সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কি দুরাশা?

ড. হারুন রশীদ
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের মাস চলছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা এবং একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সালাম, বরকত, শফিক, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত ভাষার মাসে নতুন করে শপথ নিতে হবে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার। দুঃখজনক হচ্ছে, শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের ভাষাচেতনা জেগে ওঠে। বাকি সময় উদাসীনতা আর অবহেলার।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার। বাঙালি ছাড়া আর কোনো জাতি তার নিজের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়নি। এ কারণে বাঙালির এই মহান আত্মত্যাগকে গোটা বিশ্ব স্মরণ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে। তারা জানতে পারে আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা। বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের কথা।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সফরে এসে তার বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ সেদিন ‘নো নো’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করেছিল এ দেশের ছাত্র-যুবকরা। এরপর নানা সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। এর জন্য রক্ত ঝরাতে হলেও বাঙালি দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। একুশ তাদের এমনই সাহসী করে তোলে যে, এরপর বলা হতে থাকে ‘একুশ মানে মাথানত না করা’। এ উন্নতশির জাতিই পরে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। বস্তুত একুশের পথ ধরেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।
হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলা সমৃদ্ধ একটি ভাষা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের মতো লেখক সৃষ্টি হয়েছে এ ভাষায়ই। কিন্তু সেই ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী সময়ে তেমন কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে? সময়ের অভিঘাতে পালটে যাচ্ছে সবকিছু। প্রযুক্তিনির্ভর একবিংশ শতাব্দীতে তরুণ প্রজন্মও বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন। অন্য ভাষা শেখায় কোনো দোষ নেই। রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলতে হয়-‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি পরে ইংরেজি শেখার পত্তন।’ মাতৃভাষা ভালো করে না জানলে কোনো ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করা যায় না।
যে চেতনাকে ধারণ করে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে এই দশকে-সংগত কারণেই এ প্রশ্ন আজ জাতির সামনে। এছাড়া বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশটির বয়স এখন ৫০ বছর। স্বাধীনতালাভের মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ণতা পায়। এ কারণে আশা করা হয়েছিল, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। দেশের সব মানুষ তাদের নিজের ভাষায় লিখতে-পড়তে পারবে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়েছে? এর উত্তর হলো-না, হয়নি। এখনো সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। উচ্চ আদালত, প্রশাসনসহ সর্বত্র এখনো ইংরেজির দাপট। এখনো বাংলায় রায় দেওয়ার রীতি চালু হয়নি। এমনকি ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র পর্যন্ত লেখা হয় ইংরেজিতে। সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন, বিজ্ঞাপনেও ইংরেজির ছড়াছড়ি। যদিও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো অক্ষরজ্ঞানহীন। বস্তুত ভাষা আন্দোলন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। যতদিন একজন মানুষও নিরক্ষর থাকবে, ততদিন ভাষা আন্দোলন চলবে। এর চেতনাকে ধরে রাখতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রত্যেক মানুষকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে না পারলে, তাদের শিক্ষিত করে তোলা না গেলে ভাষা শহিদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে না। তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শনও সম্ভব হবে না।
শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যে বিষয়টি যুক্ত তা হলো নিজস্ব ভাষা। ভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথকে সম্প্রসারিত করে। এজন্য একজন মানুষ তার ভাষা প্রয়োগে যতটা দক্ষতা অর্জন করবে, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি তত সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। এজন্য বাস্তবিক কারণেই একজন আধুনিক মানুষের আরও দক্ষ, যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য ভাষার ওপর পূর্ণ দখল থাকা চাই। সেটা অবশ্যই তার মাতৃভাষা। এর সঙ্গে অন্য ভাষা যত শেখা যায়, ততই ভালো। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, শুরুতেই এ ভাষার গাঁথুনি শক্ত করতে হবে। পরে ইংরেজি কিংবা অন্যান্য ভাষার গোড়াপত্তন করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম বাংলা বা ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। তারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছে। এতে ভাষা বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে।
একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও আবার বড়ই বিচিত্র। এফএম রেডিওর বিরুদ্ধে ভাষা বিকৃতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এজন্য গণমাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, বিশেষ করে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে হবে? এই আত্মবিনাশের পথ থেকে আমাদের ফিরে আসতেই হবে। লেখায়, বলায়, পঠনে-পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মর্যাদার আসনে। মনে রাখতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু আমাদের নিজস্ব ব্যাপার নয়, এটি এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও। এমনকি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে দাবি জানানো হয়েছে। এ দাবির পক্ষে জোরালো জনমত গঠন করতে হবে। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে যাতে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
প্রতিবছর ভাষার মাসে বইমেলা শুরু হলেও করোনা মহামারির কারণে এবার তা হচ্ছে না। মহামারির কারণে মেলা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে কী, একুশের আরেক অর্জন আমাদের বইমেলা। বইমেলা জড়িত বাঙালির চেতনা ও আবেগের সঙ্গে। বাঙালির যত আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য, তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই। বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে। সেখানে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা ও পাঠকেরই সমাগম হয় না, মেলা পরিণত হয় লেখক, প্রকাশক, পাঠক, দর্শকসহ বয়স-শ্রেণি-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায়।
সৃজনশীল প্রকাশকরা হাজারও বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হন বইমেলায়। মেলায় আগত দর্শক সমাগম নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে, সারা দেশের অগণিত গ্রন্থপিপাসুর নতুন বই হাতে পাওয়ার বিপুল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। একুশের চেতনাসমৃদ্ধ মেলাকে কীভাবে আরও সম্প্রসারণ করা যায়, এর শ্রীবৃদ্ধি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সময়ের অভিঘাতে সবকিছু পালটাচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পালটাচ্ছে-যে কারণে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বইমেলার উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলা যেন আরও বেশি অবদান রাখতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের অবলুপ্তিও ত্বরান্বিত হচ্ছে। অথচ একুশের চেতনাই হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা হারিয়ে যেতে না দেওয়া। এ দায়িত্ব শুধু বাঙালির নয়, পৃথিবীর সব মানুষের।
একুশ তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। এ ভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। তবেই সার্থক হবে একুশ। সার্থক হবে বইমেলা। ভাষাচেতনার মাসে এই বোধ জেগে উঠুক সবার মধ্যে।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক
harun_press@yahoo.com