Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

মার্কিন চাপের কাছে মাথা নত করা যাবে না

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মার্কিন চাপের কাছে মাথা নত করা যাবে না

রীতিমতো একটা বিভ্রান্তির মধ্যে আছি। বাংলাদেশে আমার যেসব বন্ধু প্রচণ্ড মার্কিনবিরোধী ছিলেন, এখন দেখছি তারা সবাই একটা মার্কিন ধমকেই শেখ হাসিনার মাথা নত করা উচিত বলে ভাবছেন। আমি মনে করি, তার মাথা নত করা উচিত হবে না। হাসিনা সরকারের শাসনে দেশের বেশিরভাগ মানুষ যে খুশি নয়, তা আমি জানি, বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। শেখ হাসিনার দেশপ্রেমে আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু তিনি এখন একেবারেই একা। তার চারপাশে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই লুটেরা কোম্পানির সদস্য। তাই শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ চালাতে চান, সেভাবে চালাতে পারছেন না। আমিও দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছি। কিন্তু সরকার নয়, বাংলাদেশের মূল ভিত্তির ওপর যখন আঘাত আসে, তখন তাকে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমেরিকা দাঁড়িয়েছে। এটা যে হবে, এ সম্পর্কে আমি আগেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের নির্দেশ মানতে না চাওয়ায় হিলারি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। হিলারি তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামা হাসিনাবিরোধী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে না চাওয়ায় হিলারি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বড় একটা কিছু করে উঠতে পারেননি। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের ব্যাপারে খুব একটা নজর দেননি। ডেমোক্রেটিক পার্টি আবার ক্ষমতায় আসায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে হিলারি ক্লিনটনের সমর্থকরা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মানবতার ধুয়া তুলে এখন তারা হাসিনা সরকারকে জব্দ করার জন্য মাঠে নেমেছে। এরা হলো হাসিনা সরকারের এক নম্বর শত্রু। এদের সঙ্গে ড. ইউনূস এখনো আছে।

দ্বিতীয় শত্রু বিএনপি-জামায়াত এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ। এতদিন তারা সরকারবিরোধী কঠোর সমালোচনা চালিয়েও সফল হতে পারেনি। এখন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহযোগিতা পাওয়ায় তারাও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকেও অঢেল টাকা আসছে। ওই টাকায় বাংলাদেশের কিছু সুশীলকে যেমন কেনা গেছে, তেমনি কেনা গেছে বিদেশের কিছু সুশীলকেও। তাদের দ্বারা বই লেখানো হচ্ছে, নতুন নতুন টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, সারা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন ভাষায় হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে। এটা যদি কেবল হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা হতো, তাহলে আমার কিছু বলার থাকত না। কিন্তু এ আঘাত শুধু হাসিনা সরকারের ওপর নয়, এ আঘাত এসেছে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ভিত্তির ওপর। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে হাসিনা সরকারের পতন হলে ক্ষমতায় আসবে বিএনপি-জামায়াত। দেশে কী বিভীষিকা সৃষ্টি হবে, তা কল্পনা করাও যায় না। তাই কোনো দেশপ্রেমিক মানুষ মার্কিন ও বিএনপি-জামায়াতের প্রচারণার সাফল্য কামনা করতে পারে না।

বাংলাদেশে র‌্যাব তৈরি করা হয়েছিল সন্ত্রাস দমনের জন্য। সেই সন্ত্রাস র‌্যাব সাফল্যের সঙ্গে দমন করেছে। পরবর্তীকালে তারা ক্ষমতাবহির্ভূত কিছু কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এটা সত্য, র‌্যাবের কিছু সদস্যের ক্ষমতার বাড়াবাড়ি সরকারের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। সরকার একেবারে নিয়ন্ত্রণ করেনি তা নয়। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় যে র‌্যাব অফিসার জড়িত ছিলেন, তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু র‌্যাবের অত্যাচারের যে অভিযোগ মার্কিন কর্তারা তুলেছেন তা সঠিক নয়। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলেও দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলেছে। বিরোধীদলীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় প্রকাশ্য দিবালোকে যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে, তা বিশ্বে একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। এ সময় বাংলাদেশে মানবতার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ আমেরিকা তুলেনি। আজ হঠাৎ তার মানবতাবাদী সাজার কারণ কী? কারণ এশিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের যুগে বাংলাদেশকে চীনের বন্ধু হওয়া থেকে বাধা দেওয়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। এ ব্যাপারে তারা কয়েকটি পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশকে জানিয়েছে। বাংলাদেশ এতকাল এগুলো না মেনে চলায় এই চাপ।

