বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে হবে

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে হবে। এমন একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় সামনে চলে এসেছে শাবিপ্রবির ঘটনার সুবাদে। ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ঘটনা পরম্পরা এখন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনে ঠেকেছে। অনশন এখন ভেঙেছে। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না; একটি জনবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখন শিক্ষার্থী বনাম উপাচার্য সংকটে অবরুদ্ধ।
সময়ের দাবি, উচ্চশিক্ষা মুক্তি চায়। শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন এখন তো মনে হয়, বেশ যৌক্তিক। কারণ প্রাথমিক থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত এদেশে এখন শিক্ষার সংখ্যা ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপ্তি নজরকাড়া; কিন্তু একই সমান্তরালে গুণবোধক গভীরতা উধাও।
যা হোক, এ মুহূর্তের কথা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে; বৃক্ষের একটি শাখা, গোটা বৃক্ষের বিবেচনা আপাতত থাক। শাবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা উসকে দিয়েছে ঠিকই, তবে এটাই তো প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও অন্তত অর্ধডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বনাম শিক্ষার্থী সংকট ক্যাম্পাসকে উত্তাল-অস্থির করেছে।
সংকট সামাল দিতে সরকারি পদক্ষেপ আশাজাগানিয়া নয়। ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে মাত্র; মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে শাবিপ্রবির ঘটনা ধারাবাহিকতায় সংযোজন, ভবিষ্যতের অশনিসংকেত রয়ে গেল। অবশ্য শাবিপ্রবির সংকটের দ্রুত ও সম্মানজনক সমাধান সরকার দিতে পারলে তা হবে আশাপ্রদ। স্মর্তব্য, তপ্ত ক্যাম্পাস কোনো সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক নয়; তপ্ত ক্যাম্পাস সরকার ও দেশের জন্য ভাবনা-মূর্তি।
জনবিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন মূল সমস্যা উপাচার্য (ক’জন ব্যতিক্রম ছাড়া)। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী-প্রতিষ্ঠান প্রধান। বলা বাহুল্য, প্রতিষ্ঠান-প্রধানের যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ওপর প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী যদি নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েও শুধু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় দলান্ধ হয়ে ক্ষমতাসীন হন, তাহলে ক্ষমতাসীন দল আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠানটি অধঃপাতে যায়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাম্প্রতিক ভাবমূর্তি তা-ই বলে। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডেসকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার বিশ্বাস নেই; বিশ্বাস আছে সে মানুষগুলোর ওপর যাদের আছে সঠিক চিন্তা, মহান অনুভব আর সঠিক কর্ম।’
অনেকটা যেন অজান্তেই রবীন্দ্রনাথ নেতৃত্বের ভালো সংজ্ঞা দিয়েছেন। নেতৃত্ব শুধু দেশ-জনগণের জন্য নয়, প্রতিষ্ঠানের জন্য দরকার। এমন গুণসম্পন্ন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেন, ক্ষমতা ভোগ করেন না। বিবেকসম্পন্ন মানুষের অভিধানে ক্ষমতা বলে কিছু নেই, আছে দায়িত্ব।
উপাচার্য নিয়োগ-পদ্ধতির রাজনীতিকরণ মূল সমস্যা। ১৯৭২-এর ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই খাতে [শিক্ষা] রাজনীতি না হওয়াই ভালো।’ এখন রাজনীতি, নোংরা রাজনীতি হয়। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘যারা যোগ্য ও সৎ তাদের অধ্যক্ষ, উপাচার্য করেছি।’ এখন কাদের এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে? সবার জানা, প্রথম শিক্ষা কমিশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জননন্দিত এবং বিশ্বস্বীকৃত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদা। আমার বিবেচনায় একমাত্র শিক্ষানীতি তার হাত থেকেই পেয়েছিলাম; পরের শিক্ষা কমিশনগুলো লোক দেখানো সময় ও অর্থের অপচয় মাত্র। ড. খুদা পাকিস্তানে চাকরি করতেন। তিনি বাংলাদেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জহুরি, জহর চিনতেন। তিনি জানতেন কাকে কোন দায়িত্ব দিতে হবে। আর জানা কথা, বঙ্গবন্ধু ভালো মানুষ সন্ধান করতেন।
সিলেটের সুরমা আর ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী দুটিতে ১৩ জানুয়ারির পর থেকে অনেক জল গড়ালো, কিন্তু শাবিপ্রবির সংকট কাটল না। ২৬ জানুয়ারি দুটি খবর পেয়ে একাধারে শঙ্কিত ও উল্লসিত হলাম। পত্রিকা থেকে জানলাম, সরকার ‘হার্ডলাইনে’। সরকার বেলাইনে আছে, ঠিক লাইনে আসতে হবে; ‘হার্ডলাইনে’ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে তাৎক্ষণিকভাবে, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। একটি বাংলা দৈনিকে কর্মরত একজন স্নেহভাজন সাংবাদিক জানাল, আজ সকালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে শিক্ষার্থীদের অনশনের ইতি হয়েছে, তবে আন্দোলন চলমান থাকবে। অর্থাৎ ড. জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণযোগ্য, তার কথা শিক্ষার্থীরা শোনে; উপাচার্যের কথা শোনে না। উপরন্তু ড. জাফর ইকবাল যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কেমন লোক উপাচার্য হওয়া উচিত। সরকার কী দেখল?
উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরাজনীতিকরণ কাম্য। ভারতের মতো একটি সন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) যোগ্য উপাচার্য ঠিক করবে; সরকারি প্রক্রিয়ায় তার নিয়োগ হবে। সন্ধান কমিটি পাঁচ বছরের জন্য হবে। আপাতত সদস্য হওয়ার মতো গুণী মানুষ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. আকবর আলি খান, ড. এটিএম শামসুল হুদা, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। সাচিবিক সহায়তার দায়িত্বে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। সদস্য সচিব হবেন বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সচিব। কমিটি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনধিক তিনজনের তালিকা করবে, যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হবে। এক মাস পর কমিটি তালিকা চূড়ান্ত করে সরকারকে দেবে; সরকার একজনকে নিয়োগ দেবে।
বর্তমান প্রক্রিয়ায় সরকার উপাচার্যের নির্বাচন ও নিয়োগ দুটিই করে, যা বাস্তবে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে কমিটি উপাচার্য নির্বাচন করবে, সরকার নিয়োগ দেবে। উপাচার্যের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। আর তা করতে গিয়ে ’৭৩-এর অধ্যাদেশে (যার অধীনে এখন চারটি বিশ্ববিদ্যালয়) কিছু সংশোধন করতে হবে। প্রথমত, এ অধ্যাদেশ সব জনবিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
দ্বিতীয়ত, সব জনবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সন্ধান কমিটির সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে; প্যানেল পদ্ধতি বিলুপ্ত হবে। তৃতীয়ত, সব জনবিশ্ববিদ্যালয়ের নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকবে, এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করেই। স্মর্তব্য, প্রশাসনিক সব কাজের জন্য স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা গণতান্ত্রিক। চতুর্থত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচনের সংখ্যা কমাতে হবে; শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচন নিয়মিত করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
উল্লেখ্য, ড. কামাল হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের নির্বাচনের সংখ্যা কমাতে চেয়েছিলেন, সময় পাননি। এখন সোৎসাহে নিয়মিত শিক্ষকদের নির্বাচন হয়, কিন্তু শিক্ষার্থীর কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচন উধাও, যা অনাকাক্সিক্ষত। এ কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগণতান্ত্রিক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও এমন ভাবনা কাম্য; শিক্ষা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এগুলো রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র হিসাবে অস্তিমান হতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে হবে; কারণ সুশাসনের অভাবে, অযোগ্য নির্বাহী প্রধানের অবিমৃষ্যকারিতায় এ খাতে এখন মাৎস্যন্যায় বিরাজমান, যার অবসান কাম্য। সুশিক্ষার সুবাতাস আমাদের কাম্য। সুবর্ণজয়ন্তীর এ সময়ে শিক্ষা বিবর্ণ হোক, তা আমরা চাই না।
পুনশ্চ : লেখাটি যখন শেষ করছি, তখন একটি বাংলা দৈনিকে খবর দেওয়া হলো যে, শাবিপ্রবিতে উপাচার্য পরিবর্তনের কথা ভাবছে সরকার। শেষমেশ তা হলে সরকারকে আগাম অভিনন্দন।
২৭ জানুয়ারি ২০২২
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)