কূটনৈতিক সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর
বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক উত্তরোত্তর দৃঢ় হোক
মো. জিল্লুর রহমান
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী। রাশিয়া বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। এজন্য বাংলাদেশ রাশিয়ার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় থেকে রাশিয়া এ দেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন কঠিন হতো।
বর্তমানে বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক বলতে মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং রুশ ফেডারেশনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বোঝায়। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তার উত্তরসূরি রাষ্ট্র রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চালু রয়েছে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দুই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারত প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করলেও পরোক্ষভাবে সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এ রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জোরালো পদক্ষেপ নেয়। এ রাষ্ট্রের অনমনীয়তার কারণেই পাকিস্তানের পক্ষে একাত্তরের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েও তা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণেও দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখেছে এ দেশটি।
আমরা অনেকেই জানি, সে সময়ে বিশ্ব প্রধানত দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। এক শিবিরের নেতৃত্ব দিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপর শিবির নিয়ন্ত্রণ করত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময় নীতিগত কারণে বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা দিয়ে যেত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২৫ মার্চ গণহত্যার প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক প্রাণহানি, নিপীড়ন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দমন-পীড়ন বন্ধ করে একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের উপায় উদ্ভাবনের জন্য তিনি ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। শীর্ষ দুই দেশের একটির তরফ থেকে এমন বার্তা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ সঞ্চার করে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানের পরাজয়ের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে পরদিন ৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনে। ‘একতরফা’ আখ্যায়িত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সে প্রস্তাবে ‘ভেটো’ দেয়।
পরের দিন নিরাপত্তা পরিষদের অপর আটটি দেশ মার্কিন প্রস্তাবের অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো তাতেও ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে। নিরাপত্তা পরিষদে মোট দুই-দুইবার সোভিয়েত ‘ভেটো’র সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও সাধারণ পরিষদে ওই প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। প্রস্তাব উপেক্ষা করে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরঙ্কুশ সমর্থন এক্ষেত্রে বড় সহায়ক ছিল।
যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা এবং সামগ্রিকভাবে নৈতিক সমর্থন প্রদান করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে প্রায় পরাজিত পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে তার সপ্তম নৌবহরকে প্রেরণ করে। এর প্রত্যুত্তরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর প্রতি সম্ভাব্য মার্কিন হুমকি প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর এবং ১৩ ডিসেম্বর ভাদিভস্তক থেকে সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের দুই স্কোয়াড্রন ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার এবং পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি পারমাণবিক ডুবোজাহাজ প্রেরণ করে।
সোভিয়েত নৌবহরটির নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ভাদিমির ক্রুগ্লিয়াকভ। সোভিয়েত নৌবহরের আগমনের ফলে মার্কিন নৌবহর পাকিস্তানকে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়। সোভিয়েত নৌবহর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবহরকে তাড়া করে বেড়ায়। এছাড়া সোভিয়েত নৌবাহিনী গোপনে ভারতীয় নৌবাহিনীকে সহায়তা করে এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্ত অভিযান পরিচালনা করে।
এদিকে সপ্তাহখানেকের ভেতর পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেলে দুই নৌবহর বঙ্গোপসাগরে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ানোর আগেই চীন আকস্মিকভাবে ঘোষণা দেয়, তারা পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। চীনের এ ঘোষণায় স্তম্ভিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহরকে নিশ্চল করে ফেলে। এরপর ১৩ ডিসেম্বর আমেরিকার উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদে আবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠাণ্ডা মাথায় তৃতীয়বারের মতো তাতেও ‘ভেটো’ দেয়। অতঃপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না এবং বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর বাংলাদেশ রাশিয়ান ফেডারেশনকে এর উত্তরসূরি হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখে। রাশিয়া বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এজন্য রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলারের একটি সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে এবং এর আওতায় সেনাবাহিনীর জন্য ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মিসাইল ও সাঁজোয়া যান, বিমানবাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ জঙ্গিবিমান, পণ্যবাহী হেলিকপ্টারসহ নানা অস্ত্রসম্ভার সংগ্রহ করছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে মেতিস-এম ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ১৬টি ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান ক্রয় করে এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ছয়টি এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার ক্রয় করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা বিটিআর-৮০ সাঁজোয়া যান জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষার কাজে ব্যবহার করছে।
রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রচুর সুযোগ রয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন এবং কিছু শুল্ক জটিলতার কারণে রাশিয়ার সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাণিজ্য বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন জটিলতার কারণে বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে অন্য দেশের মাধ্যমে রাশিয়ার বাজারে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করছে। উভয় দেশের ব্যবসায়িক স্বার্থে এসব সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান করা জরুরি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৬৫.৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি করেছে এবং একই সময়ে আমদানি করেছে ৪৬৬.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য।
২০১২ সালে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ শক্তির উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালে রাশিয়া বাংলাদেশের পাবনা জেলার রূপপুরে ২,৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৯০ শতাংশ দেবে রাশিয়া সরকার। ২০১৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০২৪ সালের মধ্যে এর দুটি ইউনিট সম্পূর্ণ হবে বলে আশা করা যায়, যার প্রত্যেকটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রথম ইউনিটটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা ২০২২ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৩ সালে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। এ নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ তার বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ সবসময়ই বিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থেকেছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সুদৃঢ় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।
আজ ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে এবং এটা হবে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ঐতিহাসিক কারণে এবং বাস্তবতার নিরিখে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সৌহার্দপূর্ণ ও দৃঢ় সম্পর্ক ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়।
মো. জিল্লুর রহমান : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক
zrbbbp@gmail.com