বিএনপি-জামায়াতের অধিকাংশ নেতার ভেতরে দেশপ্রেম নেই। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে স্বদেশের মাটিতেই দাঁড়িয়ে তারা করুন। এমন সব ইস্যু নিয়ে তারা আন্দোলনে নামেন, যার পেছনে কোনো জনসমর্থন নেই। খালেদা জিয়া এত অসুস্থ নন যে, তাকে বিদেশে পাঠাতে হবে। তিনি এখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাহলে বিএনপির আন্দোলনের আর কী ইস্যু থাকে? দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে তারা মাঠে নামুন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে কোলে নিয়ে তারা ক্ষমতায় যাবেন, এটা দেশের অধিকাংশ মানুষ মানবে না। সরকার যে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কিছুটা বাড়াবাড়ি করছে, এটা তার কারণ। কিন্তু আমেরিকায় যেসব মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ হচ্ছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে তার কানাকড়িও হচ্ছে না। কিন্তু রাক্ষস এখন নিজের দাঁতের রক্ত মুছে বাংলাদেশকে মানবতাবিরোধী বলে শাসাচ্ছে। বিএনপি কী করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিদেশি সাহায্য গ্রহণে মীরজাফরের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার।

বাংলাদেশের মতিগতি দেখে মনে হয়, আমেরিকার এ চাপের কাছে অনেকেই ক্রমেই নরম হয়ে আসছেন। ঢাকায় যেসব বামপন্থি বন্ধু আছেন, তারাও বলছেন, বর্তমান সংকটে বাংলাদেশের উচিত আমেরিকার সঙ্গে একটা আপস করে ফেলা। এ আপসের বিকল্প হচ্ছে চীনের দিকে ঘেঁষা। তার পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে। কারণ চীন ছোট ছোট দেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে সেই দেশটিকে কিনে ফেলার চেষ্টা করে। আজ (শুক্রবার) পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন দয়া করে আমাকে একটা টেলিফোন করেছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, চীনের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খুবই অল্প। এ চৈনিক ভূতের যারা ভয় দেখাচ্ছেন, তারাও কি তাহলে মার্কিন প্রচারণার খপ্পরে পড়েছেন?

আমেরিকার সিনেটর অথবা কংগ্রেসম্যানদের নির্বাচনি প্রচারণার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করা অবৈধ নয়। এ সুযোগে বিএনপি-জামায়াত কোনো কোনো কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের কিনে ফেলেছে বলে মনে হয়। হাসিনা সরকার এই ব্যাপারে অসতর্ক ছিল। এখন মাঠে নেমে দেখে বিএনপি আগেই গোল দিয়ে বসে আছে। এখন বাতাসে বিএনপি-জামায়াতের প্রচারণা ভেসে বেড়াচ্ছে। সুশাসনদানে সরকারের ব্যর্থতাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে তারা প্রচার চালাচ্ছে। দেশের স্বাধীনতার ভিত্তিকেই ধ্বংস করতে চাচ্ছে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি রাজনীতির মাঠে নামলে বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী বিরাট গণমোর্চা গড়ে তুলতে পারত। তারা তা করেনি। তারা মিথ্যা প্রচার ও বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করে ১৭৫৭ সালের মতো শুধু দেশের সরকারকে নয়, দেশের স্বাধীনতাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। এ অবস্থায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের যতই বিরোধী হই, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। দেশের প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক মানুষকে আজ মার্কিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছে। একটি সামরিক সরকারকে বাংলাদেশের মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আজ সে আবার মানবতাবাদী সেজে বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তে সাহায্য জোগাতে এসেছে।

হাসিনা সরকারের উচিত হবে, মার্কিন ধমকের কাছে মাথা নত না করে শক্ত অবস্থান নেওয়া। যারা মনে করেন, এই শক্ত অবস্থান নিলে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে বাংলাদেশকে পঙ্গু করা হতে পারে, তারা রজ্জুতে সাপ দেখছেন। বাংলাদেশকে সাহায্যদানের ব্যাপারে আমেরিকার নিজস্ব স্বার্থও রয়েছে। এ স্বার্থহানির ভয়েই হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর অবস্থানে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। অপরদিকে, আমেরিকারও পা আটকে গেছে ইউক্রেনে। আমেরিকা সেখানেও চেয়েছিল ইউরোপকে দিয়ে যুদ্ধ বাধাতে। কিন্তু ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি শক্তিশালী দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে রাজি নয়। রাশিয়াও অন্যদিকে তার অবস্থান শক্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন চীনে। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শলাপরামর্শ করছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, রাশিয়া আক্রান্ত হলে তারা চুপ থাকবে না। অতীতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে আমেরিকা দুটি দেশকে ধ্বংস করার প্ল্যান এঁটেছিল। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষে অতীতের সেই কৌশল কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। চীন এবং রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হলে ইউক্রেনে ন্যাটোর যুদ্ধজয়ের যে সম্ভাবনা নেই, এটা বাইডেন প্রশাসন জানে। আমেরিকা যখন ইউক্রেন সমস্যায় জর্জরিত, তখন বাংলাদেশের পক্ষে তাদের চাপ অগ্রাহ্য করা অনেকটা সহজতর।

শেখ হাসিনা কুশলী নেত্রী। তিনি জানেন কী করে চীন ও আমেরিকার চাপের মুখে দেশের নিরাপত্তা বজায় রাখা যায়। র‌্যাবকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করুন। তার চারপাশের চাটার দলকে দল এবং প্রশাসন থেকে দূর করে তার ব্যক্তিত্বকে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে লাগান। তাহলে বিদেশি ভূতের ভয়ে তাকে আর পথ হাঁটা বন্ধ করতে হবে না।

লন্ডন, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম