Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাংলার হাজার মহসিনের আত্মকথা

Icon

ড. মো. কামরুজ্জামান

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলার হাজার মহসিনের আত্মকথা

ফেসবুক লাইভে এসে আবু মহসিন খান নামের এক প্রবীণ ব্যক্তির আত্মহননের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। মহসিনের মতো অনেক মানুষই দেশে আত্মহত্যা করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যাকারী মানুষের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা বছরে ১০ থেকে ১৫ হাজার। এক সমীক্ষা বলছে, প্রতিদিন দেশে গড়ে ৩৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। দেশে সংঘটিত আত্মহত্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বৃদ্ধবয়সি আত্মহত্যাকারী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে কম।

কিন্তু ৫৮ বছর বয়সি মহসিনের আত্মহত্যাটি দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নয়, ঘটনাটি গোটা বিশ্ববিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এ ঘটনা দেশে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে।

কোনো মানুষ যখন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে এবং এটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখনই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে মানুষটি সম্পূর্ণ গোপনীয়তা অবলম্বন করেন। কিন্তু মহসিন খানের আত্মহত্যাটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মহসিন খান তার মৃত্যুর খবর জানাতেই ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একাকী সময় কাটাচ্ছিলেন।

আত্মীয়স্বজন তাকে একা ফেলে রেখে প্রবাসজীবন পার করছিল। নিজের স্ত্রীও তাকে সঙ্গ দেওয়া থেকে বঞ্চিত রাখছিল। তিনি ক্যানসারের অসহনীয় যন্ত্রণায় একাকী ছটফট করছিলেন। ব্যবসায়ী পার্টনাররা তার সঙ্গে প্রতারণা করছিল। মহসিনের ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা তারা মেরে দিয়েছিল। এতসব যন্ত্রণার কারণে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্নের বিষয় অন্য জায়গায়।

মহসিন খান ১৬ মিনিট লাইভে থাকলেন। পাশের ফ্লাটের কেউই টের পেলেন না? এত সময়ের লাইভটি স্থানীয় জনগণের মধ্যে কারও নজরে এলো না? ইন্টেলিজেন্স ফোর্সের বিভিন্ন বাহিনীর একজন সদস্যও এটি জানতে পারলেন না? ফেসবুক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কারও চোখেই বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলো না? সচেতন মানুষের মাঝে এ প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে উঁকি মারছে।

ফেসবুক লাইভে আসার কারণে আমরা শুধু একজন মহসিনের যন্ত্রণা দেখতে পেলাম। দেশে এরকম মহসিনের সংখ্যা মোটেই কম নয়। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মহসিনের মতো প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দুই কোটির উপরে। এ দুই কোটি প্রবীণের অনেকেই অসহনীয় যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে বেঁচে আছেন। অমানবিক দুঃখ আর কষ্ট নিয়ে তারা দিন পার করছেন।

প্রবীণদের এ দুঃখ ও কষ্টের পেছনে বর্তমান সমাজব্যবস্থাই দায়ী বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। মহসিন যখন ছোট ছিলেন তখন প্রাচীন বাংলার সমাজব্যবস্থাটা বর্তমানের মতো ছিল না। প্রাচীন বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি ছিল সবাই মিলে একত্রে বসবাস। সে সময়ে ছিল একান্নবর্তী ও যৌথ সংসার। এ সংসারে সবার মাঝে ছিল মায়া-মমতার এক নিবিড় বন্ধন। সেকালের যৌথ পরিবারগুলো ছিল নানা গল্পকথায় পরিপূর্ণ।

সে গল্পকথায় মূল নায়ক ছিল মহসিনের মতো বৃদ্ধ দাদারা। তখন এ দাদারাই ছিলেন পরিবারের সর্বময় কর্তা। তখন একজন দাদা পরিবারের সবাইকে বটবৃক্ষের মতো আগলে রাখতেন। পারিবারিক সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এই দাদা। সংসারের যাবতীয় ক্ষমতা দাদাদের হাতেই ন্যস্ত ছিল। গল্পকথার মঞ্চে নায়িকার অভিনয়ে থাকতেন দাদার স্ত্রী অর্থাৎ দাদি। আর অন্যান্য চরিত্রে থাকত ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ও পুত্রবধূ।

সেকালের বাংলার চিরায়ত প্রথা ছিল পরিবারের বিবাহযোগ্য ছেলে ও মেয়েকে বিবাহ প্রদান। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ছেলের বউকে নিজের বাড়িতে আনা হতো। আর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্যের সংসারে পাঠানো হতো। আর এ কাজটি সাধারণত এই দাদার হাতেই ন্যস্ত ছিল। নায়িকার অভিনয়ে থাকা দাদি ছাড়া নাতি-নাতনিকে বিয়ে দেওয়ার কল্পনা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। প্রাচীন বাংলার আরেকটি সংস্কৃতি ছিল রান্নাবান্না ও খাওয়া দাওয়া। রান্নাবান্নার এ দায়িত্ব ছিল পুত্রবধূদের ওপর।

