সরকারি আয়ের যৌক্তিক উৎস বাড়াতে হবে

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতীকী ছবি
আমরা সামন্তযুগ পার করে গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিচরণ করছি। রাজকোষের মালিক এখন কোনো রাজা নন, বরং জনগণের কাছ থেকে আহরিত টাকা দিয়ে গড়ে তোলা রাজকোষের প্রকৃত মালিক জনগণ। তবে তা পরিচালনা করার জন্য থাকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠন করা একটি সরকার। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের একই রীতি। সরকারই নির্ধারণ করে কোথা থেকে আয় করে কোথায় ব্যয় করা হবে। এই আয়-ব্যয়ের হিসাবকে বাজেট বলে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়েও বাজেট থাকে। তবে পারিবারিক বাজেটের সঙ্গে সরকারি বাজেটের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। পারিবারিক বাজেটে কতটা ব্যয় করা হবে, তা নির্ভর করে আয়ের ওপর। আর সরকারি বাজেটে প্রথমে নির্ধারণ করা হয় কতটা ব্যয় করা হবে, আয়ের কথা পরে।
সরকার আয় করে কোথা থেকে? সরকারি আয়ের একটি বড় উৎস হলো আয়কর। এটাকে আমরা প্রত্যক্ষ কর বলি। প্রত্যেক সাধারণ মানুষ বছরে যে পরিমাণ আয় করেন, তার একটি অংশ সরকারকে কর হিসাবে দিতে হয়। তবে গেল বাজেটে বলা হয়েছে, যেসব পুরুষ বছরে ৩ লাখ টাকা বা তার নিচে আয় করবেন, তাদের কর দিতে হবে না; নারীর ক্ষেত্রে এটা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর বেশি আয় করলে বাড়তি আয়ের ওপর কর দিতে হবে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য আয়ের উৎস হলো মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। এটিকে আমরা পরোক্ষ কর বলি। দেশে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগ করা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়, যা মূল্য সংযোজন কর নামে পরিচিত। এর বাইরে সরকারের আরও আয়ের উৎস আছে। তার মধ্যে আছে আবগারি শুল্ক, বাণিজ্য শুল্ক, ভূমি রাজস্ব, রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প, বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা, সেবা খাত থেকে আয়, রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লভ্যাংশ, ডাক ও টেলিফোন বিভাগ থেকে আয়, তিনটি সমুদ্রবন্দর থেকে প্রাপ্ত আয় প্রভৃতি।
আয়ের বিপরীতে আছে ব্যয়। সরকার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে, এর সঙ্গে আছে শিক্ষা, বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয়, পূর্ত বিভাগের ব্যয়, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়, বিচার বিভাগ ও কারা বিভাগের ব্যয়, সরকারি প্রশাসনিক ব্যয়, সামাজিক উন্নয়ন ব্যয়, সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন রকম ভর্তুকি। সব মিলে এই হলো সরকারি আয়-ব্যয়ের একটি বোধগম্য চিত্র। আয়-ব্যয়ের খাতগুলো মাথায় রেখেই সরকার প্রতিবছর বাজেট প্রণয়ন করে থাকে।
যদি সরকারি আয়ের সমান সরকারি ব্যয় হয়, তাহলে তাকে সুষম বাজেট বলে। যদি আয়ের চেয়ে ব্যয় কম হয়, তাহলে তাকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে। আর যদি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি ধরা হয়, তাহলে তাকে বলা হয় ঘাটতি বাজেট। শক্তিশালী অর্থনীতিতে সুষম বাজেট লক্ষ করা গেলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে সাধারণত ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়। সেই হিসাবে আমাদের বাজেটও ঘাটতি বাজেট। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমাদের প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত বাজেট হলো ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সরকারের আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং বাজেটের ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকার কোথা থেকে এই ঘাটতি পূরণ করবে? অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো হবে। বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাদবাকি টাকা দেশীয়ভাবে ধার করা হবে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৭৬ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা। এর জন্য মোটা অঙ্কের সুদ দিতে হবে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কেবল সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ শতাংশেরও বেশি। এত বড় সুদের আকার নিয়ে কল্যাণকর কোনো বাজেট তৈরি করা সম্ভব নয় বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দিনদিন সরকারের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় জিডিপির ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির প্রায় ৪২ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে জিডিপির ৪৫ শতাংশে। আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছর শেষে আমাদের সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৮০ কোটি ডলারে। যদি ১ ডলার সমান ৮৬ টাকা ধরা হয় (বাস্তবে আরও বেশি), তাহলে দেশীয় মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকায়, যা চলতি বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের ৫৮ শতাংশই নেওয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস যেমন ব্যাংক, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। আমরা জানি, বিদেশি ঋণের চেয়ে দেশীয় ঋণের সুদ কয়েকগুণ বেশি। এই ঋণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে সুখকর কিছু প্রত্যাশা করা যাবে না।
ফি বছর ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির একটি কারণ হলো, যে পরিমাণ আয় প্রাক্কলন করা হয়, বছর শেষে সেই পরিমাণ আয় সরকার ঘরে তুলতে পারে না। এ কারণে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায়। এই প্রাক্কলিত কর আহরণ করতে না পারার কারণগুলো হলো-কর ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি, অনিয়ম আর অদক্ষতার সংমিশ্রণ। এদিকে সরকারকে আন্তরিক দৃষ্টি দিতে হবে। ঋণ বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণটি হলো, বছর বছর সরকারি ব্যয় বাড়লেও ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করা। আমাদের করব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত আশঙ্কাজনকভাবে কম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত ডেনমার্কে। সেখানে করের পরিমাণ জিডিপির ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। যদি আমরা উন্নয়নশীল দেশের কথা বিবেচনায় নিই, সেখানেও দেখব গড় কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশ। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের বেশি নয়, যদিও নেপালে তা ১৮ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে করের উৎস বাড়াতে হবে।
এমন অনেক উৎস আছে, যেদিকে সরকারের কোনো নজর নেই। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০১৫ অর্থবছর থেকে সরকারের পাশাপাশি একটি ‘বিকল্প বাজেট’ প্রস্তাব করে থাকে। যদিও সেই বিকল্প প্রস্তাবনার কোনো কিছুই সরকার আমলে নেয় না বা বিবেচনায় নিতে আগ্রহী হয় না। ২০২০-২১ অর্থবছরে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত বিকল্প বাজেটে নতুন করের কমপক্ষে ২০টি উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন, যা থেকে সরকার দ্বিগুণেরও বেশি আয় করতে পারে। আমি এখানে দুই-তিনটি উৎসের উল্লেখ করব। বিদেশি নাগরিকদের ওপর সরকারের কোনো কর নেই। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, সেখান থেকে সরকার ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আয় করতে পারে। যেহেতু সম্পদ কর নেই, তাই এ খাতে সরকারের কোনো আয় নেই। অথচ সম্পদ কর থেকে আয় হতে পারে কমপক্ষে ৮০ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত মুনাফার ওপর আমাদের দেশে কোনো প্রকার করারোপ করা হয় না। কিন্তু তা থেকে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বিদেশি পরামর্শক ফি বাবদ সরকার আয় করতে পারে ৩ হাজার কোটি টাকা; অথচ বর্তমানে এ বাবাদ সরকারের কোনো আয় নেই। আমাদের দেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৩৬ শতাংশের সমান। কালোটাকা উদ্ধার করে সরকার ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে। সুতরাং সরকারকে কর ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ করতে হবে, বাড়াতে হবে করের যৌক্তিক উৎস।
ঋণ নিয়ে বাজেট করার মধ্যে কোনো অদূরদর্শিতা নেই, নেই কোনো অপরাধ কিংবা তা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু বিবেচনার বিষয় হলো, সুদের বিনিময়ে নেওয়া এই ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। কোনো অপরিকল্পিত ব্যয়, দুর্নীতি অথবা অপচয় ঋণভারকে অসহনীয় করে তুলতে পারে, যা প্রকৃত অর্থে জনগণকে বহন করতে হবে। সরকারি অব্যবস্থাপনার দায় সাধারণ মানুষ নেবে কেন, এটাই এখন প্রশ্ন।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়