বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ফিরিয়ে দিন
এ কেএম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সরাসরি স্খলন শুরু হয় ১৯৯০-এর সময় থেকে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর থেকে স্খলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্ষমতার রাজনীতি এসময় থেকে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য টার্গেট করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। দীর্ঘ ইতিহাসজুড়ে যে তারুণ্য শক্তি সত্য-ন্যায় ও দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত ছিল, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে লাভ-লোভের আবর্তে ফেলে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের আজ্ঞাবহতে পরিণত করতে থাকে।
অর্থ আর অস্ত্রশক্তি হাতে তুলে দিয়ে উন্মত্ত মাস্তানে পরিণত করতে লাগল ছাত্রদের। এতে অনেক মেধাবী তরুণ তলিয়ে যেতে লাগল অন্ধকারে। আর সচেতন মেধাবী শিক্ষার্থীরা কলুষিত হয়ে পরা রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেন। ফলে ছাত্ররাজনীতির নামাবরণে মাস্তানতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল ক্যাম্পাসে।
এসবে শতভাগ হতাশ হইনি আমরা। ইতিহাসের এ শিক্ষাটি আমাদের মনে আশা জাগিয়েছিল যে, জাতির বড় সংকটে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হবেই। এর প্রমাণ পেয়েছিলাম ১৯৯০-এ। ছাত্ররা গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, প্রত্যাশা ছিল যে, এই আন্দোলনের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দেশপ্রেমের শক্তি নিয়ে কালিমাময় পোশাক গা থেকে খুলে ক্যাম্পাসকে আবার আপন ঔজ্জ্বল্যে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবেন আমাদের রাজনীতি অঞ্চলের বিধায়করা। বাস্তবে তা হলো না। ক্ষমতার রাজনীতি দ্বিধা-ত্রিধা বিভক্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক দলই টিকে থাকার জন্য শিক্ষাঙ্গন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামাবরণে রাজনৈতিক শক্তিচর্চার চারণভূমিতে পরিণত করতে থাকল।
ছাত্ররাজনীতির নামে একদল ছাত্রকে মাস্তান বানিয়ে ফেলল। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ আর সন্ত্রাসীর তিলক এঁকে দিল কপালে। পাশাপাশি গ্রাস করল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের একাংশকে। প্রত্যেক অংশের সামনেই ক্ষমতাসীনরা লাভ-লোভের মূলো ঝুলাতে লাগলেন। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তী গণআন্দোলনে আদর্শিক দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের গাইড-ফিলোসোফার। সংকটে রাজনৈতিক নেতারা পরামর্শের জন্য ছুটে আসতেন ক্যাম্পাসে। ১৯৯০-এর পর অবস্থা এমন দাঁড়াল, নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের অনেকে নানা রাজনৈতিক দলের রং গায়ে চড়ালেন। এবার এ ধারার শিক্ষক নেতারা নিজেদের উদ্দিষ্ট অর্জনের জন্য শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের সুদৃষ্টি পেতে কৃপা ভিক্ষা করতে লাগলেন। ফলে মেধাবী ছাত্ররা যেমন মাস্তানতন্ত্রের ছাত্ররাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিল, তেমনি বিবেকবান পণ্ডিত শিক্ষকরা এমন অসুস্থ রাজনৈতিক ধারা থেকে সরিয়ে ফেলে নিজেদের শিক্ষা ও গবেষণায় নিবেদিত করলেন।
এমন বাস্তবতায় উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অন্ধকারের ছায়া নেমে এলো। উপাচার্য নিয়োগকে ঘিরে শিক্ষক রাজনীতি হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল বিভিন্ন পর্বের ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক অভিভাবক। তার মননশীলতা, পাণ্ডিত্য ও সক্ষমতা অনেক বেশি সহায়ক হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গনকে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে। বুঝতে হবে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনি এমনিই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো না। এখন সেই বিশ্ববিদ্যালয় গায়ে গতরে অনেক বড় হলেও তাকে একাডেমিক ঔজ্জ্বল্যের বিচারে বিশ্ব র্যাংকিংয়ের তালিকার তলানিতেও খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? এদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একই।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক পতনের জন্য যখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে দায়ী করা হয়, তখন একে বড় রকমের অবিচার বলেই মনে করি। ক্যাম্পাসের ভেতরে যারা বিষাক্ত ছোবল দিচ্ছেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা করছেন রাজনীতি অঞ্চলের যে সাপুড়েরা, প্রায় সময়েই তারা পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত আচরণে ও সিদ্ধান্তে এমন কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকারকে দৃশ্যমান দেখলাম না, যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করতে চান।
কিছুদিন আগে মহান সংসদে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বাস্তব কিছু প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা। দলমতের বিচার না করে যোগ্য, সর্বজনমান্য পণ্ডিত শিক্ষকদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিতে বলেছেন তারা। যদিও এসব বিরোধীদলীয় নেতা জানেন তাদের দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারাও উপাচার্য নিয়োগে একই অন্যায় করে গেছেন। তবুও সে বিচার না করে যৌক্তিক কথাগুলোকেই সমর্থন করতে চাই। পত্র পত্রিকাগুলোও উপাচার্য নিয়োগে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে লেখা প্রকাশ করেছে।
ভালো লাগল জবাবে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, কম যোগ্য শিক্ষকদের তারা উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেন এ সত্যটি। তিনি কারণও উল্লেখ করলেন। বললেন, যেসব সর্বজনমান্য পণ্ডিত শিক্ষককে উপাচার্য হিসাবে পেলে ভালো লাগত তারা এখন আর উপাচার্য হতে চান না। কথাটি সত্য, কিন্তু কারণটি তিনি বললেন না। এক ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য আমাদের রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই দিয়ে থাকেন। যখন বর্তমান ধারার নষ্ট ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা বলা হয়, তখন নেতারা হায় হায় করে ওঠেন। বলেন ক্যাম্পাসে রাজনীতির ট্রেনিং না থাকলে এরা ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরবে কেমন করে!এ কথা শুনে আবার সচেতন মানুষ হায় হায় করে। কারণ চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীর প্রশিক্ষণ পাওয়া বর্তমান ধারার ছাত্র রাজনীতিকদের হাতে যদি ভবিষ্যৎ রাজনীতির অঙ্গন ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে ধুতরা গাছে কি সুমিষ্ট আম ফলানো যাবে! ক্যাম্পাসে মেধাবী শিক্ষার্থীরা নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে থেকে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছে, তাতে প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল এরা বরঞ্চ আরও ভালোভাবে ধরতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃষক-শ্রমিকের কোনো রাজনৈতিক আর অস্ত্র প্রশিক্ষণ ছিল? সময়ের প্রয়োজনে সবাই দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা হতে পেরেছিল।
উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, উপাচার্যদের শুধু একাডেমিক নয়, প্রশাসনিক দক্ষতাও দেখাতে হয়; তাই নাকি সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত অধ্যাপকরা এ পদে আসতে চাইছেন না। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়দের ভাষায় অপেক্ষাকৃত কম বরেণ্য অধ্যাপকদের উপাচার্যের দায়িত্ব দিতে হচ্ছে। এর অন্তর্নিহিত ব্যর্থতার কথা তিনি বললেন না। এখন নানা রকম অন্যায় ও ব্যর্থতার অভিযোগে তাদের নির্বাচিত উপাচার্যদের ক্রমাগত আন্দোলনে নাজেহাল হতে হচ্ছে। আমরা উপাচার্য হিসাবে অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান, অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক এনামুল হক, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো সর্বজনমান্য বরেণ্য অধ্যাপকদের কি পাইনি? তারা কি দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারেননি?
পাঠক ক্ষমা করবেন, এ প্রসঙ্গে নিজের একটি উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। আমি শিক্ষকতার প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। কখনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হইনি। বিএনপির আমলে বিএনপি-রাজনীতির অধ্যাপক জসিম উদ্দিন স্যার উপাচার্য ছিলেন তখন। শহিদ সালাম-বরকত হল তখন রাজনীতির দিক থেকে জটিল হল। কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ আমার ছিল না। সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছি। ক্যাম্পাসে বাসা দরকার। বাসা পাওয়ার সহজ উপায় হলো প্রশাসনে যুক্ত হওয়া। সেই সূত্রে তখন সালাম-বরকত হলের ওয়ার্ডেন আমি। এর মধ্যে দায়িত্ব শেষ হলে হল প্রভোস্ট বিদায় নিলেন। নতুন প্রভোস্ট না আসা পর্যন্ত আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম। এমন এক সময়ে ডাক এলো ভিসি অফিস থেকে। ভিসি এবং প্রোভিসি বসা। ভিসি স্যার বললেন, আমার আপত্তি না থাকলে প্রশাসন আমাকে প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে চায়। আমি অবাক হলাম। জেনে আসছিলাম রাজনৈতিক পরিচয়ের সূত্রেই এসব দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভিসি স্যারকে বললাম, তারা কি জানেন যে আমি শিক্ষক রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ। তাছাড়া বিএনপির রাজনীতি থেকে আমার অবস্থান অনেক দূরে। স্যার বললেন, তারা সবই জানেন। পাশাপাশি জানেন রাজনীতির দিক থেকে একটি জটিল হল আমি চালিয়ে যাচ্ছি। দলমত নির্বিশেষে ছাত্ররা আমাকে পছন্দ করে। সে বিবেচনায় তারা আমাকে চান। আমি শর্ত দিলাম, দুবছরের বেশি আমি দায়িত্বে থাকব না। শেষ পর্যন্ত এমন হলো দুজন ভিসির মেয়াদকাল শেষ হলো। অব্যাহতি চেয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদনের পর আবেদন করেও রেহাই পেলাম না। সময় বৃদ্ধি করে করে সাত বছর আমাকে প্রভোস্ট হিসাবে থাকতে হয়েছিল। ভিসিরা নিশ্চিন্তে থাকতে চেয়েছিলেন। হলে ছাত্রদের কাছে আমার জনপ্রিয়তা কমেনি।
তাই বলছিলাম একজন বিদগ্ধ বরেণ্য অধ্যাপক প্রশাসন চালানোর অনিচ্ছায় উপাচার্য হতে চান না, এটা বোধহয় সব ক্ষেত্রে সত্য নয়। সত্য হচ্ছে, নিম্নমানের রাজনীতিকরণের অসুস্থ পরিবেশ তাদের মধ্যে বিকর্ষণ তৈরি করছে। একজন রাজনীতিসংশ্লিষ্ট শিক্ষক যা হজম করতে পারবেন, একজন মুক্তচিন্তার বরেণ্য অধ্যাপক তা পারবেন না। আমরা কাছে থেকে দেখেছি উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সামনে উগ্র ছাত্রনেতারাও মাথা নত করত। পূর্বঅনুমতি ছাড়া ছাত্রনেতাদেরও ভিসির কক্ষে প্রবেশের অনুমতি ছিল না তখন। এখন তো শুনি রাজনীতির চাপে ভিসিরা বাধ্য থাকেন টেন্ডারের বখরা ছাত্র নেতাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে। নিয়োগ বাণিজ্য এখন নাকি অনেকটা প্রকাশ্য। শিক্ষক নিয়োগে মেধার চেয়ে রাজনৈতিক চাপ ও আরও অন্য কিছু বেশি কাজ করে। আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ডে আঘাত করেছেন-করে যাচ্ছেন। আমি দায়িত্ব নিয়েই বলব, সব ধরনের রাজনৈতিক চাপ, ছাত্র ও শিক্ষক নেতাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করে স্বাধীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনে ও প্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব বরেণ্য অধ্যাপকদের হাতে তুলে দিন, দেখবেন অচিরেই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে পাবে এর আপন মর্যাদা। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক সরকারগুলো তুরুপের তাস হাত ছাড়া করবেন কিনা।
ড. এ কেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com