বাংলা ভাষা : অন্য আন্দোলন, অন্য শহিদেরা

পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

২১ ফেব্রুয়ারি যদি ১৯ মে তারিখকে মনে না পড়ায়, বা আড়ালে রাখে বাংলা ভাষা নিয়ে পুরুলিয়ার মানুষের আত্মদানকে, তবে আমাদের উদযাপন বৃথা। তাই ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ববঙ্গের ভাষাশহিদদের জন্য মাথানত করেও আমরা ফিরে আসি ভারতের সীমানায়-বাংলা ভাষার জন্য অন্য দুটি আন্দোলনের কথা একটু বলি। সে দুটিরও একই কারণ-এক ভাষার অন্য ভাষার ওপর অসংগত আধিপত্য। দুই জায়গাতেই বাংলাভাষী বিশাল গোষ্ঠী বাস করেছে ভূমিপুত্র হিসাবে এবং জন্ম থেকে বাংলা ভাষারই স্থানীয় একটা রূপ বলেছে। তাদের সঙ্গে এসে মিলেছে বাংলাভাষী অঞ্চল থেকে আসা এক বৃহৎ বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী। অনেকে জীবিকার সন্ধানে বা জীবিকার সূত্রে এসেছে। আসামে তো বাংলাভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে কৃষিকাজের জন্য ডেকে আনা হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে, ঘটনাচক্রে তারা ছিলেন মুসলমান। ত্রিপুরাতেও তা-ই ঘটেছিল, পূর্ববঙ্গের এক বৃহৎ কৃষক সম্প্রদায় গিয়ে ত্রিপুরায় সমতলের জমিতে সোনা ফলিয়েছে, কারণ ত্রিপুরার আদিবাসী মানুষেরা পাহাড়ের ঢালে ‘জুম’ চাষে যত অভ্যস্ত ছিলেন, সমতলের জমি চাষের কৃৎকৌশল তাদের তত জানা ছিল না। রাজারা তাদের স্বাধীনতার আগে আর পরে আমন্ত্রণ করেছেন। ফলে ত্রিপুরায় বঙ্গভাষী জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। সেখানকার উনিশটি ছোট আদিবাসী গোষ্ঠী তাতে কোনো বাধা দেয়নি, বরং নানা কারণে তাকে অভ্যর্থনাই করেছে। কিন্তু আসাম আর বিহার-ঝাড়খণ্ডের ইতিহাস অন্যরকম, নিজের নিজের মতো হলো কেন?
বরাক উপত্যকা
সময়ের হিসাবে এগিয়ে থাকে পুরুলিয়ার আন্দোলন। এর ব্যাপ্তি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু আমরা আসামের কথা দিয়েই শুরু করি। আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনেরও মোট দুটি পর্যায় : একটি প্রধান, সেটি ১৯৬০-১৯৬১ সালজুড়ে ব্যাপ্ত। আরেকটি তুলনায় সংক্ষিপ্ত, সেটির কাল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। দুটির পেছনেই ছিল বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্বন্ধে আসামবাসীদের মনে জাগিয়ে তোলা এক ভয় আর আশঙ্কার মনোভাব, যা মূলত রাজনীতির ইন্ধনে ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছিল।
পরে আমরা আসামের রাজনৈতিক নেতাদের বাংলা ভাষা সম্বন্ধে আতঙ্কের কারণ দেখব। কিন্তু ঘটনাটা হলো, ১৯৬০ সালে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অসমিয়াকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব নেয়। তা নির্বাধ হয়নি, কারণ বাঙালি কংগ্রেস সদস্যরা আপত্তি করেছিলেন। এপ্রিল মাসজুড়ে বাঙালিরা প্রতিবাদ করে, এবং এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতারাই দাঙ্গায় প্রচ্ছন্ন উসকানি দিতে থাকে। সে ইতিহাস আসামের আপামর বাঙালির স্মৃতিতে নথিবদ্ধ আছে। জুলাই আর সেপ্টেম্বরে আসামের কামরূপ আর গোরেশ্বর জেলায় হিংস্র দাঙ্গায় প্রচুর সম্পত্তি নষ্ট হয়, প্রায় নয়জন বাঙালির মৃত্যু ঘটে, এবং দেড় লাখের মতো বাঙালি পশ্চিমবঙ্গ ও বরাকে পালিয়ে যায়। তাতে তখনকার রাজনৈতিক নেতারা নিবৃত্ত হননি। ১৯৬০-এর ১০ অক্টোবর আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা একমাত্র অসমিয়াকে সরকারি ভাষা করার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব আনেন। উত্তর করিমগঞ্জের কংগ্রেসি বিধায়ক প্রতিবাদ করেন, কিন্তু ২৪ অক্টোবর এ প্রস্তাব বিধান সভায় সংখ্যাধিক্যের ভোটে গৃহীত হওয়ায় আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে।
