Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আয়ু আর কতদিন?

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আয়ু আর কতদিন?

বহুকাল আগে আমি যখন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতাম, তখন আমেরিকার নিউজউইক পত্রিকার এক সাংবাদিক রিচার্ড হ্যারিসন ঢাকায় এসেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একটি রিপোর্ট লেখা। তিনি ইত্তেফাক অফিসেও এসেছিলেন। ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়ার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক আলাপ-আলোচনা করেছেন।

আমি তখন সেখানে ছিলাম। রিচার্ড হ্যারিসন মানিক মিয়াকে বলেছিলেন-মানিক মিয়া, আপনারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিখছেন। এই সাম্রাজ্যবাদ পঞ্চাশ বছরের বেশি টিকবে না। আমি একটা হিসাব করে দেখেছি। সাম্রাজ্যবাদের আয়ু ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্য সাতশ বছর স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মাত্র আড়াইশ বছর টিকেছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থান এখন দখল করেছে মার্কিন সাম্রাজ্য। তার আয়ু পঞ্চাশ বছরের বেশি হবে বলে মনে হয় না। মানিক মিয়া বলেছিলেন, আপনি একজন মার্কিন সাংবাদিক হয়ে একথা বলছেন, তাহলে আমরা বলব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে বিশ্বে আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।

এই আলোচনার দীর্ঘকাল পর সম্প্রতি আফগান যুদ্ধ শেষে লন্ডনে আমরা কিছু সাংবাদিক একটা হিসাব করতে বসেছিলাম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি কলোনিতে দরকষাকষি, আলাপ-আলোচনা করে তাদের স্বাধীনতা প্রদান করেছে। এমনকি জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের মতো বিপ্লবীকেও তারা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে ইরাক পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে আপস করেনি, বরং পরাজিত হয়ে তাদের পালাতে হয়েছে। দেশগুলো ধ্বংস করা ছাড়া তারা আর কিছুই করতে পারেনি। সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানদের দখল মেনে নিয়ে তাদের সরে আসতে হয়েছে। তারও বহু আগে কোরিয়ার যুদ্ধে তারা লজ্জাজনকভাবে পরাস্ত হয়েছে। ভারত থেকে পণ্ডিত নেহেরুকে ডেকে আনতে হয়েছিল একটা আপসরফার জন্য এবং পানজুমনে আপস বৈঠক করে তাদের পালাতে হয়েছিল। ভিয়েতনামে তারা দলে দলে হ্যানয় থেকে পালিয়েছে। সুতরাং আমেরিকার যুদ্ধজয়ের ইতিহাস কোথাও নেই। যেটা আছে সেটা হলো দেশে দেশে গোপন চক্রান্ত করে পপুলার গভর্নমেন্টকে ধ্বংস করার শক্তি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর আমেরিকা একক বিশ্বশক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্ষমতার দাপটে ওয়াশিংটন মনে করেছিল, সারা বিশ্ব তাদের আনুগত্য মানতে বাধ্য। জর্জ বুশ জুনিয়র তাই তাদের পাপেট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে চুক্তি করে ইরাকে হামলা চালাতে সাহসী হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব তখন থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে এমন ধ্বংসকাণ্ড চালাবার সাহস হতো না। আমেরিকা রাশিয়াকে পদানত করার পর দেশটির সঙ্গে কলোনিসুলভ ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। বরিস ইয়েলৎসিন ছিল তাদের তাঁবেদার। এই অবমাননা রাশিয়ার জনগণ সহ্য করেনি। তাই ভ্লাদিমির পুতিনের অভ্যুদয়।

পুতিন কেজিবির প্রধান ছিলেন। ফলে তিনি রাশিয়ার সামরিক বাহিনী লাল ফৌজকে আবার সংগঠিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। জনগণের আস্থা লাভ করে তিনি ক্ষমতায় বসেছেন। এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আছেন। তার কূটনীতি আমেরিকাকে ভাবিয়ে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া ও ইরানকে আক্রমণ করতে আমেরিকা আর সাহসী হয়নি। তারা জানে তাদের হাতে যেমন মারণাস্ত্র আছে, তার চেয়েও উন্নত মারণাস্ত্র আছে রাশিয়ার হাতে। সুতরাং রাশিয়াকে আক্রমণ করলে তা গালফ যুদ্ধের মতো হবে না। পুতিনকেও সাদ্দামের মতো হত্যা করা যাবে না। বরং ইউরোপ ও আমেরিকা রাশিয়ার মারণাস্ত্রে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই পশ্চিমা শক্তি কখনো রাশিয়া আক্রমণের ভুল হয়তো করবে না।।

সোভিয়েত ইউনিয়নের যে অঞ্চলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, যেমন তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, ক্রিমিয়া- এই অঞ্চলগুলোকে আবার রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে পুতিন যত্নবান হয়েছেন। ইতোমধ্যেই তিনি ক্রিমিয়াকেও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এটা না করে তার উপায় ছিল না। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী এই দেশগুলোকে সাহায্যদানের নামে আমেরিকা এবং ন্যাটো এসে সামরিক ঘাঁটি বসাচ্ছে। উদ্দেশ্য রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা এবং সুযোগ পেলে আক্রমণ করা। পুতিন পশ্চিমা শক্তির এই চালাকি বুঝে ইউক্রেন সীমান্তে বিপুল সৈন্য মোতায়েন করেছেন। রাশিয়ার এই নিরাপত্তা মহড়াকে পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করছে ইউক্রেন আক্রমণের সূচনা হিসাবে। তাই ইউক্রেনকে রক্ষার নামে আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউক্রেনে বিপুল সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্য পাঠিয়েছে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে তাদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করেছে। এক্ষেত্রে আমেরিকার তাঁবেদার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাঁকডাক ছিল বেশি। পুতিনকে আমেরিকা চিঠি লিখে সাবধান করে দিয়েছিল যে, প্রয়োজনে ইউক্রেন নিয়ে তারা যুদ্ধ করবে। রাশিয়া পশ্চিমা শক্তির এই যুদ্ধের দামামাকে বলেছে ‘হিস্টেরিয়া’ এবং আমেরিকার ভূমিকা এ যুগের ডন কুইকজটের ভূমিকা।

অন্যদিকে, জার্মানিও ইউরোপের বড় প্লেয়ার। এবং রাশিয়ার ওপর জার্মানি তেল সরবরাহের জন্য নির্ভরশীল। এমন দশা ইউরোপের আরও অনেক দেশের। তাই আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য থেকে জার্মানি ও ইউরোপের জন্য তেল সরবরাহের ব্যবস্থা করে জার্মানিকে দলে টানতে চেয়েছিল। তাতে ফল তেমন একটা হয়নি। সুতরাং রাশিয়ায় হামলা চালানোর ব্যাপারে ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ নয়। তাছাড়া চীনের মতো মহাশক্তি এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নয়। যুদ্ধ লাগলে চীন একেবারে নিরপেক্ষ থাকবে, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। আমেরিকাও এখন আগের মতো শক্তিধর নয়। অকারণে মধ্যপ্রাচ্যে বছরের পর বছর যুদ্ধ করতে গিয়ে তার অর্থনৈতিক শক্তি এখন তলানির দিকে। সামরিক শক্তিও তাই। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে এসে হাঁকডাক দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি।

বাইডেন হাঁকডাক মারার লোক নন। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুনরুজ্জীবন তিনিও চান। তাই তিনটি দেশকে নিয়ে স্কোয়াড গঠন করেছেন। এই স্কোয়াডের ভবিষ্যৎ সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তির মতো হবে। ন্যাটো এখনো টিকে আছে মার্কিন অর্থে। ট্রাম্প এই ন্যাটো ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। চীনা আক্রমণের ভয় দেখিয়ে বাইডেন ন্যাটো রাখতে চান। কিন্তু কতদিন রাখতে পারবেন সন্দেহ আছে। বর্তমানে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হাওয়া বইছে। আমেরিকা এই হাওয়া কতদিন প্রতিরোধ করতে পারবে তা সন্দেহজনক। হিসাব করলে দেখা যায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আয়ু পঞ্চাশ বছরও হতে যাচ্ছে না। দেখা যাক তারপর কোন নতুন সাম্রাজ্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। সেটা দেখার জন্য আরও কিছু কাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা মনে পড়ছে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব আশি বছর বেঁচেছিলেন। এই আশি বছরের অধিকাংশ সময় তিনি মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যে। পিতা সম্রাট শাহজাহান যখন বন্দি অবস্থায় বেঁচে ছিলেন, তখন একদিন দিল্লির রাজপথে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ শুনে তার জ্যেষ্ঠকন্যা জাহানারাকে ডেকে বলেছিলেন, মা দেখো তো দিল্লির রাস্তায় কুচকাওয়াজ হচ্ছে কেন? তার মেয়ে উত্তর দিয়েছিল, সম্রাট আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে নতুন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন। শাহজাহান তখনই পুত্র আওরঙ্গজেবকে একটা চিঠি লিখতে বসেন। সেই চিঠিতে বৃদ্ধ সম্রাট লিখেছিলেন, পুত্র আওরঙ্গজেব, তোমাকে একটা কথা বলি। সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু তা রক্ষা করা সম্ভব নয়। অধিকৃত এলাকার মানুষের মন জয় করতে না পারলে তোমার আধিপত্য বিস্তার স্থায়ী হবে না। মোগল সাম্রাজ্যের আয়তন তুমি সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছ বটে, কিন্তু তার পতনের বীজও তুমি বুনে যাচ্ছো। শাহজাহানের এই সতর্কবাণী সত্য হতে বেশি দিন লাগেনি। ব্রিটিশ সৈন্যরা এসে দিল্লিতে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহকে বন্দি করে এবং তার দুই পুত্রকে প্রকাশ্যে রাজপথে হত্যা করে। ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ। ঢাকার সিপাহিরা কয়েকদিনের জন্য শহরটি দখল করে রেখেছিল। মঙ্গল সিং ছিল তাদের নেতা। পরে ব্রিটিশদের কাছে তারা পরাজিত হয় এবং বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কে তাদের গাছে লটকিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। বহুদিন এই মৃত সিপাহিদের লাশ গাছে ঝুলে ছিল। বিদ্রোহ দমনের পর একসময়ে ব্রিটিশরা এর নাম দেয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। পাকিস্তান আমলে নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। ব্রিটিশদের এই নৃশংসতা এবং রাজত্বের ইতিহাসও আজ বিস্মৃতির চির অন্ধকারে তলিয়ে গেছে।

আমেরিকার সামরিক জয়ের কোনো গৌরবগাথা নেই। সুতরাং তার পতনের ইতিহাস হবে আরও লজ্জাজনক। শেষ করার আগে আরও একটি কথা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ধনতন্ত্রের নেতৃত্বও তার হাত থেকে চলে যাবে। কার হাতে যাবে? সেই চীনের হাতে কি? চীন কি দেশে দেশে তার অর্থনৈতিক সাহায্যদানকে আবার নতুন সাম্রাজ্য বিস্তারের ভিত্তি করে তুলবে? সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, সেই আধিপত্য রক্ষার জন্য হাঙ্গেরীতে ছাব্বিশ হাজার মানুষ হত্যা করেছিল। পূর্ব ইউরোপে সেই সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়নি। চীনকে রাশিয়ার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। চীন বহির্বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ চাপানোর আগেই তার অভ্যন্তরে নাগরিক অধিকারের জন্য বিপ্লব ঘটতে পারে। তাই আশা করা যায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর পৃথিবীতে একটা স্বস্তির আবহাওয়া ফিরে আসতে পারে।

২৯ জানুয়ারি, ২০২২ লন্ডন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম