ইতিহাসের সত্য উন্মোচনের অভিযাত্রা
আকতারী মমতাজ
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও উন্নয়নের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক ২০২১ সাল। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের তিনটি পূর্বশর্ত মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পূরণ করেছে। মধ্যম আয়ের দেশের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের নিপীড়িত-নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মানবিক আবেগে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ পেয়েছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি, এসবই বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্জন।
বিশ্বমারি করোনার প্রকোপে প্রিয়জন হারানোর শোক ও বেদনার সঙ্গে করোনা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা দেখিয়েছে দেশ। সারা দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে অন্তর্জালের আওতায় মানুষের অনলাইনে নানাবিধ সেবাপ্রাপ্তির সুবিধা।
পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ ১০টি মেগা প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন। এসব অর্জন ও সাফল্য বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি করেছে উজ্জ্বল। এ ২০২১ সালেই বাংলাদেশ উদযাপন করছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর ২০২১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ মুজিববর্ষ উদযাপনের পাশাপাশি উদযাপন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও। আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিজয়েরও সুবর্ণজয়ন্তী।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক, একাত্তরের সাত মার্চে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক অমর ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এসবের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন বাঙালির প্রাণের নেতা, আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। তারই আহ্বানে একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি জাতিকে শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন কাটিয়েছেন মা-বাবা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যার সান্নিধ্য থেকে দূরে, কারাগারে। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন; কিন্তু কখনো আত্মগোপন করেননি। একাত্তরের ২৫ মার্চে অকুতোভয় এই মহান নেতা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আক্রমণের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে দলের নেতৃবৃন্দকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত, নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিদের আক্রমণ করে। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। সত্তরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে সরকার গঠনের জন্য যার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা, সেদিন মধ্যরাতে পাকিস্তানের জান্তা সরকার তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে প্রহসনমূলক এক বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়। বিশ্বের সমকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এবং সচেতন মানুষের কাছে তখন তার ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি ছিল স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। বিশ্ব জনমত ও আন্তর্জাতিক চাপে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশে ফিরেই তিনি মনোযোগ দেন দেশ গঠন ও অবকাঠামো উন্নয়নে। অসংখ্য প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অবিলম্বে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের মূল কাজগুলোর সূচনা করেন তিনি। জনমুখী প্রশাসনিক বিন্যাস, ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব কারও প্রতি বৈরিতা নয়’ এ পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, রাষ্ট্রপরিচালনার অত্যাবশ্যক আইনগুলো প্রণয়ন, তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয় লাভ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করে ১৯৭২ সাল প্রণীত হয় একটি অনন্য সংবিধান। ডিসেম্বর মাসেই অনুমোদিত হয়ে গৃহীত হয় রাষ্ট্রপরিচালনার সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধান। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। বিশ্বব্যাপী তার সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে তার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছিল। এ সময়ে তাকে স্বদেশে মুখোমুখি হতে হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনসহ ক্ষতিগ্রস্ত ভৌত অবকাঠামোর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা সচলকরণ, নির্যাতিত মা-বোনদের পুনর্বাসন, পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের দেশে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধোত্তর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, কলকারখানা ও প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণসহ ইত্যাদি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে সংবিধানের চার মূলনীতি অনুসরণে ভবিষ্যতের সোনার বাংলার পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তিকাজগুলোকে বেগবান করতে তিনি তখন ঐকান্তিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তখন থেমে ছিল না বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, বাঙালি পরিচয়ধারী পাকিস্তানি শাসকদের অনুগত পরগাছাকুল। স্বাধীনতার পর থেকেই ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে অন্তর্ঘাতমূলক নানা অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তারা।
দেশ পুনর্গঠনের বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয় স্বদেশি বিভীষণদের নানামুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের। দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে অন্তরালে যুক্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বিরুদ্ধ মতাদর্শের ক্রীড়নকরা। সাংবাদিক এমা রথস চাইল্ডের ‘দুর্ভিক্ষের রাজনীতি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক ছিল না, ছিল মানবসৃষ্ট। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পশ্চাৎ প্রেক্ষাপটের ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর সব উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য চলেছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের গভীর ষড়যন্ত্র। স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবার পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করে।
পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্ত করা হয় তরুণ প্রজন্ম ও দেশের মানুষকে। আজ ভেবে বিস্মিত হতে হয়, জীবনবাজি রেখে যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাত্র সাড়ে তিন বছর পর, পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে তাদের দেশের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মগোপনে যেতে হয়। দেশের পরিস্থিতি এমন ছিল যে, বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম কেউ তখন প্রকাশ্যে নেওয়ার সাহস করত না! বাঙালিকে দেশপ্রেমে ও মুক্তির চেতনায় উজ্জীবিত করা, রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তরে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও সাহস জাগানিয়া সর্বজনপ্রিয় স্লোগান জয়বাংলা নিষিদ্ধ হয় বাংলাদেশে! বাংলাদেশের স্থপতি ও তার পরিবার পরিজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পরিবর্তে তৎকালীন সরকার খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। তারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে রচিত পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয় শিশু-কিশোরদের হাতে। সেসব পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মকে স্বাধীনতার খণ্ডিত ও বিকৃত ইতিহাসের পাঠ দেওয়া হয়। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ও মুক্তির সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বকে নানাভাবে খাটো করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে নবীন প্রজন্ম যখন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা প্রথম জেনেছে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলেছে তারা। দীর্ঘদিন ধরে অপপ্রচারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আজ বিভ্রান্ত। তাদের ঠিকভাবে জানা নেই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রকৃত ইতিহাস, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের কথা, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর কথা, মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম ও আত্মদানের কথা, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, দেশজুড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসরদের গণহত্যার কথা এবং দেশব্যাপী নানা স্থানে গণহত্যায় নিহত শহিদদের গণকবরের কথা। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে উলটোরথে যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বদেশের!
সরকার ২০১৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় তার জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত মুজিববর্ষ উদযাপনের ঘোষণা দেয়। দেশের বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট জ্ঞানী-গুণীজন এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্বসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ১১৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ এবং জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে সভাপতি করে ৭৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। বাস্তবায়ন কমিটি দুটির সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া ৮৫টি প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে জাতীয়ভাবে মুজিববর্ষ উদযাপনের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
দেশব্যাপী একই সময়ে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা, লোগো উন্মোচনসহ জাতির পিতার আদর্শ ও দর্শন এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস ২৯৮টি কর্মসূচির মাধ্যমে নবীন প্রজন্মসহ দেশের জনগণের কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। করোনার ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২০ সালে প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ‘মুক্তির মহানায়ক’ স্থগিত করা হয়। পরিবর্তে ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের দিন রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব সম্প্রচার মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এ অনুষ্ঠানেই বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি কামাল চৌধুরীর কথায় ও নকিব খানের সুরে মুজিববর্ষের থিম সং উন্মুক্ত করা হয়।।
বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদযাপনের নানা আয়োজনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন’ শিরোনামে পঞ্জিকাবর্ষের নির্দিষ্ট দিনে বঙ্গবন্ধুর জীবনে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে সচিত্র বিবরণ মুজিববর্ষব্যাপী দেশের সরকারি-বেসরকারি সব সম্প্রচার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রচার করা। এ কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বর্ণময় রাজনৈতিক জীবন ধারাবাহিকভাবে দেশের মানুষ জানার সুযোগ পেয়েছে। অনলাইনে আয়োজিত ‘ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস’ এবং ১০০ দিনব্যাপী ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ কুইজ প্রতিযোগিতা থেকে শিশু-কিশোররা বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পেরেছে। নবীন প্রজন্মকে জানাবার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং তৃণমূলের তরুণ সমাজ ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে জেলা-উপজেলায় বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
২০২১ সালের মার্চে করোনার সংক্রমণ কমে এলে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনসহ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে মুজিববর্ষ জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘মুজিব চিরন্তন’ শিরোনামে ১৭ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করে।
মুজিববর্ষ উদযাপন ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের সূচনা অনুষ্ঠানমালায় নির্ধারিত দশটি প্রতিপাদ্য ছিল যথাক্রমে, ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়’, ‘মহাকালের তর্জনী’, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা’,‘তারুণ্যের আলোক শিখা’, ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান’, ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’, ‘নারী মুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতা’, ‘শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত’, ‘গণহত্যার কালরাত ও আলোকের অভিযাত্রা’ এবং সমাপনী দিন ২৬ মার্চের থিম ছিল ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য, তাই এই দশটি প্রতিপাদ্যভিত্তিক নির্মিত অডিওভিজুয়ালে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের অনিবার্য প্রকাশ ঘটেছে। এ দশ দিনের অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন যথাক্রমে বন্ধুরাষ্ট্র মালদ্বীপের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, বন্ধুরাষ্ট্র শ্রীলংকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, বন্ধুরাষ্ট্র নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভান্ডারী, বন্ধুরাষ্ট্র ভুটানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডাক্তার লোটে শেরিং এবং বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ উপলক্ষ্যে ভিডিও বার্তা ও লিখিত বার্তা পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মুজিবশতবর্ষের অনুষ্ঠানে বিদেশি নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি এবং প্রেরিত শুভেচ্ছাবাণী বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত করেছে।
‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ প্রতিপাদ্যে ২০২১ সালের বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দুদিনের এ উৎসব অনুষ্ঠানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন ছিল দেশের মানুষকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি আগামীর বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে তাদের আবদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালনায় অনলাইনে দেশব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের শপথ অনুষ্ঠান। ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং সম্মানীয় অতিথি হিসাবে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ-এর উপস্থিতি বিজয় দিবসের এই অনুষ্ঠানকে করেছে আরও তাৎপর্যমণ্ডিত।
মুজিববর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচি ছিল বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিজীবন, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনভিত্তিক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ও সংকলন প্রকাশ। সেইসঙ্গে বিদেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ।
পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলার, বদলে দেওয়ার সব রকমের চেষ্টা করেছিল ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকার ও পরবর্তীকালে সামরিক সরকারের রূপান্তরিত সরকার। কিন্তু ইতিহাস অদম্য, কালের যাত্রায় ইতিহাসের সত্য প্রকাশ অনিবার্য ও অবধারিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। বাঙালির রয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সংগ্রাম, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের গৌরবময় ইতিহাস। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম, আবার পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রাম করেছে বাঙালি। পাকিস্তান সরকারের শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তির সংগ্রাম ও মহাবিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তিনি তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আন্দোলনের ইতিহাস দেশের বর্তমান প্রজন্ম ও দেশের সাধারণ মানুষকে অবহিত করা সরকারসহ দেশপ্রেমিক সব নাগরিকের একান্ত কর্তব্য।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস অভিন্ন। তার মহান নেতৃত্বে বাঙালি সংগঠিত হয়েছে জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকারের চেতনায়, তারই আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সব শহিদের আত্মদান, একাত্তরে নির্যাতিত, অসম্মানিত মা-বোনদের অপার মনোবেদনার বিনিময়ে। জাতির পিতাসহ তাদের সবার কাছে আমাদের রয়েছে অশেষ ঋণ। জাতীয় স্বার্থে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা একান্ত জরুরি। নয়তো নবীন প্রজন্মসহ দেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রচারণায় নিরন্তর বিভ্রান্ত হতে থাকবে। জাতির পিতার আত্মত্যাগের ঋণ ও শহিদদের রক্তের ঋণ আমাদের পরিশোধ করতে হবে ইতিহাসের সত্যকে বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে বর্তমানের আলোয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ প্রেক্ষাপটে মুজিববর্ষ উদযাপন ছিল জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি বাঙালির স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস উন্মোচন ও প্রতিষ্ঠার পথে অতিজরুরি, গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য এক অভিযাত্রা।
আকতারী মমতাজ : সাবেক সচিব