Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

জাতীয় পুরস্কারগুলোর জন্য দরখাস্ত করতে হয় কেন?

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় পুরস্কারগুলোর জন্য দরখাস্ত করতে হয় কেন?

আমাদের শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার দুটি। স্বাধীনতা পুরস্কার এবং একুশে পুরস্কার। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য পুরস্কার আছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কিছু যোগ্য লোক এ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও বাংলা একাডেমি পুরস্কারটি ছিল এবং অনেক যোগ্য বুদ্ধিজীবী তা পেয়েছেন। এ পুরস্কারদানের ব্যাপারে স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর ধরে একটা আন্তর্জাতিক রীতি মানা হয়েছে। তখন দরখাস্ত করে পুরস্কার পাওয়া যেত না। দেশের কিছু ধীমান ব্যক্তিত্ব এ পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করতেন। রাম-শ্যাম, যদু-মধু সবাই এ পুরস্কার লাভের জন্য দরখাস্ত করতে পারত না।

নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য কেউ দরখাস্ত করে না। কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে এ নোবেল পুরস্কার দিতে হলে আরও কিছু যোগ্য লোক তার নাম প্রস্তাব করেন। নোবেল কমিটি এ প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করে পুরস্কারগুলো দেন। ‘স্যার’ টাইটেল পাওয়ার জন্য বা রানির জন্মদিনের টাইটেল দেওয়ার জন্য দরখাস্তের কোনো পদ্ধতি নেই। সরকার বিবেচনা করে কাদের টাইটেল দেওয়া হবে।

গভর্নর মোনায়েম খানের আমলে আমি বাংলা একাডেমি পদক পেয়েছি। এরশাদের আমলে একুশে পদক পেয়েছি। হাসিনা সরকারের আমলে পেয়েছি স্বাধীনতা পুরস্কার। কোথাও আমাকে দরখাস্ত করতে হয়নি। আমি জানতামও না আমাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। আমাকে সরকারি তরফে জানানো হয়েছে। এরশাদের আমলে আমাকে একুশে পদক দেওয়া হয়। আমি প্রথমে তা নিতে অস্বীকার করেছিলাম। সে বছর সম্ভবত আবু জাফর শামসুদ্দিন এবং শওকত ওসমান একুশে পদক পেয়েছিলেন। আমার প্রত্যাখ্যানের কথা জেনে তারা আমাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, আমি যেন পুরস্কারটি নেই। তা না হলে কোনো রাজাকার হয়তো পুরস্কারটি নেবে। আমি পুরস্কারটি নিতে রাজি হই। আমার পুরস্কার নেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানানোর কারণ-জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়ার আমলে শর্ষিণার মওলানাসহ এতসব রাজাকারকে এ পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে যে, এই পুরস্কার দুটির গুরুত্ব আমার কাছে আর নেই। তবু স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ করেছি শেখ হাসিনার অনুরোধে।

প্রায় ৪০ বছর আমি দেশে নেই। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দেশের জাতীয় পুরস্কারগুলো দেওয়ার পদ্ধতি যে পরিবর্তন হয়ে গেছে, তা আমি জানতাম না। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আগের পদ্ধতি কে পরিবর্তন করলেন? সম্ভবত জিয়াউর রহমানই করেছিলেন। তিনি দেশের ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করে গেছেন। জাতীয় রাজনীতিকে চরিত্রহীন করেছেন। সুতরাং দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কলুষিত করবেন তাতে আর বিস্মিত হওয়ার কী আছে!

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের সংবিধানকে কিছুটা বিকৃতিমুক্ত করেছে। দেশের উচ্চ আদালত জিয়া ও এরশাদের আমলের অনেক ব্যবস্থার সংস্কার করেছেন। কিন্তু জাতীয় পুরস্কার প্রদানে কী করে দরখাস্ত করার নিয়মটি বহাল রয়ে গেল তা জানি না। শেখ হাসিনা নিজে একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। তার চারপাশে মোনায়েম সরকার, নূহ-উল আলম লেনিন, মতিয়া চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী ছাড়াও প্রবীণদের মধ্যে কবির চৌধুরী এবং আরও অনেকে ছিলেন। তারা কি সরকারকে পরামর্শ দেননি এ একুশে ও স্বাধীনতা পুরস্কারদানের ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করার?

আমি লন্ডনে বসে কয়েক বছর ধরে বিস্মিত হয়ে দেখেছি, আমার কাছে একুশে পুরস্কার ও স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার জন্য অসংখ্য ব্যক্তি এসে ভিড় জমান। তাদের আবেদন ফরমে আমার স্বাক্ষর পাওয়ার জন্য। আবেদন ফরমে আবেদনকারী যে একজন যোগ্য সংস্কৃতিসেবী, তার প্রমাণ হিসাবে আগের পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একজনকে সই করতে হয়। আমি আগের পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাই তারা আমার কাছে ভিড় করেছেন। আমি তাদের কয়েকজনকেই বলেছি, জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে দরখাস্ত করা একজন সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে আত্মসম্মান হানিকর। আমি যে একজন যোগ্য সংস্কৃতিসেবী, তা প্রমাণের জন্য আরেকজন সাক্ষী জোগাড় করে দরখাস্ত করতে হবে, এটা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো সংস্কৃতিসেবীই করবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে এ দরখাস্ত করার ধুম পড়ে গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমলাদের কাছে এ দরখাস্ত পেশ করতে হয়। তারপর এ দরখাস্তকারীদের তালিকা হয়তো প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়। তিনি একটি-দুটি নাম হয়তো পরিবর্তন করেন। তারপর আমলাদের মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকায় তার সম্মতির সই দিয়ে দেন।

এবারেও এ তালিকা দেখলাম। এক আমলা কবি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে একটি মাত্র কবিতা পাঠের সুযোগ নিয়ে তার নিজের কবিতাটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর, কবি জসীমউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল। তাদের কারও কবিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পঠিত হলো না, পঠিত হলো ওই অনুষ্ঠানের কর্মকর্তা এক আমলা কবির।

আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর কোনো মান থাকে না। আমলাদের তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত নিচু মানের অনুষ্ঠান হয়। শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক বিরাট সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। আমি তখন ঢাকায় এবং প্রধানমন্ত্রী দয়া করে সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি অসুস্থ হলেও হুইল চেয়ারে বসে সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান বাসভবনের পেছনে এক বিশাল মাঠে শামিয়ানা টানিয়ে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্টজন এবং বিদেশি কূটনীতিকদেরও আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমি যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হলো। গ্রাম্য বাংলায় একজন ঘোষণা করলেন, এখন গান শুরু হবে। আমি অবাক হয়ে শুনলাম, ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’। এ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। এরপরের গানগুলোর কথা আর লিখলাম না। এক বিদেশি কূটনীতিক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইজ ইট ইওর ন্যাশনাল সঙ?’ আমি তার হাত চেপে ধরে বললাম, ‘প্লিজ স্যার, ডোন্ট থিঙ্ক ইট ইজ আওয়ার ন্যাশনাল সঙ। ইট ইজ অনলি এ পপুলার সঙ।’ তিনি আমার জবাব শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। আমার প্রশ্ন, কারা এসব করেন? আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে এখন এমন কোনো সংস্কৃতিসেবী নেই, যিনি সরকারি অনুষ্ঠানের মান বোঝেন এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন?

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির মান যেন ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালে প্রায়ই প্রবীণ ও নবীন সংস্কৃতিসেবীদের নিয়ে বৈঠকে বসতেন। তাদের মধ্যে থাকতেন জসীমউদ্দীন, কবির চৌধুরী, ড. কুদরত-ই-খুদা, ড. দীন মোহাম্মদ প্রমুখ। শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে আলোচনার জন্য তিনি তার নিজের শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখন পরামর্শ গ্রহণের জন্য সাংবাদিক তোয়াব খান এবং আমাকেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি রাজাকার নেতাদের সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার ব্যাপারে অসম্মতি জানালে তিনি আমার ওপর বিরক্ত হননি।

একুশে পদকের কথায় আসি। এবার যারা পদক পেয়েছেন, তাদের তালিকাটি দেখে মনে হয়েছে, এ নামগুলোর অধিকাংশকেই আমি চিনি না, জানি না। দরখাস্ত করে এবং আমলাদের খুশি করে অনেক অযোগ্য ব্যক্তি জাতীয় পুরস্কারগুলো পাচ্ছেন কিনা আমি জানি না। যারা পেতে পারেন, তাদের অনেকেই এখন অবজ্ঞাত হয়ে আছেন। কারণ তারা আমি ‘সাহিত্যিক বা শিল্পী’ এই দাবি করে দরখাস্ত করাটা আত্মমর্যাদার হানিকর মনে করেন। আমার এক বন্ধু লন্ডনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন পেয়েছেন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে। তিনি রানির জন্মদিনে উচ্চ খেতাব পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিশোর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন। তিন বছর ধরে তিনি চেষ্টা করেছেন স্বাধীনতা পদক পাওয়ার জন্য। বারবারই আমি তার দরখাস্তে সই করেছি। তিনি পদক পাননি। তাকে এক আমলাকে ৫০ হাজার টাকা ঘুস দিয়ে এ পদক পেতে হয়েছে। এটা কি একটি মাত্র ঘটনা? না, এই ঘুস পদ্ধতি আরও কত বিস্তার লাভ করেছে, তা কে বলবে! মুক্তিযোদ্ধাদেরও এখন দরখাস্ত করে তিনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা প্রমাণ করতে হয়। লজ্জায় মাথা নত হয়।

ব্রিটেনে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন ভ্যাটার্নদের সম্মানিত করা হয়। সেনা বিভাগ তাদের তালিকা প্রস্তুত করে। তাদের দরখাস্ত করতে হয় না। এবার দেখলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের মধ্যে কারা মুক্তিযোদ্ধা তা প্রমাণ করার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হলে তারা সার্টিফিকেট ও মাসিক ভাতা পাবেন। এতে কারা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা তা নিয়ে রীতিমতো মারামারি শুরু হয়েছিল। এখানেও মুক্তিযোদ্ধা কারা তা নির্ণয় করবেন দরখাস্ত পাওয়ার পর আমলারা।

আমলা শাসনে দেশ উন্নত হতে পারে না। রাজনীতিকরা যতই শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হোন, তারা জনপ্রতিনিধি। তারা জনগণের মনের কথা জানেন। আমলারা সেই মনের কথা জানেন না। তারা উচ্চ সিভিল সার্ভিসের শিক্ষা নিতে গিয়ে ঘোড়ায় চড়েন। সেই ঘোড়ায় চড়াটাই তারা জানেন। নেহরু একবার সম্ভবত রাজস্থানের চিফ সেক্রেটারিকে ডেকে বলেছিলেন, আপনি যতই শিক্ষিত হোন, মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর আপনার শিক্ষার বড়াই করার চেষ্টা করবেন না। আপনার জানা উচিত, আপনার শিক্ষা শৌখিন এবং একজন জনপ্রতিনিধির জ্ঞান মৌলিক। আমার চেয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের কোনো কোনো অফিসারের শিক্ষা ও জ্ঞান বেশি। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত তাকে মানতে হবে। কথাটা তিনি বলেছিলেন, সেই সময়, যখন কঙ্গোতে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বাকে বরখাস্ত করেছিলেন। আমাদের উপমহাদেশে এ ধরনের বরখাস্ত করাটা তো একটা নিয়মনীতি হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলে ভারত উপনিবেশে আমলাদের দৌরাত্ম্য ছিল। তারাই স্যার, খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর ইত্যাদি খেতাব কারা পাবেন তা নির্ধারণ করতেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে এ রেওয়াজটি যারাই প্রবর্তন করে থাকুন, এখন তা পরিবর্তন করা দরকার। আমাদের আরেকটি জাতীয় পুরস্কার বাংলা একাডেমি পুরস্কার সম্পর্কে কিছু লিখলাম না। রোগশয্যায় শুয়ে আছি। যদি বেঁচে থাকি, বারান্তরে লেখার আশা রইল।

লন্ডন, শনিবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম