শতফুল ফুটতে দাও
যেভাবে মূল্যবান সামাজিক পুঁজি হারিয়ে যায়

ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আজকের এ লেখায় সমাজবিজ্ঞানের তিনটি শাখায় কী অধ্যয়ন করা হয়, সেটি বর্ণনা করে ধীরে ধীরে আমরা মূল প্রসঙ্গে যাব।
অর্থনীতিবিদরা প্রধানত বাজার নিয়ে অধ্যয়ন করেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্র নিয়ে অধ্যয়ন করেন, নৃবিজ্ঞানী ও সমাজতত্ত্ববিদরা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যে সম্পর্ক এবং ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কজাল গড়ে ওঠে, সেগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করেন।
বিগত শতাব্দীর ৭০ ও ৮০-এর দশকে সমাজবিজ্ঞানের গবেষকরা একে অপরের গবেষণার ফলগুলো পড়তে শুরু করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য-ভিন্ন ধরনের সমাজবিজ্ঞানীরা একই ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তারা কী দেখতে পেয়েছেন, সে সম্পর্কে অভিহিত হওয়া। ফলে নিজের চিন্তাগুলো আরও প্রখর ও পরিচ্ছন্ন হয়। সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য এটি একটি জুতসই কৌশল।
এই কৌশল অবলম্বন করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস কোলম্যান ১৯৮৭ সালে যে প্রবন্ধটি লিখেছেন তার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সামাজিক পুঁজি’ কীভাবে সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত একটি সাংগঠনিক ধারণায় পরিণত হতে পারে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সামাজিক পুঁজি ব্যতিরেকে আর কোনো ধারণা সামাজিক বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এ বিষয়টি শুধু সামাজিক বিজ্ঞানীদের নাড়া দেয়নি, এটি সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পুঁজি বলতে আমরা বুঝি সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি নিয়ামক শক্তি।
সামাজিক পুঁজি বলতে আমরা যা বুঝি এর বাইরে গিয়েও বিষয়টি অর্থনৈতিক পণ্যের কথাই বলে। সামাজিক পুঁজি এখন সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণায় একটি বহুল ব্যবহৃত বিষয়। অর্থনীতি শাস্ত্রের গবেষকের কাছে সামাজিক পুঁজির ধারণাটির তেমন গুরুত্ব পায়নি, তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানীরা ধারণাটির গুরুত্ব সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছেন।
সামাজিক পুঁজি বলতে আমরা কী বুঝি? কোনো কোনো গবেষক সমাজ সংগঠনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় ট্রাস্ট বা আস্থার প্রতি দৃক্পাত করেছেন।
এটাই সামাজিক পুঁজি। একদল রয়েছেন যারা পারস্পরিক আচরণের সমষ্টির মধ্যে সামাজিক পুঁজির অবস্থান আবিষ্কার করেছেন। কারোর কারোর মতে, এটা হলো সামাজিক সম্পর্কের জটাজাল। দেখা যাচ্ছে, সামাজিক পুঁজি নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। একটু একাডেমিক ধরনের আলোচনা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নাও হতে পারে। তাই একটি সহজসরল দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরা যাক, বৈশাখী ঝড়ে একটি গ্রামে কয়েক জনের বসতঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষগুলো অসহায়বোধ করতে পারে। না, তাদের অসহায়বোধ করার কোনো কারণ নেই। পাড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে এলো ঘরগুলোকে আবার দাঁড় করাতে। কেউ কেউ নিজের বাঁশঝাড় থেকে পালা দেওয়ার জন্য বাঁশও কেটে আনল। প্রতিবেশীর এ দুঃসময়ে নানাজন নানাভাবে সাহায্য করল। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কেউ ঘর মেরামত করে দেওয়ার জন্য একটি পয়সাও দাবি করল না। এটাই হলো পরার্থপরতা। অর্থনীতিবিদরা মানুষকে স্বার্থান্ধ প্রাণী হিসাবেই বিবেচনা করে। কিন্তু প্রয়োজন হলে মানুষ তার স্বার্থান্ধ চেহারাটি দূরে সরিয়ে দিয়ে যথার্থ অর্থেই মানবিক হয়ে উঠতে পারে। ঝড়ের পর বিধ্বস্ত ঘর মেরামত করার কাজে কোনো বিনিময় দাবি না করে যে আনজাম দেওয়া হয় তাকেই বলা হয় সামাজিক পুঁজি।
যে সমাজে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা অত্যন্ত দৃঢ়, যেই সমাজে পরার্থপরতা ব্যাপকভাবে বিদ্যমান, যে সমাজে দানশীলতা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়, যেই সমাজে দুস্থ মানুষের সহায়তায় মানুষ এগিয়ে আসে, যে সমাজে লৌকিক উদ্যোগে স্কুল কলেজ এবং উপাসনালয় গড়ে ওঠে, যেই সমাজে স্বেচ্ছাকৃত ও যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সড়ক পুল-কালভার্ট গড়ে তোলা হয়, তেমন সমাজই সামাজিক পুঁজিতে সমৃদ্ধ।
সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, যেসব সমাজ সামাজিক পুঁজির দিক থেকে সমৃদ্ধ সেসব সমাজ দ্রুত উন্নত হয়। সামাজিক পুঁজিকে বস্তুগত পুঁজির মতো পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে বোঝা যায় না, একে বুঝতে হলে মানুষের মনকে ইন্দ্রিয় হয়ে উঠতে হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ ফেরেস্তাও নয়, শয়তানও নয়। যে সমাজে মানুষের মধ্যে ফেরেস্তাসুলভ গুণাবলি প্রাধান্য বিস্তার করে, সে সমাজ উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়।
বাংলাদেশের সমাজে এখন আমরা বেশুমার দুর্নীতি, রেন্ট সিকিং, সুবিধাবাদের বিস্তার, ঘৃণার হলাহল এবং ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আগুন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে দেখি। সামাজিক পুঁজির দিক থেকে আমরা বলতে পারি বাংলাদেশে সামাজিক পুঁজি দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
অধ্যাপক কোলম্যান কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, সামাজিক পুঁজি কী ধারণ করে। এক. হীরার পাইকারি বাজারে এমন একটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যা এই বাজারের বহির্ভূত কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারে না।
বিক্রয় প্রক্রিয়ায় যে দেনদরবার চলে তার মধ্যে একটি অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ করা যায়। এই বাজারে একজন বণিক অন্য বণিকের হাতে একটি পাথরের ব্যাগ তুলে দিয়ে বলে তোমার অবসর সময়ে তুমি পরখ করে দেখবে এর মধ্যে কী আছে।
এ কাজে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ইনসিওরেন্স করা হয় না। এই ব্যবসার ঝুঁকি হলো পাথরের ব্যাগটি ফেরত দেওয়ার আগে ওই ব্যাগ থেকে কোনো পাথরের টুকরো সরিয়ে রাখা হতে পারে। এ ব্যবসার পণ্যটি কয়েক হাজার ডলারের ব্যবসা হতে পারে। এমনকি শত সহস্র ডলারের ব্যবসাও হতে পারে।
এ রকম মুক্ত বিনিময়ে পাথরের যে বিনিময় হয়, তা দিয়ে হীরার বাজারকে কার্যকর করে তোলা হয়। এই রীতি যদি না থাকত, তাহলে হীরার বাজারে নানা রকম ঝামেলা দেখা দিত এবং হীরার বাজার দক্ষতা হারিয়ে ফেলত। এ বাজার দেখে আমরা সমাজ কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে পারি। এ বাজারের বণিক সম্প্রদায় একে অপরের বেশ ঘনিষ্ঠ। তাদের মধ্যে ঘন ঘন দেওয়া-নেওয়ার চর্চা বিদ্যমান। তারা জাত বিচারের এবং পারিবারিক সম্পর্কের দিক থেকে একই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
নিউইয়র্কের হীরার বাজারে যারা সক্রিয়, তারা ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত, বিয়ে-শাদির সম্পর্ক তাদের মধ্যেই প্রায় সীমাবদ্ধ, তারা ব্রুকলিনে সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে বাস করে এবং তারা একই সিনাগগে উপাসনা করে। বলা যায়, এ সম্প্রদায়টি তাদের চারদিকে দেওয়াল তুলে বসে আছে।
হীরার পাইকারি বাজার প্রত্যক্ষ করে বোঝা যায় তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর ঘনিষ্ঠতা। এ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে পরিবার, গোষ্ঠী, এবং ধর্মীয় পরিচয়ের মাধ্যমে।
এগুলো দিয়েই তারা তাদের ব্যবসার জন্য ইনসিওরেন্স করে রেখেছে। কোনো ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে তারা যেভাবে পরিবার, গোষ্ঠী এবং ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ, সেগুলোই তাদের দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ইনসিওরেন্সের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ইনসিওরেন্স। যদি কোনো ব্যক্তি এই সম্পর্কে ব্যত্যয় ঘটায়, যেমন পাথর চুরি করা অথবা পাথর বদলে দেয়, তাহলে তাকে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এ সম্পর্কের দৃঢ়তাই হীরার বাজারকে কার্যকর করে রেখেছে। হীরা একটি অতি মূল্যবান বস্তু। এ বাজারে বাজারবহির্ভূত উপাদান হিসাবে সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একসময় বাংলাদেশের গ্রামেও সমাজচ্যুত বা একঘরে করার রীতি প্রচলিত ছিল। এই রীতি সমাজের জন্য কতটুকু হিতকর তার ওপর কোনো গবেষণা হয়নি।
দুই. ১৯৮৬ সালের ২১-২২ জুন The International Herald Tribune-এর প্রথম পাতায় দক্ষিণ কোরিয়ার একজন বিপ্লবী ছাত্র কর্মীর কাহিনি ছেপেছিল। এ রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায়, কীভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শক্তি সঞ্চয় করে। বিপ্লবী চিন্তাভাবনা গোপনে পাঠচক্রের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঠচক্রগুলো হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক অথবা নিজের শহরভিত্তিক অথবা গির্জাভিত্তিক। এসব পাঠচক্রের সদস্যরা সরাসরি একে অন্যের সঙ্গে কখনই দেখা করে না। একজন নির্দিষ্ট প্রতিনিধির মাধ্যমে এরা খোঁজখবরগুলো পায়। এই গল্পটি থেকে দুই ধরনের সামাজিক পুঁজির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
একই বিদ্যালয় অথবা একই শহরের বাসিন্দা হওয়া অথবা একই গির্জার উপাসনাকারী হওয়ার সুবাদে পাঠচক্রগুলো গড়ে ওঠে। এই পাঠচক্রগুলো বিবেচিত হতে পারে একধরনের সামাজিক পুঁজি হিসাবে। যে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে দেশে প্রকাশ্যভাবে সভা সংগঠন করা যায় না, সে রকম দেশে পাঠচক্র তৈরি করে গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়।
এমনকি যেসব দেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত সহ্য করা হয়, কিন্তু কিছু কিছু কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয় এবং এগুলোকে রাজনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসবাদ অথবা সাধারণ অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়, সেসব দেশে পাঠচক্র শক্তিশালী সামাজিক পুঁজির ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছে। এ নির্বাচন প্রচণ্ডভাবে হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত অর্থাৎ এই লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত নির্বাচনি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৬ ধাপে ৯৫ জন এবং আহতের সংখ্যা তার কয়েকগুণ হতে পারে। বহুকাল ধরে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রতীক ব্যবহার করা হতো না। কিন্তু প্রতীক ব্যবহার চালু করার ফলে একই দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে ভীষণ প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়েছে। দেখা গেছে, বহু ইউনিয়ন পরিষদে দলের মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তি জয়লাভ করতে পারেনি।
জয়ী হয়েছে দলেরই অপর একজন, যাকে মনোনীত করা হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, দলের ভেতরকার অবস্থা সম্পর্কে দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা অবহিত নন। ক্ষেত্রবিশেষে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেশকিছু নির্বাচনি এলাকায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে যেভাবে হিংসাবিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ভয়ানক ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় যেরকম সামাজিক যূথবদ্ধতা, ক্ষয়িষ্ণুতা সত্ত্বেও বিরাজমান ছিল, আজ তা অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি।
ভালো-মন্দ মিলিয়ে গ্রামীণ সমাজে একজন অপরজনের সুখে-দুঃখে যেভাবে এগিয়ে আসত এবং যেভাবে একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ প্রদর্শন করত, তা আজ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা স্বল্প মেয়াদে গ্রামে হিংসার আগুন জ্বলতে দেখেছি।
দীর্ঘমেয়াদে এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। কারণ নির্বাচনি বিরোধকে উপলক্ষ্য করে গ্রামীণ সামাজিক পুঁজির কবর রচনা করা হয়েছে। একটি দেশে অনেক কারণে অনেক ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ সমাজে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল, তা বিলুপ্ত হতে চলেছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