Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আবু মহসিনের আত্মাহুতি এবং আমাদের সামাজিক অবক্ষয়

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবু মহসিনের আত্মাহুতি এবং আমাদের সামাজিক অবক্ষয়

একজন আবু মহসিনের আত্মাহুতি এ সমাজকে যেন আবার নতুন করে নাড়া দিয়ে গেল। এ মৃত্যু আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়াবহ অশনিসংকেত। প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর ঘটনাটি ঝড় তুলেছে। দেশের ঘরেবাইরে সর্বত্র এ মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরকম কত অস্বাভাবিক মৃত্যুই তো প্রতিদিন দেশের শহর, নগর বন্দরের আনাচে-কানাচে ঘটছে; কিন্তু ক’জনই বা এসব মৃত্যু নিয়ে কথা বলে, মাথা ঘামায় বা পত্রপত্রিকায় বক্তব্য-বিবৃতি দেয়? কিন্তু জনাব মহসিনের মৃত্যুটা একটু ব্যতিক্রমী এজন্য যে, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, সমাজে তার একটা অবস্থান ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে লাইভে এসে তার একাকিত্ব, নিঃসঙ্গ জীবনের কথা, পরিবারের অবহেলা-অনাদর, কাছের মানুষদের দ্বারা প্রতারিত হওয়াসহ তার হতাশায় নিমজ্জিত জীবনের কথা বলে পৃথিবীর সব মানুষকে জানান দিয়ে গেলেন-অর্থসম্পদ, স্নেহ, ভালোবাসা, স্ত্রী, সন্তান কিংবা পরিবার একটা সময়ে এসে অর্থহীন হয়ে যায়। কোটি কোটি টাকা, গাড়ি বাড়ি, সুপ্রতিষ্ঠিত সন্তান সবই মূল্যহীন। জীবনের একটা সময়ে এসে তিনি এতটাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, বিষণ্নতায় ভোগেন যে, শেষ পর্যন্ত এ সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে আত্মহননের মতো জঘন্য এবং পাপের পথটি বেছে নিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির সৌজন্যে সারা পৃথিবীর মানুষ জেনে গেল, দেশের প্রবীণ তথা বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের বা অবক্ষয়ের কথা।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি উন্নত মানসম্মত জীবনের লক্ষ্যে। আধুনিক প্রযুক্তিগত মানসম্পন্ন জীবন আমাদের জীবনধারাকে প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে। প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ; কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে আমাদের আবেগ, স্নেহ, আদর ভালোবাসা নামক হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো। যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরাও যান্ত্রিক হয়ে গেছি এবং যাচ্ছি। এর শেষ কোথায় জানি না। মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধনগুলো। স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে একবারও ভেবে দেখছি না। ভাবার সময় কোথায়? যে বাবা, মা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়ে-পরিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য দিবানিশি ছুটেছেন এবং ছুটছেন অহরহ, সেই সন্তানরাই বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের দেখভাল করছে না। তারা নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন, নাম, যশ, খ্যাতি; সর্বোপরি প্রাচুর্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের খোঁজখবর নেওয়ার মতো সময়, মানসিকতা, ভালোবাসা নামক অনুভূতিগুলো বা মানবিক দিকগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য এজন্য শুধু সন্তানদের ওপর দোষ চাপালে অন্যায় হবে। বাবা-মাও এজন্য দায়ী। সেইসঙ্গে শিক্ষক সমাজও। কারণ তারা সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন না। সন্তান বা ছাত্রদের লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, ভদ্রতা, নম্রতা এক কথায় মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সমাজের সর্বত্রই চলছে অসুস্থ ও অসম প্রতিযোগিতা। শুধু একটা ভালো রেজাল্ট, একটা সার্টিফিকেটই যেন জীবনের সব। ভালো একটা চাকরি, সেই সঙ্গে চটজলদি গাড়িবাড়ির মালিক হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই যেন জীবনের মূল লক্ষ্য। এ ছাড়াও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে যথেষ্ট গলদ। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই গাদা গাদা বই চাপিয়ে দেওয়া হয় ছোট ছোট শিশুদের। যে শিশু ভালো করে হাঁটতেই পারে না, তার পিঠে উঠে বইয়ের বোঝা। শুধু তাই নয়, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে উন্নত মানসম্পন্ন বই পড়া থেকেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। লাইব্রেরিতে ছেলেমেয়েদের খুব কম দেখা যায়।

স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ শিক্ষক কত কম পড়িয়ে কত বেশি টাকা রোজগার করা যায়, সেই মানসিকতা নিয়ে অর্থাৎ বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে পড়ান। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশ্নপত্র অহরহ ফাঁস হচ্ছে আর সেই ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র চড়া মূল্য দিয়ে অনেক অভিভাবক ক্রয় করেন। এসব সন্তান কি শিখবে? জীবনের শুরুতেই তো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত হলো। আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কত শ্রদ্ধা আর সম্মান করতাম। শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের কত স্নেহ আদর করতেন। বাবা-মায়ের পরেই শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন শিক্ষক। অথচ এখন সেই শিক্ষক এবং ছাত্রদের সম্পর্কের কত অবনতি হয়েছে, সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়াও অভিভাবকরা উন্নত আর নিশ্চিত জীবনের আশায় মরিয়া হয়ে সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠাচ্ছেন। ফলে পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বেড়ে যাচ্ছে। শুধু দেশের বাইরে গেলেই যে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, তা নয়। দেশে থেকেও তারা যৌথ পরিবারে বা বাবা-মা-ভাইবোনসহ সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে পছন্দ করছে না। ফলে বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন কাটাতে হচ্ছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান মহসিন খানের মৃত্যুতে তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘বয়স্কদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।’ মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের সমাজে প্রবীণ জনগোষ্ঠী কতটা অবহেলা আর নির্যাতনের শিকার। প্রবীণরা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত অবহেলা-নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রতি বছর ১৫ জুন ‘প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস’ পালিত হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রবীণের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এটি সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কতটা প্রস্তুত? তিনি বয়স্ক ভাতার কথা বলেছেন, কিন্তু কত টাকা দেওয়া হচ্ছে? দুর্মূল্যের বাজারে এ টাকা দিয়ে একটা পরিবার কিভাবে চলে? দুস্থ, দরিদ্র প্রবীণ ছাড়াও দেশে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী অনেক প্রবীণ রয়েছেন; তারা কিভাবে অসহনীয় দুর্মূল্যের এ বাজারে তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করছেন, সে খবর ক’জন রাখেন?

জীবনের শেষ সঞ্চয় দিয়ে যারা সঞ্চয়পত্র কিনে সেই মুনাফা দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করেন, সেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফাও কেটে রাখা হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, বহু আবেদন-নিবেদন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সরকার জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা এবং পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ আট বছরেও এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মহসিন খানের মৃত্যু কিছুটা হলেও যদি এ সমাজ বা রাষ্ট্রকে নাড়া দিয়ে থাকে; তাহলে আর দেরি না করে আসছে বাজেটে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দসহ প্রবীণ নীতিমালা ও পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।

মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক; নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান

monjuara2006@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম