
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
দেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের পাশাপাশি এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ অনুযায়ী, ক্রেতা যেসব বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন সেগুলো হচ্ছে-বিক্রেতার পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, সেবার তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করা, পণ্য মজুত করা, ভেজাল পণ্য বিক্রি, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করা, ওজনে ও পরিমাপে কারচুপি, দৈর্ঘ্য পরিমাপের ক্ষেত্রে গজফিতায় কারচুপি, নকল পণ্য প্রস্তুত, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয় ও অবহেলা।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশের বেশিরভাগ ক্রেতাই জানেন না প্রতিকার কোথায় ও কীভাবে চাইতে হবে। আর চাইলেই যে প্রতিকার পাওয়া যাবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। আইনানুযায়ী প্রতিটি জেলায় এর অধিদপ্তরের অফিস থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ধারা ৭৬(১) অনুযায়ী, ‘যে কোনো ব্যক্তি, যিনি, সাধারণভাবে একজন ভোক্তা বা ভোক্তা হইতে পারেন, এই অধ্যাদেশের অধীন ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য সম্পর্কে মহাপরিচালক বা এতদুদ্দেশ্যে মহাপরিচালকের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবহিত করিয়া লিখিত অভিযোগ দায়ের করিতে পারিবেন।’ অভিযোগ দায়ের করা যাবে মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ১ কারওয়ান বাজার (টিসিবি ভবন ৮ম তলা), ঢাকা, ফোন : +৮৮০২ ৮১৮৯৪২৫; জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র, টিসিবি ভবন ৯ম তলা, ১ কারওয়ান বাজার ঢাকা, ফোন : ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮, ই-মেইল: nccc@dncrp.gov.bd; উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি ভবন, বন্দরটিলা, চট্টগ্রাম, ফোন : ০৩১-৭৪১২১২; উপ-পরিচালক, রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, শ্রীরামপুর, রাজশাহী, ফোন : +৮৮০৭ ২১৭৭২৭৭৪; উপ-পরিচালক, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি ভবন, শিববাড়ী মোড়, খুলনা, ফোন : ০৪১-৭২২৩১১; উপ-পরিচালক, বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মহিলা ক্লাব ভবন, বরিশাল, ফোন : +৮৮০৪ ৩১৬২০৪২; উপ-পরিচালক, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, সিলেট, ফোন : ০৮২১-৮৪০৮৮৪; উপ-পরিচালক, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর, ফোন : ০৫২১-৫৫৬৯১ বরাবর। এ ছাড়া প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরও অভিযোগ দায়ের করা যাবে। তবে দায়েরকৃত অভিযোগ অবশ্যই লিখিত হতে হবে। অভিযোগ ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েব সাইট, ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দায়ের করা যাবে এবং দায়েরকৃত অভিযোগের সঙ্গে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রসিদ সংযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি অভিযোগকারীকে তার পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল আইডি এবং পেশাও উল্লেখ করতে হবে।
বলা বাহুল্য, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে অনলাইন ব্যবসা তথা ই-কমার্স এবং এফ-কমার্সের (ফেসবুক কমার্স) যত প্রসার ঘটছে, ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও তত বাড়ছে। বিভিন্ন ই-কমার্স ও এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায়ই নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতে, ভুক্তভোগীদের খুব কমই প্রতিকার চাইতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে যান। ই-কমার্স বা এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে সময়মতো পণ্য না দেওয়া। আবার তাদের শর্তের মধ্যে থাকে, পণ্যের মজুত থাকা সাপেক্ষে সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া যে কোনো সময় চুক্তি বাতিল ও অনিবার্য কারণে পণ্য সরবরাহ বিলম্বিত হতে পারে বলেও ওই প্রতিষ্ঠানগুলো শর্ত জুড়ে দেয়, যা ক্রেতার স্বার্থের পরিপন্থি। ২০০৯ সালে যখন ভোক্তা অধিকার আইন জারি হয়, তখন ই-কমার্স বা অনলাইনে বেচাকেনা তেমন ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে কেনাবেচা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষার সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় বিক্রেতা বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো শর্ত আরোপ করে চলেছে। ফলে ক্রেতা বা সেবাগ্রহীতারা প্রতারিত হলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। সুতরাং, এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।
মানুষের জীবন ধারণসহ জীবনযাপনের জন্য যতগুলো চাহিদা রয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য হচ্ছে প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। কিন্তু দেশের জনগণ প্রতিদিন যেসব খাবার খান, তা কি নিরাপদ বা ভেজালমুক্ত? নিশ্চয় না। তার মানে, জনগণ প্রতিনিয়তই ভেজাল খাবার খাচ্ছেন। এমনকি এদেশে শিশুখাদ্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হয়েছে এবং ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ছাড়ও পেয়েছেন, যা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে কাউকে ন্যূনতম ছাড় পর্যন্ত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ এ দেশে বাস্তবে ঘটছে উল্টো ঘটনা। এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির দীর্ঘদিনেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারা দেশে স্বতন্ত্রভাবে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে অধিক মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। অনেক সময় তাদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হলেও তারা ঘুস, পেশিশক্তিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা এবং জনগণ সচেতন ও সোচ্চার না হওয়ায় খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আশার কথা, বর্তমান সরকার ফরমালিন আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তা সরকার কর্তৃক সুনিশ্চিত করা আবশ্যক। এ আইনে খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
সবার স্মরণে রাখা প্রয়োজন, কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকার জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করতে আন্তরিক হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। সর্বোপরি, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক বিভিন্ন পদার্থ মেশানো রোধে এবং ভোক্তা-অধিকার সুনিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার এবং গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আশা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীসহ পণ্য উৎপাদনকারীদের সৎ হতে হবে এবং জনগণকে তাদের অধিকার বিষয়ে অধিকতর সচেতন হতে হবে। তবে ভোক্তা অধিকার সুনিশ্চিত করতে বা খাদ্যে ভেজাল রোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবসায়ী, পণ্য-উৎপাদনকারীসহ সবার নৈতিকতাবোধ ও বিবেককে জাগ্রত করা।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
kekbabu@yahoo.com