আসামের বরাক উপত্যকায়, যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ বাঙালি ও অন্-অসমিয়াভাষী (মণিপুরি, বোডো, নেপালি ইত্যাদি) মানুষের বাস, সেখানে এপ্রিলে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদ ২৪ এপ্রিল ‘সংকল্প দিবস’ পালন করে, এবং ২৪ এপ্রিল সত্যাগ্রহ আর পদযাত্রার কার্যক্রমে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দিতে অসংখ্য মানুষ প্রায় একশ মাইল পরিক্রমা করেন। আরও অজস্র স্থানে প্রতীকী পদযাত্রা চলে। ২ মে শিলচরে কেন্দ্রীয় পদযাত্রার একটা পর্ব শেষ হয়। তার বিশাল সমাবেশে পরবর্তী ১৯ মে সর্বাত্মক হরতালের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারও প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে তৈরি হতে থাকে এবং ১৮ মার্চ শিলচরে আসাম রাইফেল্স, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট আর কেন্দ্রীয় সরকারের রিজার্ভ পুলিশ শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করে বাঙালিদের ভয় দেখানোর জন্য। অন্যদিকে এ প্রতিবাদ আন্দোলনের তিন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন আর ‘যুগশক্তি’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। আসামের অসমিয়া জনগোষ্ঠীর কাছে শিলচরের বাঙালিদের [যাদের মধ্যে উদ্বাস্তু বা ‘ভগনিযা’ (ভেগে আসা) বাঙালিরাও ছিলেন] দেশদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, পাকিস্তানিদের হাতের পুতুল ইত্যাদি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু অনিবার্যকে রোধ করা সম্ভব হয় না। ১৯ মে সকাল থেকে সরকারি অফিস-আদালত আর শিলচর স্টেশনে পিকেটিং চলে; শোনা যায়, ট্রেনের টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল স্টেশনে। বেলা আড়াইটা নাগাদ একটি ট্রাকে পুলিশ কাটিগোরা থেকে নয়জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করে স্টেশনের কাছ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় পিকেটাররা উত্তেজিত হয়ে বাধা দেয়। ট্রাকটি নিয়ে পুলিশ পালিয়ে যেতে পেরেছিল, কিন্তু অজ্ঞাতপরিচয় কিছু লোক ট্রাকটিতে নাকি আগুন ধরিয়ে দেয়। সে আগুন নিভিয়েও ফেলা হয়। কিন্তু শিলচর স্টেশনের সত্যাগ্রহীদের ওপর প্যারামিলিটারি বাহিনী সাত মিনিটে সতেরো রাউন্ড গুলি ছোড়ে, তাতে ১১ জনের মৃত্যু হয়; তার মধ্যে একটি ছিল কিশোরী, কমলা ভট্টাচার্য, স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। বাকিরা হলেন কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্রকুমার পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকান্ত পুরকায়স্থ। এই সেই একাদশ শহিদ। পাঠকদের মনে থাকতে পারে, ওই বছরটিতে সারা পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান চলছিল। ওই সময় আসামে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ নেমে এলো, এ হয়তো নিছক আপতন। যাই হোক, এর পরিণামে আসাম সরকারকে পশ্চাদপসরণ করতে হলো। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সহযোগী সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান করতে হলো। শিলচর স্টেশনের নাম ভাষাশহিদ স্টেশন করার দাবি উঠেছে, তা এখনো পূরণ করা হয়নি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষা আক্রান্ত হয়েছিল ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে। আসামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৬১-র ওই পরাজয় হয়তো সহজে মেনে নিতে পারেননি, তাই কয়েক বছর পর, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ১৬ মে, ১৯৬৮ সালে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রি-ইউনিভার্সিটি স্তরের পড়াশোনায় ১৯৭২-৭৩ থেকে শুধু ইংরেজি আর অসমিয়াতে পড়ানো হবে। তাতে বাংলায় উত্তর দেওয়ার অধিকার ছিল। কিন্তু পড়ানো হবে ইংরেজি আর অসমিয়াতে। এর বিরুদ্ধে বঙ্গভাষী জনমত আবার উত্তাল হয়ে ওঠে, কারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আসামের বাঙালি প্রতিনিধিরা-মইনুল হক চৌধুরী, মহীতোষ পুরকায়স্থ প্রমুখ মিলিত হয়ে প্রতিবাদসভা করেন, আন্দোলনের সংকল্পও নেন। প্রতিবাদে মনে হয় গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেদ বেড়ে যায়, এবং ১৯৭২-এর ৬ জুন এক প্রস্তাবে বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়। রাজ্য সরকারও বলল, কাছাড়ে বাংলাভাষীদেরও অসমিয়া ভাষার পাঠ বাধ্যতামূলক হবে। কংগ্রেসের মন্ত্রীরা দলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শিলচর পৌরসভার সভাপতি দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত প্রমুখের উদ্যাগে ১৮ জুনের এক সভায় বরাক উপত্যকাজুড়ে আবার ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। নানা মতানৈক্য সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পরিষদের পুনরুজ্জীবন ঘটে, এবং তার কর্মসূচিতে সত্যাগ্রহ আবার গুরুত্ব পায়। ১২ আগস্ট করিমগঞ্জ ফৌজদারি আদালতের সামনে বসে থাকা সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও নানা নির্যাতন করে। প্রতিবাদে ১৪ আগস্ট সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। কংগ্রেস এ হরতালের বিপক্ষে প্রচার করে। ওই ১৪ আগস্ট করিমগঞ্জের পূর্ত বিভাগের কার্যালয়ের সামনে পিকেটিংকে কেন্দ্র করে হরতালবিরোধী দল পিকেটারদের ওপর চড়াও হয়। সংগ্রাম পরিষদের যুব নেতা বিজন চক্রবর্তীকে দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করে, এবং ১৬ আগস্ট বিজন বা বাচ্চু চক্রবর্তী ভাষা আন্দোলনের দ্বাদশ শহিদ হন। এটা হয়তো বলা যায় যে, তিনি রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিহত হননি, প্রাণ দেন হরতালবিরোধীদের হাতে। এরপরও মণিপুরি ভাষার জন্য আসামে শহিদ হয় সুদেষ্ণা সিংহ বলে একটি মণিপুরি কিশোরী। বাংলা ভাষার এই দ্বিতীয় আন্দোলনে শিলচরে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি ওঠে। তা পূরণ হয় ১৯৯৪ সালে।
