দিয়ে কী সুফল মিলবে?

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
সরকারের সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্ত পুরোনো একটি প্রসঙ্গ নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছে। প্রসঙ্গটি পাটকল নিয়ে। পাট বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি অতিপরিচিত পণ্য। পাকিস্তান আমলে তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকেও পাট ছিল আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য। আশির দশক থেকে পোশাক রপ্তানি পাটের জায়গা দখল করে। বর্তমানে মোট রপ্তানির প্রায় ৭৭ শতাংশ পোশাক খাতের অবদান আর পাটের অংশ সেখানে ২ শতাংশের বেশি নয়। পাট উৎপাদনে চাষিদের আগ্রহ দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে।
তাছাড়া কৃষকের ব্যবহারের পাটবীজের গুণগত মান এবং সময়মতো পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় কাজ করে। কারণ আমাদের পাটবীজের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজার ৫০০ টন বীজ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। অবশ্য এ আমদানিনির্ভরতা কমানোর চেষ্টা চলছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৫-২৬ সাল নাগাদ দেশেই প্রায় ৫ হাজার টন উন্নত মানের পাটবীজ উৎপাদন করা হবে।
কিছু সমস্যা থাকার পরও সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যমতে, ২০২১ অর্থবছরে পাট রপ্তানির প্রবৃদ্ধি গত ১২ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। উল্লিখিত বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ থেকে ২৮২টি পাটজাত পণ্য ১৩৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়। ২০২১ সালে পাটের রপ্তানি আয়ের রেকর্ড ভাঙার বিপরীতে দেশের পাটের উৎপাদন বছর বছর কমতির দিকে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মোট পাটের পরিমাণ ছিল ৮৬ লাখ টন। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮০ লাখ টনে। ২০২০-২১ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮২ লাখ টন নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃত উৎপাদন ছিল মাত্র ৭৪ লাখ টন।
পাটশিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গেল অর্থবছরে পাট রপ্তানি থেকে রেকর্ড পরিমাণ আয়ের কারণ রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সুবাদে অর্থের অঙ্ক বড় হয়েছে। আর দাম বৃদ্ধির কারণ হলো পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি। করোনাপূর্ব ১০০ টাকার জাহাজ ভাড়া এখন ৬০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। এখানে উৎপাদনকারীর কোনো অতিরিক্ত আর্থিক অর্জন নেই। তারপরও আমাদের দেশের পাটশিল্প নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা আগ্রহ থেকেই যায়। কারণ প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এর উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ বাজার, ব্যবসা ও মেনুফ্যাকচারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাছাড়া সার্বিক অর্থে পাট একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে পাকিস্তানের এ অংশের বেশিরভাগ (লুম শক্তির বিচারে প্রায় ৭০ শতাংশ) জুট মিলের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি। যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জুট মিলগুলো পরিত্যক্ত অবস্থার মধ্যে পড়ে। সে সময় নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার মিলগুলোকে আবার চালু রাখার উদ্দেশ্যে জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয়করণ করে। এ মিলগুলো পরিচালনা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। করপোরেশনের অধীনে ছিল ৭৩টি মিল, যেখানে তাত বা লুমের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৮৩৬। শুরুতেই সংস্থাটি আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। প্রধান রপ্তানি পণ্যটির উৎপাদন বজায় রাখতে প্রথম দুই বছর সরকারের পক্ষ থেকে বার্ষিক ২০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হতো। ১৯৭৬-৭৭ সালে ভর্তুকি কমিয়ে ১০ কোটি টাকায় নামানো হয়। ১৯৭৯-৮০ সালে ভর্তুকি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হলেও এ শিল্পটি লাভজনক ছিল।
১৯৭৯ সালের শেষদিক পর্যন্ত বিজেএমসির তত্ত্বাবধানে বা নিয়ন্ত্রণে ছিল ৭৭টি জুট মিল এবং ২টি কার্পেট বেকিং মিল। ১৯৮০ সালে প্রথমবারের মতো ৬টি টুয়াইন মিল ব্যক্তিগত খাতে বিলগ্নি করা হয়। ১৯৮১ সালে সংস্থাটির অধীনে ৭৪টি মিল ছিল, যেগুলোতে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার; আর ব্যবস্থাপনা ও অফিসকর্মী ছিল প্রায় ২৭ হাজার।
