শতফুল ফুটতে দাও
চালু হোক সর্বজনীন পেনশন স্কিম

ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অনেকের ধারণা অর্থনীতিতে ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থার প্রচলন পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্মেষের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বিবেচনায় ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থার বয়স ছয় থেকে সাতশ বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানবজাতি প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে অনেক ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়। যে ব্যবসা ঝুঁকির আত্তীকরণে ব্যর্থ হয় সেই ব্যবসা সাধারণত স্বল্পায়ু হয়।
‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ নামক গ্রন্থটি থেকে আমরা প্রাচীন বাণিজ্য সম্পর্কে ধারণা পাই। গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ৩-৪ হাজার বছর আগে। গ্রিক ব্যবসায়ীরা সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। জাহাজে বসে দৈনন্দিন ঘটনাবলির ওপর যে ডাইরি লেখা হতো, তাকে ভিত্তি করেই পেরিপ্লাস গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। এ গ্রন্থটি ১৯৩০ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় এবং শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস এ গ্রন্থটি প্রকাশ করে।
প্রাচীন বাণিজ্য সম্পর্কে গবেষণার জন্য এটি একটি মূল্যবান সহায়ক গ্রন্থ। গ্রিক নাবিকরা সমুদ্র বাণিজ্য করতে গিয়ে প্রায়ই নানা রকমের দুর্যোগের কবলে পড়ত। এসব দুর্যোগের মধ্যে বড় ধরনের দুর্যোগ ছিল সমুদ্র ঝড়। ঝড়ের কবলে পড়লে জাহাজটিকে হালকা করার জন্য কিছু মালপত্র সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো।
এ ব্যাপারে অবিশ্বাস কিংবা অনাস্থার কোনো অবকাশ ছিল না। ব্যবসায়ীরা জানত কোনো না কোনো ধরনের ঝড়ের কবলে জাহাজটি পড়তে পারে। বাণিজ্যযাত্রা শুরু করার আগে বণিকরা কে কোন ধরনের সামগ্রী জাহাজে উঠিয়ে দিচ্ছে এবং তার পরিমাণ কত সেটা লিপিবদ্ধ করা হতো। ঝড়ের কারণে যে কোনো বণিকেরই বাণিজ্যপণ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হতে পারে। এটা সব বণিকেরই জানা ছিল। সাদামাটা হিসাবে যে বণিকের পণ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হতো, তার মূল্যমান অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হতো। এরপর বণিকপ্রতি ক্ষতির অঙ্কটি গড় করে নির্ণয় করা হতো।
এভাবে ক্ষতির হিসাবের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বণিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হতো। আধুনিক পরিসংখ্যান বিদ্যায় গড়কে বলা হয় Average. গ্রিক ভাষায় এটাকে বলা হতো ‘হাভারিয়া’। হাভারিয়া শব্দটি থেকেই Average শব্দটির উৎপত্তি। এ বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, বহুকাল আগে থেকেই বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাবের মধ্যে ঝুঁকির হিসাব খুব গুরুত্ব পেত। আধুনিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইন্স্যুরেন্স একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
আধুনিক ধারণা অনুযায়ী ইন্স্যুরেন্স হলো এক ধরনের চুক্তির ব্যবহার, যার মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস করা হয় এবং বণ্টন করা হয়। একটি ইন্স্যুরেন্স চুক্তিতে ইন্সিউরার একটি সুনির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করে অথবা প্রিমিয়াম গ্রহণ করে। এ অর্থ পরিশোধের দায় ইন্স্যুরেন্সকারীর ওপর বর্তায়। লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা জীবনবিমার ক্ষেত্রে মৃত্যুকে লক্ষ্য করেই ইন্স্যুরেন্স করা হয়। ইন্স্যুরেন্সকারীর মৃত্যু ঘটলে তার পোষ্যরা জীবনবিমার অর্থ পায়। যদি অগ্নিকাণ্ড ও চুরির জন্য ইন্স্যুরেন্স করা হয়, তাহলে ইন্স্যুরেন্সকারী ক্ষতির পরিমাণ অনুযায়ী অর্থ দাবি করতে পারেন।
কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে তৃতীয় পক্ষও ক্ষতিপূরণের অর্থ দাবি করতে পারে। স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে যে ধরনের রোগের বিরুদ্ধে ইন্স্যুরেন্স করা হয়, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যয় ইন্স্যুরেন্সকারী পেতে পারে অথবা অসুস্থতাজনিত কারণে আয়-রোজগার করতে না পারলে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এ ক্ষতি পূরণ করে দেয়। প্রত্যেক ধরনের ইন্স্যুরেন্স চুক্তিতে যিনি ইন্স্যুরেন্স করেন তিনি আসলে এক ধরনের ক্ষতির বিপরীতে অন্য ধরনের ক্ষতি বিনিময় করেন।
ইন্স্যুরেন্স না করা হলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা বেশ কম। ইন্স্যুরেন্স করা হলে ছোট ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এটাই হলো প্রিমিয়াম। যিনি ইন্স্যুরেন্স করেন, তিনি বিপরীতমুখী বিনিময় করে নতুন ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করেন। কারণ তাকে প্রিমিয়াম দিতে হবে। ইন্স্যুরেন্সকারী ঝুঁকির মুখে এ ধরনের ক্ষতি স্বীকার করে নেন এ কারণে যে, তিনি ঝুঁকি নিরপেক্ষ। অথবা তিনি ঝুঁকি কম পছন্দ করেন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের জন্য ইন্স্যুরেন্স প্রথা চালু করার ব্যাপারে তার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের ইন্স্যুরেন্স প্রথা চালু আছে। যেমন, বেকার ভাতা এবং স্বাস্থ্যবিমা। বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের বিমার বৈশিষ্ট্য কী হবে তার জন্য যথেষ্ট চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যবহার গত ৫০ বছরে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিনিময় করতে গিয়ে অর্থের ব্যবহার তেমন একটা হয় না। মার্কস এ পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য দুটি চালচিত্র ব্যবহার করেছেন। এর একটি হলো C-M-C : অপরটি হলো M-C-M. এই চালচিত্র থেকে কী বোঝা যায়? প্রথমটি থেকে বোঝা যায় বিনিময় শুরু হয় পণ্য দিয়ে বা C দিয়ে। বাজারে বিক্রয়ের পর হাতে আসে টাকা বা M, এরপর এই টাকা বা M দিয়ে অন্য কোনো পণ্য ক্রয় করা হয়, বিক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী। দ্বিতীয় চালচিত্রে ব্যক্তি টাকা বা M দিয়ে বেচাকেনা শুরু করে। সে তার সঞ্চিত পুঁজি দিয়ে কিছু পণ্য বা C ক্রয় করে, তারপর এসব পণ্য প্রক্রিয়া করে অন্য ধরনের পণ্যে রূপান্তর করা হয়।
এরপর শিল্পজাত পণ্য হিসাবে এগুলো দেশ বা বিদেশের বাজারে বিক্রয় করা হয়। এই বিক্রেতার হাতে তখন অনেক টাকা বা M আসে। এই যে চালচিত্র, এর ওপর নির্ভর করেই অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরি করতে হয়। এছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে একটি বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। এ খাতের ব্যাপ্তি ও বিকাশের ধারা সঠিকভাবে স্টাডি করে নীতি-নির্ধারণ করতে হবে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করার ধারণাটি সামনে আনে। এ ছাড়া পরবর্তীকালে ২০০১ সালের নির্বাচনের মেনিফেস্টোতে এবং ২০৩০-এর ভিশন দলিলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করার উদ্যোগ নেয়নি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে বিভারিজ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে বেকার ভাতা এবং স্বাস্থ্যবিমা চালু করা হয়। সে সময় ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবির। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মানুষের মৌল চাহিদা পূরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। পুঁজিবাদী শিবিরও বুঝতে পারে কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে পুঁজিবাদী বা বাজার অর্থনীতি ব্যর্থ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথাক্রমে শিশু, কিশোর ও যুবক এবং মধ্যবয়সি, এছাড়া রয়েছে বার্ধক্যে উপনীত জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত জীবনের সময় বর্তমানে ৭৩ বছর। দেশে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশু এবং বৃদ্ধরা কোনো আয় রোজগার করে না। তারা পরিবারের অন্যদের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। শিশু ও বৃদ্ধরা এদেশে মূলত ভোক্তা। তবে কেউ কেউ বলতে পারেন, গ্রামাঞ্চলে এখনো শিশুশ্রম রয়েছে। শহরাঞ্চলেও শিশুশ্রম দেখা যায়। এর ফলে শিশুদের নিছক ভোক্তা বলা যায় না।
তবে শিশুদের ভোক্তা বৈশিষ্ট্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বয়োবৃদ্ধ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এ কাহিনিগুলো খুবই মর্মন্তুদ! অনেক পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দূরে রাখার কালচার প্রবলাকারে দেখা দিচ্ছে। বয়োবৃদ্ধদের সমস্যা আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। তাই এখন থেকে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি খাতে কেউ কেউ বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছেন। এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগগুলোকে টেকসই করার জন্য প্রয়োজন হবে বড় আকারের আর্থিক সমর্থন ও সহযোগিতা।
কর্মক্ষম বয়সের মানুষকে (১৯-৬০) একটি সর্বজনীন ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এরা সামর্থ্য অনুযায়ী একটি অঙ্কের প্রিমিয়াম ইন্স্যুরেন্স ফান্ডে জমা দেবেন। এর জন্য তারা কিছু মুনাফাও পাবেন। জমা দেওয়া অর্থ একটি বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এ থেকে সরকারও ঋণ গ্রহণ করতে পারে। ঋণ নেওয়া অর্থ অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারীরা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের জমা করা অর্থ থেকে প্রয়োজনে ঋণ করতে পারবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ রকম একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম জনসাধারণের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাবে।
সমস্যা হলো, দেশে সুশাসনের ভয়ানক রকমের ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি শুধু রাষ্ট্রীয় খাতের সমস্যা নয়, এটি ব্যক্তি খাতেরও সমস্যা। এদেশে যদি গ্রামীণ ব্যাংক সফল হতে পারে অথবা ব্র্যাক যদি সফল হতে পারে, তাহলে সর্বজনীন ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম কেন সফল হবে না? এই প্রতিষ্ঠানটির কল্যাণধর্মী চেহারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
তবে অন্তত একজন কর্ণধারের প্রয়োজন হবে যিনি পেনশন ফান্ডে অর্থজমাকারী ব্যক্তিদের স্বপ্নগুলোকে ধারণ করতে পারেন। সামগ্রিকভাবে ফান্ড ম্যানেজমেন্টের কুশলতা এবং সততা সাফল্যের চাবিকাঠি হিসাবে কাজ করবে। কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, দিনমজুর, সূত্রধরসহ সব ধরনের মানুষ এ স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সেজন্যই এটার পরিচয় হবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