দেশের অবয়বজুড়ে বঙ্গবন্ধু

অমিত রায় চৌধুরী
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধু আজ শুধু দেশের নয়, গোটা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার। সভ্যতার যে বিবর্ণ দিনটিতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন, সেদিনও তিনি ছিলেন বিশ্বের একজন অতিপরিচিত, ভীষণ জনপ্রিয় মুখ। নিপীড়িত গণমানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ। তাকে সমীহ করেছে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।
মর্যাদা দিয়েছে ধনী দেশগুলোর জনগণ। পূর্ব-পশ্চিম-মধ্যপ্রাচ্য-সবখানেই তার জায়গা পোক্ত হয়ে উঠেছিল। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা জাতীয়তাবাদ-রাষ্ট্রগঠনের যেসব নীতিচর্চায় বঙ্গবন্ধু আলোচিত হয়েছিলেন, সবখানেই ছিল তার প্রজ্ঞা, স্বাতন্ত্র্য ও রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টির স্বাক্ষর।
১৯৬৯ সাল। নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় দেশ। বীরের বেশে কারামুক্ত হন বঙ্গবন্ধু মুজিব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাখ্যান করে লাখো জনতা। বঙ্গবন্ধু জনপ্রিয়তার অত্যুচ্চ শিখর স্পর্শ করেন। ১৯৭০ আঞ্চলিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর।
প্রবল আন্দোলনের মুখে সামরিক জান্তা সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। দেশভাগের পর প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় আমজনতা।
বঙ্গবন্ধুও নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পান। ফলাফল দেখে দলের শীর্ষনেতা ও তাত্ত্বিকরাও অবাক হয়ে যান। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও রাজা ত্রিদিব রায় বাদে দল সবকটি আসন লাভ করে। দেখা গেছে, মুজিব যে জনসভায় যোগ দিয়েছেন, সেখানেই অন্তত ১০ শতাংশ ভোট বেশি যুক্ত হয়েছে। একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ তার স্মৃতিচারণে লেখেন বিখ্যাত এক ব্যারিস্টারের গল্প।
নিজের জন্য তিনি নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জনসভার পর গণসংযোগ চলছিল। এক অশীতিপর বৃদ্ধ-কৃষক প্রার্থীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সাফ বলে দেন-ভোট তিনি মুজিবকেই দেবেন, অন্য কাউকে নয়। আওয়ামী লীগ বিপ্লবী দল ছিল না। গরিব খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ, কিন্তু বামপন্থিকে নয়, বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিয়েছিলেন। দলের শেকড় এতটা গভীরে ছিল যে তা সবাইকে বিস্মিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু এত বিপুল সমর্থনের ভার ও দায় অনুভব করতেন।
তিনি এ ভালোবাসার ঋণ যেমন ভোলেননি, তেমনি দায়টাও সমানভাবে নিয়েছিলেন। ঠিক করে ফেলেছিলেন-মানুষের জন্য, তাদের স্বপ্নপূরণের জন্য জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে দেবেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের সব প্রস্তুতি ও নির্দেশনা দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়েছিলেন। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত নিষ্ঠুর পাক সেনার হাত থেকে তিনি বাঁচার চেষ্টা করেননি।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭০-ইতিহাসের সব পাতায় বঙ্গবন্ধুকে চিনতে কষ্ট হয় না। অসম সাহস, অগ্নিশুদ্ধ সততা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা ও তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টি তাকে দলের ওপর অবিশ্বাস্য মনোজাগতিক কর্তৃত্ব এনে দিয়েছিল। জিন্নাহ, নেহেরু, এমনকি গান্ধীর মতো উঁচুতলার মানুষ ছিলেন না তিনি। মুজিব মাঠেঘাটে ঘাম ঝরানো রাজনীতির কর্মী।
উকিল-মোক্তার, শিক্ষক-ডাক্তার, চাষা-মজুর-সবার আবেগের সঙ্গে নিজের আবেগকে জড়িয়ে নিতে পারতেন। রূপকথার নায়কের মতো মিশে যেতেন সাধারণ মানুষের চোখের জলে, দেহের ঘামে, শরীরের মজ্জায়। নিজের সত্তাকে নিঃশর্তে জড়িয়ে নিতেন-মাটি, গাছপালা, নদী-খাল কিংবা ভাটিয়ালির সুর-মূর্ছনায়। এভাবেই তিনি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংযোগ ঘটিয়েছিলেন।
বাঙালির ভাবনাজগতে সম্ভাবনার আলোকরেখা দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রাজনৈতিক মননে চকিতে জেগে উঠেছিল আঞ্চলিক সত্তাবোধ। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছয় দফা, এগার দফা, গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ-বাঙালির ধারাবাহিক মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর যে রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল, তা ইতিহাস কিংবা রাজনীতির ছাত্রের জন্য নিঃসন্দেহে এক ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত।
রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বঙ্গবন্ধু একটি শিল্পে পরিণত করেছিলেন। যার আদর্শ ছিল সত্য ও সুন্দর। তার সহজ-সরল জীবনযাপন, তীক্ষè স্মরণশক্তি, মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসামান্য দক্ষতা এবং অবিশ্বাস্য বাগ্মিতা মানুষের মনে তার জায়গাকে নির্বিকল্প করে তুলেছিল। লাখো জনতার সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। সবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জাদুকরী দক্ষতায়।
কখনো যুক্তিতে শানিত করেছেন, কখনো আবেগে ভাসিয়েছেন, কখনো বা সাহস জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা স্বীকার করেছিল-তাকে জীবিত রেখে কোনো লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না। লাখো মানুষ তাকে মুক্ত করে আনবে। তাই তাকে হত্যার কোনো বিকল্প ছিল না। বিচিত্র এ দেশ! আজও গণতন্ত্রের কথিত ত্রাণকর্তারা এ স্বঘোষিত বর্বরতাকেও নানা কৌশলে অনুমোদন করে। আর শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শঠতার নজির গড়ে।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শুধু ভৌগোলিক মানচিত্র দেননি, মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিধ্বস্ত দেশকে দিয়েছেন মুক্তির দিশা, সমৃদ্ধির পথনকশা। একটি আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের সব উদ্যোগই নিয়েছিলেন তিনি। একদিকে বিভক্ত বিশ্বব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে পরাজিত শক্তির আস্ফালন, অন্যদিকে সমাজেরই একটি অংশের লোভের কাছে সমর্পণ।
ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠা পরিস্থিতি সামলে তিনি যেভাবে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অকল্পনীয় সামর্থ্যরে নজির গড়েছিলেন, তা যে কোনো রাষ্ট্রনেতার জন্যই রোল মডেল। তার সব কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এমন ব্যবস্থা চেয়েছিলেন, যেখানে কোনো শ্রেণির হাতে যাতে সম্পদ কুক্ষিগত না হয়। বৈষম্য কমে আসে, সমাজ কাঠামোতে সাম্যের ভিত মজবুত হয়।
দুর্নীতি, শোষণ ও বিভেদমুক্ত ন্যায্য সমাজের স্বপ্নই তিনি দেখেছিলেন। তার শত্রুরাও তার কাছ থেকে ঔদার্যের সবটুকু সুবিধা নিংড়ে নিয়েছিল। ডেভিড ফ্রস্টকে তাই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, আমার দুর্বলতা-আমার দেশের মানুষকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি। যদিও এ উদার ভালোবাসা আর প্রশ্নাতীত বিশ্বাসের মাশুল তাকে জীবন দিয়েই পরিশোধ করতে হয়েছিল।
গবেষকরা একমত-বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনৈতিক কনভিকশন খুব কম নেতার চরিত্রে পাওয়া যায়। একটি বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক সত্তা কীভাবে একজন নেতাকে সম্পূর্ণ করে তোলে, তা বিশ্বের অনেক তাত্ত্বিক পণ্ডিতকেও বিস্মিত করেছিল। উপনিবেশ-উত্তর যুগে আন্তর্জাতিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে কোনো জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ঘোষণা সহজ ছিল না। নিয়মতান্ত্রিক স্বাধিকার আন্দোলন, বৈষম্য ও শোষণের উপাত্ত সঠিকভাবে প্রমাণ করা এবং সর্বোপরি জনতার নিশ্ছিদ্র ঐক্য ও সমর্থন স্বাধীনতার দাবিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আর ৭ মার্চ গোটা পৃথিবী দেখেছিল ‘আ স্টেইট ইন মাইন্ড ওয়াজ বর্ন’-মানবসভ্যতার ইতিহাসে যা বিরল। সাংবিধানিক রাস্তায় মুক্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন মুজিব; যা মুক্তিকামী মানুষের চিরকালীন রাজনীতির প্রকরণে ধ্রুপদী লেখচিত্র হয়েই থাকবে। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে শতকোটি প্রণাম।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
archowdhury562@gmail.com