জুট মিলগুলোর বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় ১৯৮২ সালে। বিজেএমসিকে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সরকারি নির্দেশ আসে। তখন ১০টি মিল বাংলাদেশি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৯৮২-৮৩ সাল নাগাদ বিজেএমসির ৪৬টি মিলের আর্থিক সঙ্গতি ভালো ছিল। সে সময় সংস্থাটির করপূর্ব মুনাফা ছিল ২৪ কোটি টাকা। বাকি মিলগুলোর লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৩ কোটি টাকা। অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বছর বছর লোকসানের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। মিলগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণের জন্য দাতা সংস্থাগুলো ও বিশ্বব্যাংক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ১৯৯৯ সালে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে থাকে মাত্র ৩৩টি জুট মিল। সেগুলোও লোকসানের কারণে বন্ধ করা শুরু হয়। সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০০২ সালে। সর্বশেষ, বিজেএমসির আওতাধীন ২৫টি জুট মিল ২০২০ সালের ৩০ জুন গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে প্রায় ৯০ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিককে বিদায় করা হয়। এই হলো রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলগুলোর করুণ পরিণতির কাহিনী। এর বিপরীতে বেসরকারি খাতে লাভজনক জুট মিলগুলো চালু আছে। বাংলাদেশ জুট স্পিনারস অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের অধিভুক্ত প্রায় ২৪০টি ইউনিট পাটজাত পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা সরকারি উপর মহল থেকে আমাদের সক্ষমতার কথা বারবার শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু অক্ষমতা বা ব্যর্থতার কোনো ছিটেফোঁটাও শুনতে পাই না। সরকারি জুট মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়াটা ছিল চরম ব্যর্থতার একটি উদাহরণ। আমরা মিলগুলো পরিচালনায় সক্ষমতা দেখাতে পারিনি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত আবারও প্রমাণ করল যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর প্রতি আমরা সুবিচার করিনি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিজেএমসির বন্ধ করে দেওয়া পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে ইজারা দেবে। প্রাথমিকভাবে ১৭টি মিল ইজারা দেওয়ার কথা। এরই মধ্যে দুটি মিল ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের হাতে ইজারা দেওয়া হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি জুট মিলস লিমিটেড ২০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে ইউনিটেক্স গ্রুপ। অপরটি হলো নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিলস। এটি ইজারা নিয়েছে বে গ্রুপ। এর বাইরে আরও দুটি মিল প্রক্রিয়াধীন আছে।
বাকি ১৩টি মিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিজেএমই। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশি-বিদেশি ১৮টি প্রতিষ্ঠান তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশের বাইরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ভারতের প্যাসিফিক জুট লিমিটেড ও মোহন জুট লিমিটেড। তাছাড়া আগ্রহীদের তালিকায় আছে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক ট্রেডিং এলএলসি। ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের প্লাটিনাম জুবীলি জুট মিলস, ইস্টার্ন জুট মিলস, খালিশপুর জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, স্টার জুট মিলস, যশোর জুট মিলস ও কার্পেটিং জুট মিলস ইজারা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আক্ষেপের কারণটা এখানেই। বিদেশিরা কোন্ বিচারে ইজারা নিতে চাইছে যা আমরা পারিনি?
মোটা দাগে তিনটি সুবিধার কথা বলতে পারি, যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা উৎপাদনে যেতে উৎসাহী হয়েছে। প্রথমত, পাটকলগুলোর কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা রয়েছে। আমাদের কৃষকরা পাটচাষে উৎসাহ হারাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হলো পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। কিন্তু পাট উৎপাদনের যেহেতু অভিজ্ঞতা আছে, তাই দামের নিশ্চয়তা পেলে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা পাটের জোগান দিতে পারবে আমাদের কৃষকরা। দ্বিতীয়ত, পাট ও পাটজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদার বাইরে দেশের অভ্যন্তরেও একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা রয়েছে। সে চাহিদাকে তারা কাজে লাগাবে। তৃতীয়ত, আমাদের দেশে শ্রমিকের মজুরি তুলনামূলকভাবে কম। এ কম মজুরির বিপরীতে বেশি মুনাফা করা সম্ভব।
কিন্তু এ সুবিধাগুলো তো আমাদের বেলাতেও প্রযোজ্য। তারপরও কেন বছর বছর আমাদের লোকসানের ঘানি টানতে হলো? এর কারণ অব্যস্থাপনা, অনিয়ম আর দুর্নীতি। আমরা যদি এ তিনটি ত্রুটি দূর করতে না পারি, তাহলে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়াটিও স্বচ্ছ হবে না। আমরা জানি, ২৫টি জুট মিলের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৩০০ একর। ১৯৫৫ সালে কেনা জমির দাম ও লোকেশন ২০২২ সালের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তো থেকেই গেল। আমাদের বন্ধ করা প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনকার্য পরিচালনার জন্য দেশি-বিদেশিরা এখনো আগ্রহ প্রকাশ করছে। অথচ আমরা সরকারিভাবে তা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলাম।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়