এ পুত্রবধূরাই পরিবারের সবার রান্নাবান্না ও খাওয়ানোর দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করতেন। পরিবারের সব বাচ্চা বড় হতো দাদা-দাদির কোলে। দাদি নাতি-নাতনিদের কোলে নিয়ে নানা গল্প শোনাতেন। দাদি ছিল পরিবারের সব কচিকাঁচার গল্পবুড়ি। এসব কচিকাঁচা দাদিদের কাছ থেকে সুয়ো-দুয়োরানীর গল্প শুনত। ভূতের গল্প শুনতে শুনতে তারা দাদির কোলেই ঘুমিয়ে পড়ত। এভাবে কচিকাঁচারা দাদির স্নেহ ও পরশ পেয়ে বড় হয়ে উঠত। সে সময় প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্ক ছিল একই সুতোয় গাঁথা।

কিন্তু বর্তমান বাংলা আর সেরকম নেই। বর্তমান বাংলার নাম ডিজিটাল বাংলা। সেকালের গল্পকথা আজ সবই রূপকথায় পরিণত হয়েছে। প্রাচীন বাংলায় দাদা-দাদির কথাগুলো আজ শুধুই ইতিহাস। কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে যৌথ সংসারের ধারণা। যৌথ পরিবার ভেঙে গড়ে উঠেছে দয়া-মায়াহীন এক নির্জীব একক সমাজ। বর্তমানে গড়ে ওঠা প্রতিটি একক পরিবার যেন একেকটি স্বার্থবাজ পরিবার। অদৃশ্য জড় পদার্থ দিয়ে তৈরি বর্তমান পরিবারগুলো সম্পূর্ণভাবে হতাশায় নিমজ্জিত। একক পরিবারের পারিবারিক দেওয়ালে কান রাখলে শোনা যাবে শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ।

বাড়ির ভেতরে নেই কোনো উৎসব; নেই শৈশবের দুরন্তপনা। সবই যেন আটকে গেছে ছোট্ট এক ব্যালকনির গ্রিলে। যান্ত্রিক হয়ে গেছে সমাজ, সংসার এবং আত্মীয়তার বন্ধন। উৎসবের দিনেও সবাইকে একত্রে পাওয়া যায় না। আর শোকের দিনের কথা তো বৃদ্ধ মহসিন নিজের মুখেই বললেন! একান্নবর্তী সংসার ভেঙে গড়ে ওঠা প্রতিটি একক পরিবার এখন যেন একেকটি পাখির বাসা। যেখানে নেই কোনো আনন্দ; নেই কচিকাঁচাদের হৈচৈ ও কিচিরমিচির। আনন্দ ও সঙ্গহীন বাড়িটিতে সৃষ্টি হয়েছে এক ভূতুড়ে পরিবেশ। নাগরিক জীবন এখন এক টুকরা বারান্দা আর এক চিলতে জানালার মধ্যেই আটকে গেছে। মুক্ত আকাশবিহীন একটি ছোট ফ্ল্যাটে আটকে গেছে সবার জীবন। বেহালা, তবলা, হারমোনিয়াম, গিটার আর সেতারার মধ্যে আটকে গেছে পারিবারিক স্বপ্ন।

শহরে জন্ম নিয়ে কচিকাঁচারা আজ গ্রামের অপূর্ব সবুজ-শ্যামল থেকে বঞ্চিত। বটবৃক্ষরূপী সেকালের বৃদ্ধরাও আজ সম্পর্কের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। পারিবারিক আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন এসব বৃদ্ধের অবস্থান এখন দূর থেকে বহু দূরে। পরিবারকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা ভালোবাসার ঝরনাধারা আজ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে ধুলোর আস্তরণে। গ্রামগঞ্জে আজও পড়ে আছে সেই চুনকামবিহীন যৌথ পরিবারের ভঙ্গুর আর বিমর্ষ অনুভূতি। যেখানে আছে হয়তো নিষ্ঠুর আগুনে পোড়ানো ইট দিয়ে তৈরি একটি দালান ঘর। সে ঘরে আছে ছোট-বড় দুটো বা তিনটি কক্ষ। এ কক্ষগুলোতে বাস করেন শুধু একজন বুড়ো আর একজন বুড়ি। নিষ্ঠুর আগুনে পোড়ানো ইটের মতোই হয়ে গেছে এ দালানের ভিতর-বাহির। এ ইটের বাঁধনই যেন ঘর থেকে বের করে দিয়েছে সবার দয়া-মায়া, ভালোবাসা আর স্নেহ-প্রীতি।

আজ যে বন্ধনটুকু দেখতে পাওয়া যায়, তাতে তৈরি হয়েছে অনেকখানি কৃত্রিমতা। বর্তমানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া স্বামী-স্ত্রী দুজনই শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা গ্রাম থেকে শহরের উপকণ্ঠে একক পরিবার গড়ে তোলে। তারা বৃদ্ধ বাবা-মাকে দূরে রেখেই আলাদা থাকতে স্বচ্ছন্দবোধ করে। কালেভদ্রে ছেলের বাসায় বেড়াতে আসেন এ বুড়ো আর বুড়ি। সেকালে যে দাদা-দাদি ছিলেন বাড়ির কর্তা, আজকের সমাজে সেই দাদা-দাদি হয়ে পড়েছেন মেহমান। নাতি-নাতনিদের কাছে তারা পরিচিত হন মেহমান হিসাবেই। বর্তমান সংস্কৃতি তাদের বাইরের লোক হিসাবেই গণ্য করে। ছোটরা তাই জানতেও পারে না যে, দাদা-দাদি তাদের পরিবারের সদস্য। ফলে তাদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে না; একে অপরের মাঝে গড়ে ওঠে না মমত্ববোধ, সহমর্মিতা ও মায়ার বন্ধন। সেকালে গ্রামের একজন মানুষের কাঁচা কিংবা কাঁচা-পাকা দু-একটি ছোট্ট ঘর ছিল। ওই ঘরে একটি বারান্দা ছিল। এই ছোট্ট ঘরেই বাবা-মা ও ভাই-বোন একত্রে বসবাস করত। চাচা-চাচি, ফুফু আর দাদা-দাদিও বাস করত পাশাপাশি। দাদা-দাদির পরম স্নেহ পেতে কচিকাঁচারা তাদের কাছে গাদাগাদি হয়ে শুয়ে থাকত। এ কারণে এখানে পারিবারিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল অতি নিখুঁতভাবে। সেখানে অর্থের অভাব থাকলেও মায়া-মমতা ও ভালোবাসার অভাব ছিল না। দুঃখ থাকলেও সেটা সবাই মিলেই ভাগ করে নিত। কিন্তু আজ ভালোবাসা হয়েছে আর্টিফিসিয়াল। এটা ঢুকে পড়েছে বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত মুঠোফোনে। পারিবারিক সম্পর্ক ও বন্ধন আছড়ে পড়েছে মোবাইল আর ল্যাপটপের মনিটরে। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়েই সমাজে তৈরি হয়েছে নির্মমতা, অনুভূতিহীনতা ও নিষ্ঠুরতা। জন্ম নিয়েছে অশান্তি ও অবিশ্বাস। আর সেই অবিশ্বাসের বলি হয়েছেন বৃদ্ধ মহসিন। বাংলায় ভেঙে যাওয়া লক্ষ-কোটি পরিবারগুলোর মধ্যে বেঁচে আছে অসংখ্য মহসিন। মহসিনের মৃত্যুই আমাদের জানিয়ে গেল বাংলার দুই কোটি প্রবীণের অন্তর্জ্বালার কথা। অবশ্য যৌথ পরিবার ভাঙনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আকাশ সংস্কৃতির নীল ঢেউ। পশ্চিমা বিশ্বের পরিবারহীনতা ও পিতৃত্বের গুরুত্বহীনতা এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো একটি বিষয়। শহরায়ন, নগরায়ণ ও উচ্চাভিলাষী শিল্পায়ন যৌথ পরিবার ভাঙনের পথকে ত্বরান্বিত করেছে। অবশ্য এগুলো একটি দেশের সামাজিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনগুলোতে নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও যথাযথ পরিকল্পনাকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা দরকার। অন্যথায় দেশের মানুষগুলো নির্জীব জড় পদার্থে পরিণত হবে। মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা নামতে নামতে শূন্যের কোটায় চলে যাবে।

মহসিন খান ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। একসময় তার গাড়ি-বাড়ি সবই ছিল। তার সংসারটাও সুখে ভরপুর ছিল। তার সম্পদে ভাগ বসিয়ে অনেক বন্ধু সম্পদের পাহাড় গড়েছে। নিজের আত্মীয়-স্বজনরাও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে মহসিন বড়ই একা হয়ে পড়েছিলেন। মহসিনের একাকিত্বের সুযোগে অতি কাছের বন্ধুবান্ধব তার অর্থসম্পদ তছরুপ করেছিল। অযত্ন-অবহেলার আগুন মহসিনের ভেতরটা ঝলসে দিয়েছিল। মহসিন তার এই কষ্টের কথা কাউকে ব্যক্ত করতে পারেননি। মানসিক কষ্টে পীড়িত মহসিন দিনে দিনে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছেন। অবহেলিত মহসিনের কষ্টের কথা শোনার-বোঝার কেউ ছিল না। একজন মহসিনের আত্মহত্যা আমাদের অসংখ্য মহসিনের কষ্টের কথা জানিয়ে গেল।

ড. মো. কামরুজ্জামান : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

dr.knzaman@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম