যুদ্ধ নয়, মানবিক বিশ্বব্যবস্থাই কাম্য

মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবী নিজের নিয়মেই পরিবর্তনশীল। মানুষ সেই পরিবর্তন কিছুতেই রোধ করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ চাঁদ-মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি মহাবিশ্বের অনেক কিছুই জয় করেছে; কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি। মানুষ ভূমিকম্প, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে। কবে এসব তার করতলগত হবে, তা ভবিষ্যৎই জানে।
আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয়, বিশ্ব একটি মানবিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে ঘরে ঘরে, দেশে দেশে, মানুষের কান্না থামাতে গেলে অবশ্যই মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ যদি মানবিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী কখনোই সুন্দর ও শান্তিময় হবে না। এই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্রাজ্যবাদসহ সব উগ্রপন্থীকে নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে হবে। আজ আমরা পৃথিবীর দেশে দেশে কিছু উপদ্রব দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি, একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে; সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে দমনপীড়ন ও হত্যা করছে সংখ্যাগুরুরা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ড দেখে আজ সংগত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি তাহলে আবার পেছনে ফিরে যাচ্ছি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা কল্পনা যোশীর (১৯১৩-১৯৯৫) একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কল্পনা যোশী কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমি আর নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কল্পনা যোশীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার আগে ইলাদি বলেন, ‘কল্পনাদিকে দেখতে গিয়ে কী হবে, তিনি তো কাউকে চিনতে পারেন না।’ তবু আমি কল্পনাদির স্নেহের কথা মনে করে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, তিনি তার বেডে চুপচাপ শুয়ে আছেন। তাকে সেবারত নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি আর ইলাদি ভেতরে যাই এবং ডেকে তুলি। আমার পরিচয় দিতেই তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে বলি, বাংলাদেশ ভালো নেই। এরপর তিনি বললেন, ‘একদিন আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছি। তখন মনে হতো পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। কিন্তু আজ দেখছি, পৃথিবীটা যেন কেমন হয়ে গেল।’ তিনি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার মাথায় তখনো কল্পনাদির কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন তো আমরাও আমাদের যৌবনে সুন্দর পৃথিবীর জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ পৃথিবীর এ রক্তাক্ত দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
আজ আমরা প্রাচ্য-প্রতীচ্য যেদিকেই তাকাই না কেন, সবখানেই মানুষের হাহাকার দেখছি। দিশেহারা মানুষের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্ষমতাশালীদের প্রতাপে ভেঙে পড়ছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সভ্যতা। মানুষ তার স্বভূমি থেকে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেশে আগুন জ্বলে উঠছে। শান্তির পরিবর্তে মানুষ ভোগ করছে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক শাস্তি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হচ্ছে। আমরা কি পারি না সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর দিন আনতে? মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে সুন্দর ও শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। কল্যাণের দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। বিগত শতাব্দীতে আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে। আজ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারমাণবিক ও জীবাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ সেই যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুতেই আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবিকবোধ জাগ্রত করতে মানুষকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। অশুভ শক্তির পতন ঘটিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারে আজ আমাদের সবাইকে আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই মুক্তি মিলবে মানুষের।
বর্তমান পৃথিবী এখন একটা নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থা কখনো সফল হবে না। সিআইএ, পেন্টাগন, ন্যাটোর সব প্রচেষ্টা আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সৃষ্ট তালেবান, আল কায়দা, আইএসের সঙ্গে আবার তাদেরই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা কামনা করছে।
এবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। বঙ্গবন্ধুর আমলে যেমন বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের চক্ষুশূল ছিল, এখনো তাই আছে। তবে আশার কথা এই যে, জনবান্ধবনেত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে বিরুদ্ধবাদী সেই শক্তিমান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন-আমেরিকা, চীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ওআইসি এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য গড়তে তৎপর হয়ে উঠছে। এটি বর্তমানের বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সুখবর।
নিন্দুকের দৃষ্টি কখনোই ভালো কিছু দেখে না। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব দুঃসাধ্য কাজ সাধন করেছেন, তা কারও পক্ষে সম্ভব হতো কিনা জানি না। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন (যেমন হিজবুত তাহরির, জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ)-এর মূলোৎপাটন করেছেন। এগুলোকে যারা ছোট করে দেখতে চায়, তারা প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অস্বীকার করতে চায়। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এটি যতদিন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে না পারবে, ততদিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন, কোনো পরিকল্পনাই টেকসই হবে না; আর সেখানেই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নাম আকাশে-বাতাসে সসম্মানে উচ্চারিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সূচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনাকেই ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বসভায় সুনাম অর্জন করছে। অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন কাঙ্ক্ষিত স্তরে উপনীত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ পরিহার করতে হবে। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং জনমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাংগঠনিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। এ জন্য সজাগ থাকতে হবে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগের কাছেই বাংলাদেশ আশা করে; কেননা, আশার স্বপ্ন আওয়ামী লীগই বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য রাখে। বহতা নদীর মতো আওয়ামী লীগ চলমান।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছে। এখন মানুষের মনে অনেক আশা জন্ম নিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে, আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এখন সবদিক সামাল দিয়ে ঠান্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশে এখন বড় বাধা দুর্নীতি। সব সেক্টরে দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন আর সাধারণ মানুষের স্বপ্ন মিশে একাকার হয়ে গেছে। যে অনন্য উচ্চতায় শেখ হাসিনা নিজেকে এবং বাংলাদেশকে স্থাপন করেছেন, সংগত কারণেই তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। বাংলার নিরন্ন-দুঃখী মানুষের প্রত্যাশা তিনি পূরণ করবেন, এমনটাই আশা করে এদেশের জনগণ।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত যেদিকেই যাক না কেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে চোখ রাখতে হবে এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের দিকে। আবেগের বশে কোনো খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কোনো রাষ্ট্রের চাপের কাছে মাথা নত করাও ঠিক হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ নয়; মানবিক বিশ্বব্যবস্থাই আমাদের কাম্য।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