আসামের পক্ষে কি কিছু বলার আছে? পক্ষে না বিপক্ষে তা আপনারা বিচার করবেন। আমরা ভাষার অবদমন বা মানুষকে হত্যা কোনোভাবেই সমর্থন করি না, বরং দ্ব্যর্থহীন ধিক্কার জানাই। এবং ভাষার জন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তৈরি করে মানবহত্যা এক ক্ষমাহীন অপরাধ। তবু পটভূমি নির্মাণের জন্য এই কথাগুলো বলা দরকার বলে মনে করি।
আসাম প্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন, সেসব বাঙালি বিষয়টি বুঝবেন আশা করি। স্বাধীনতার পর যে আসাম প্রদেশ ছিল; আমরা জানি, আজকের আসাম সেই প্রদেশ একেবারেই নয়। রাজ্য হিসাবে আসামের মধ্যে একটা সাংগঠনিক অনিশ্চয়তা ইতিহাসের দান। এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চারটি রাজ্য-অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মিজোরাম আর নাগাল্যান্ড এক সময় বৃহত্তর আসাম প্রদেশের অন্তর্গত ছিল; স্বাধীনতার পর একে একে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আসামের ভৌগোলিক সীমা আর রাজনৈতিক গুরুত্ব সংকুচিত হয়েছে। সেটা অসমিয়াদের কাছে নিশ্চয় একটা কষ্টের কারণ, যদিও আলাদা রাজ্যগুলোর গঠনের যুক্তি খুবই স্পষ্ট। আবার স্বাধীনতার আগেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা বৃহত্তর আসামকেও তত গুরুত্ব দেয়নি। তা এক সময় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশ ছিল, পরে বঙ্গভঙ্গের সময়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়, যদিও আন্দোলনের ফলে তা প্রত্যাহার করা হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, বার্মার যুদ্ধ জিতে ইংরেজ কোম্পানি ১৮৩৬ সাল থেকে বাংলা ভাষাকে আসামের সরকারি আর শিক্ষার ভাষা করে দেয়। তাতে বাঙালিদের যে কোনো ভূমিকা ছিল না সে কথা অসমিয়া গবেষকরাই বলেছেন; ইংরেজ আমলারাই তা করে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ একটা ভুল করেন, তিনি ১৩০৫ সালে ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব) বলে একটি প্রবন্ধ লিখে ওডিয়া আর অসমিয়াকে বাংলার উপভাষা হিসাবে দাবি করেন, যে দাবি ভুল ও অন্যায্য। তাতে ঠাকুরবাড়ির জামাই লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া সংগতভাবেই প্রতিবাদ করেন, এবং রবীন্দ্রনাথ পরে এ প্রতিবাদ মেনেও নেন; কিন্তু তা অসমিয়াদের সন্ত্রস্ত করে তোলে। ফলে বাংলা ভাষা সম্বন্ধে অসমিয়া বুদ্ধিজীবীদের ভালোবাসার সঙ্গে কিছুটা ভয়ও তৈরি হয়ে যায়। রাজনীতির লোকেরা তাই নিয়ে রাজনৈতিক শস্য তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সিলেট জেলাকে গণভোট বা রেফারেন্ডামের নামে (১৯৪৭) পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রে ঠেলে দেওয়ার পেছনেও এ আতঙ্ক কাজ করেছে বললে অত্যুক্তি হয় না।
এ পটভূমিটি মনে রাখলে আসামে বাংলা ভাষা আর বাঙালিদের নিগ্রহের পশ্চাৎপটটি কিছুটা স্পষ্ট হবে।
মানভূম, পুরুলিয়া
একটি প্রধান ভাষার মানুষ যদি নিজের একটি রাজ্যের বাইরেও অন্য রাজ্যে ছড়িয়ে থাকে, তাহলে অন্য রাজ্যে তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে এবং তাদের ভাষার অধিকার নানা কারণে খর্ব হয়, তাদের ভাষাকে অন্য ভাষার আধিপত্য সহ্য করতে হয়। তা প্রায়শই ঘটে যখন শাসকের খেয়ালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য না হয়ে শাসকের নানা খেয়ালে রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যেমন হয়েছিল।
আপনারা জানেন, পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই ব্রিটিশ শাসনের প্রথম ভাগে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা একটিই প্রদেশ ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নামে। ১৯১২ তে দিল্লির দরবারের পর বাংলা আলাদা হয়, কিন্তু বিহার-উড়িষ্যা একটি প্রদেশ হিসাবে চালু থাকে। ১৯৩৬-এ বিহার আর ওড়িশা (এখন ওডিশা) বিচ্ছিন্ন হয়। এ ক্রমবিভাজন সত্ত্বেও দুটি প্রদেশেই বাংলাভাষীর সংখ্যা, আসলে ভূমিপুত্রের সংখ্যা প্রচুর থেকে যায়, বিশেষত বিহারের মানভুম জেলায়। তারপর, ২০০০ সালে, বিহারের দক্ষিণাংশ নিয়ে ঝাড়খণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে বাংলা আর বিহারের সংযুক্তির একটি প্রস্তাব করেছিলেন প্রয়াত বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু এ প্রস্তাব নিয়ে ওই সময়কার একটি বিশেষ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় তিনি আর এ বিষয়ে অগ্রসর হতে পারেননি।
আমরা সেই সময়ের কথা বলছি, যখন ঝাড়খণ্ডের অস্তিত্ব ছিল না। প্রচুর বাংলাভাষী ছিলেন বিহারের মানভূম জেলায়, এবং তারা নিজেদের ভাষার ভৌগোলিক অধিকার চেয়ে স্বাধীনতার আগে থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এদিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসও ১৯২০ সাল থেকেই ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশগুলোর প্রশাসনিক পুনর্গঠনের বিষয়ে প্রস্তাব নেয়, ১৯২৭ সালে এর উদ্যোগ নিতে বলে, ১৯৩৭ সালে কলকাতায় আর ১৯৩৮ সালে ওয়ার্ধাতে তার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে নিযুক্ত দার কমিশন এ বিষয়ে ধীরগতিতে চলার পরামর্শ দেয়। ১৯৪৮ সালে কংগ্রেস নিযুক্ত নেহরু, প্যাটেল আর পট্টভি সীতারামাইয়ার জেভিপি কমিটি সিদ্ধান্ত করে যে, জাতীয় নিরাপত্তা আর উন্নয়ন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, রাজ্য পুনর্গঠন নয়। এর ফলে বিহারের বাঙালিরা হতাশ হন, রাজ্যের কংগ্রেস প্রশাসন উদাসীন থাকে। এ অবস্থায় কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে অতুলচন্দ্র ঘোষ আর তার সঙ্গীরা ৩০ জুন তারিখে লোকসেবক সংঘ গঠন করেন; বিহারের বাঙালি হয়ে এ দাবিটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান। কংগ্রেসবিরোধী বামপন্থি এবং অন্যান্য দল তাদের পূর্ণ সমর্থন দেয়। লোকসেবক সংঘের পেছনে বিপুল জনসমর্থন এবং রাজনৈতিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিহার সরকার দীর্ঘদিন এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে এবং আন্দোলনের দাবিগুলোকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে এক ধরনের ভাষা-সন্ত্রাসও শুরু করে। যেমন ধানবাদের রেজিস্ট্রি অফিস এতদিনের প্রথা অগ্রাহ্য করে ২৯ আগস্ট বাংলা ভাষায় দলিল রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকার করে, এবং ঝরিয়ার দেশবন্ধু সিনেমা হলে সিনেমার বিশ্রামের সময় হিন্দি আর ইংরেজিতে হিন্দি মানভূমের মাতৃভাষা-এই স্লাইড দেখানো হতে থাকে। এ ধরনের অরাজকতার প্রতিবাদে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে পরের বছর ৬ এপ্রিল থেকে লোকসেবক সংঘের সত্যাগ্রহ শুরু হয়ে যায়। জেল থেকে কুখ্যাত গুণ্ডাদের ছেড়ে দিয়ে পুলিশ আর গুণ্ডাদের একযোগে তাদের ওপর বিহার সরকার লেলিয়ে দেয়, অতুলবাবুর স্ত্রী আর তার যোগ্য সহধর্মিণী লাবণ্যপ্রভা ঘোষের চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর পর লোকসেবক সংঘের সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলন আর বিহার সরকারের নির্যাতন একসঙ্গে চলতে থাকে। যেমন, ১৯৫১ সালের ২৫ এপ্রিল অনুগ্রহনারায়ণ সিংহের এক সভায় কমিউনিস্ট, ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি নেতাকর্মীদের পুলিশ লাঠিপেটা করে। ১৯৫১ সালের লোকগণনায় মানভূমকে হিন্দিভাষী জেলা হিসাবে নথিভুক্ত করতে বিহার সরকার উদ্যোগী হয়, সেই সঙ্গে মানভূমের বাঙালিদের ওপর দমনপীড়ন চলতেই থাকে।
এর মধ্যে আন্দোলনের আরও নানা কারণ তৈরি হয়ে যায়। মানভূমের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে শাসকদের অক্ষমতায়। ফলে শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভার নেতৃত্বে কর্ডন ভেঙে জনসাধারণ খাদ্যের ক্রয়-বিক্রয় আর সরবরাহ নির্বাধ রাখতে এগিয়ে আসে। সরকার নানা কর বসিয়ে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। ১৯৫৪ সাল নাগাদ আবার সত্যাগ্রহ শুরু হলে অতুলচন্দ্র গ্রেফতার হন, কিন্তু সত্যাগ্রহ থামে না। কংগ্রেস দল হিন্দির পক্ষ নিয়ে ভীতি প্রদর্শন শুরু করে এবং কিছু বাঙালিকে দিয়ে ‘বিহার মে রহেঙ্গে’ নামে একটি পালটা আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করে। দু-বছরের মাথায় হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় আর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ বাংলা-বিহারের সংযুক্তি বা ‘মার্জার’-এর এক কিম্ভূত প্রস্তাব প্রচার করেন (২৩ জানুযারি, ১৯৫৬)। বিহার আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়, এবং লোকসেবক সংঘ ও বামপন্থিরা নতুন আন্দোলন গড়ে তোলে। এ প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতায় একটি নির্বাচন হয়, তাতে বামপন্থি প্রার্থী মোহিত মৈত্রের কাছে বিপুলভাবে পরাজিত হওয়ার পর ওই প্রস্তাবের সমাধি ঘটে।
লোকসেবক সংঘের আন্দোলন ‘মাতৃভাষা ও বাংলার অধিকার রক্ষা কমিটি’র দায়িত্বে ‘বঙ্গ সত্যাগ্রহ’ পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়, জনসাধারণের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায়। অবশেষে ওই বছর রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন পুরুলিয়ায় আসে, এবং কংগ্রেস ছাড়া সব দল আর বিভিন্ন জনসংগঠনের সঙ্গে লোকসেবক সংঘও কমিশনকে বাংলাভাষী এলাকা পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে স্মারকলিপি দেয়। কমিশন নানা অজুহাত দেখিয়ে টাটা কোম্পানির জামশেদপুরকে বিহারে রাখল, এবং মানভূমকে টুকরো করে একটা কম বিতর্কিত অংশকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করা হলো। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিহারের মানভূমের পুরুলিয়া সদরসহ ১৬টি থানা আর পূর্ণিয়ার কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় পরিণত হলো।
সুখের বিষয়, মানভূমের আন্দোলনে কাউকে শহিদ হতে হয়নি। কিন্তু সত্যাগ্রহীরা যে দীর্ঘদিন ধরে নানারকম রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সন্ত্রাস সহ্য করেছেন, সেও এক গৌরবের ইতিহাস।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা