কালো অক্ষরগুলোর শক্তি অনেক
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীর নিয়মটা খুব অদ্ভুত। খুব নির্মম। একজন কৃষক সারা পৃথিবীর মানুষের খাদ্যের জোগান দিলেও তাকে দুবেলা-দুমুঠো খাদ্যের জন্য চিন্তা করতে হয়।
সারা পৃথিবীর মানুষ তার শ্রমের খাদ্যকে নিয়ে বাণিজ্যিকীকরণ ও মহোৎসবে মেতে উঠলেও কৃষক ও তার পরিবারকে খাদ্যের অভাবে অনেক সময় অভুক্ত থাকতে হয়, হাহাকার করতে হয়। বড় বড় মানুষ কৃষকদের কখনো মূল্য দেয় না; অথচ কৃষকদের শোষণ করে যারা বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলে, তারা পৃথিবীর মহামূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়।
একজন শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইটের পর ইটের গাঁথুনি দিয়ে মানুষের জন্য দালানকোঠা গড়ে দেয়। শ্রমিকদের রক্ত পানি করা ত্যাগের বিনিময়ে আধুনিক পৃথিবীর সব সুযোগ-সুবিধা মানুষদের জন্য গড়ে উঠলেও শ্রমিকদের মাথা গোঁজার মতো একটা ছাদ থাকে না। চার দেওয়ালে আচ্ছাদিত একটা ঘর থাকে না।
রোদ, ঝড়, বৃষ্টি আর প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে একজন শ্রমিককে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হয়। শ্রমিকদের গড়া দালানকোঠা বাণিজ্যিক বাজারে অতি মূল্যবান পণ্য হয়ে উঠলেও শ্রমিকদের টাকার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। পৃথিবী শ্রমিকদের মূল্য দেয় না, পৃথিবীতে মূল্যবান হয়ে ওঠে শ্রমিকদের দ্বারা সুরক্ষিত মানুষরা।
আদিম যুগে মানুষ পাথরের সঙ্গে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাত। খুব অদ্ভুত একটা বিষয়, যে মানুষটা প্রথম পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর মতো বিস্ময়কর আবিষ্কারটি করেছিল, তাকে পৃথিবীর মানুষ চেনে না। যদি সেই অজ্ঞাত মানুষটা আগুন জ্বালানোর মতো সৃজনশীল চিন্তা করত, তবে বিদ্যুতের আবিষ্কার নিয়ে মানুষ হয়তো কখনোই ভাবত না। এভাবে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রেখে কিছু মানুষ হারিয়ে যায়। কারণ, মানুষটার কাছে তার নিজের চেয়ে তার সৃষ্টি অনেক বড়।
এমন করে অনেক নিভৃতচারী মানুষ পৃথিবী গড়ার জন্য পর্দার আড়াল থেকে কাজ করে যায়। কেউ তাদের মনেও রাখে না, কেউ তাদের খোঁজে ইতিহাসের খাতাটাও খোলে না। পৃথিবীতে অনেক প্রতিভাধর মানুষের জন্ম হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে তাদের প্রতিভার বিকাশের কথা কেউ ভাবছে না; বরং সেটিকে কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া যায়, সেই মনোভাব দ্বারা মানুষ তাড়িত হচ্ছে।
কেউ একজন এগিয়ে গেলে তাকে পা টেনে কীভাবে নিচে নামিয়ে নিজেকে ওপরে তোলা যায়, তার অসম প্রতিযোগিতা চলছে। যোগ্য মানুষরা পিছু হটতে হটতে নিজেদের একা করে ফেলছে। আর অযোগ্যরা সব জায়গায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে। অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে, যেখানে সত্যের মুখটা মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। মিথ্যের মুখটা সত্য হয়ে যাচ্ছে। যেখানে চিন্তাশীলতা, মেধা, ব্যক্তিত্ব, উদারতা পুড়ে মরছে তোষামোদি, টাকা, ক্ষমতা, সংকীর্ণতার কাছে। সব যেন উলটো করে হাঁটছে, বদলে যাচ্ছে মুখ। বদলে যাচ্ছে মুখোশ। বদলে যাচ্ছে রং। বদলে যাচ্ছে সময়।
এমন অনেক বিষয় পৃথিবীতে ঘটছে। যারা পৃথিবীকে গড়ছে, তাদের নিজের কোনো পৃথিবী নেই। যারা মানুষের জীবনকে আরও বিলাসবহুল করার জন্য জীবনবাজি রাখছে, তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোও পূরণ হচ্ছে না। এই বিপরীতমুখিতার পরিবর্তন কখনো কি ঘটবে বা জীবনের ভেতরে জীবনের এমন নগ্ন চেহারাটা নিয়ে মানুষ কি কখনো ভাবে? প্রশ্ন আছে অনেক, অথচ তার উত্তর নেই। গন্তব্য আছে অনেক, অথচ গন্তব্যের ঠিকানা নেই।
কৃষক, শ্রমিকের মতো খেটে খাওয়া মানুষরা অর্থনীতি বোঝে না, অথচ অর্থনীতিতে নিজেদের অজ্ঞাতেই নীরবে নিভৃতে অবদান রেখে যায়। বড় বড় মানুষ এই মাটি থেকে উঠে আসা মানুষদের অর্থনীতির পণ্য দেখে, রক্ত-মাংসের মানুষ হিসাবে দেখে না। জীবনবোধের গভীরতা দিয়ে তাদের দেখে না, যন্ত্র হিসাবে দেখে। সব অর্জনের স্বীকৃতি বড় বড় মানুষরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিলেও ছোট ছোট মানুষদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। ত্যাগী মানুষরা এভাবে শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত হতে থাকে; তারপরও মুখ ফুটে ‘টুঁ’ শব্দটিও করে না। কারণ তাদের সাদা মনে কোনো দাগ থাকে না।
লোভ-লালসা থাকে না। একটা সাদাসিধা জীবন থাকে। সে জীবনে একটা তরল মন থাকে। সে মনে একটা নদী থাকে, যে নদীর কোনো সমুদ্র থাকে না; নিজেই সমুদ্র হয়ে ওঠে। যারা বড় বড় মানুষের মারপ্যাঁচ বোঝে না, স্বার্থপরতা বোঝে না; তবে স্বপ্ন মন ভরে দেখে, জীবনের বোঝা টানার মধ্যে এক ধরনের সুখ অনুভব করে। যে সুখ টাকা-পয়সা, বিত্ত-বৈভব, বড় বড় পদ-পদবি, ক্ষমতা দিয়ে কেনা যায় না; জীবনের কঠিন সত্যের নান্দনিক রূপ থেকে পাওয়া যায়, যেখানে জয়-পরাজয় থাকে না, পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণা থাকে না, ক্ষমতার লড়াই থাকে না। সেখানে রাজনীতি নেই, রাজা নেই, রাজপ্রাসাদ নেই; অথচ যা থাকে, তা সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
মানুষের জীবন অনেকটা রেললাইনের মতো সমান্তরাল। যেমন মানুষের সুখটাও সমান্তরাল। যার সব আছে, তার সুখ নেই; অথচ যার কিছু নেই, তার সুখের শেষ নেই। সুখ অভাবের মধ্যে বাস করে, খুব বেশি করে পাওয়ার মোহ সুখকে খেয়ে ফেলে। কোনো হাইপোথিসিস এটা নয়, কোনো ফিলোসোপিও এটা নয়, এটাই হয়তোবা বাস্তব। জন্মের পর কেউ মা হারিয়ে মায়ের ভালোবাসা না পাবার বেদনায় সারা জীবন আহত থাকে।
মায়ের কথা মনে থাকে না তার, তারপরও একটা মায়াবী মুখ সে হাতড়ে বেড়ায়। আবার কেউ কেউ মায়ের ভালোবাসা পেয়ে বড় বড় মানুষে পরিণত হয়; অথচ সে ভালোবাসা মূল্যায়ন করতে পারে না। মা একদিন তাদের কাছে বোঝা হয়ে যায়। মায়ের মতো বাবাও বোঝা হয়ে যায়। পৃথিবীটা বুঝি এমনই। মাথার ওপরের বোঝাটাকে নামিয়ে সবাই দায়মুক্তি পেতে চায়। যেমন একজন মা অবৈধভাবে জন্ম দেওয়া সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে মানুষের পৃথিবী থেকে দায়মুক্তি পেতে চায়।
অথচ বিবেকের কাছে কখনোই সে দায়মুক্তি পায় না। মা তো মা, সে হোক বৈধ কিংবা অবৈধ, সে মাকে হয়তো কেউ চিনে না, জানে না; তারপরও সব দায় যেন সে মায়ের। কাল্পনিক একটা মুখের। অথচ এর ভেতরের আগাছা-পরগাছাগুলো কেউ খোঁজে না। মানুষ খোলা চোখে যা দেখে, সেটাই বিশ্বাস করে। চোখ বন্ধ করে মানুষ কখনো বিশ্বাসকে খোঁজে না। বিশ্বাস একটা আলোর মতো, সেটা আলোতে দেখা যায় না, অন্ধকারেই বিশ্বাসকে দেখতে হয়। উলটো দৃশ্যও পৃথিবীতে ঘটে।
একজন মা সন্তান জন্ম দিতে পারেনি বলে সারাটা জীবন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। সে কান্নাটা কাউকে কখনো সে দেখতে দেয়নি; বরং একটা হাসিমুখের অভিনয় করে যায় আমৃত্যু। এ দায়ও যেন সেই মায়ের, যদিও এখানে তার কোনো হাত নেই। কেউ চায় অথচ তা পায় না। কেউ চায় না অথচ তা পেয়ে যায়।
কখনো কখনো মানুষ জড়ের মধ্যে জীবনের সন্ধান পায়। বিজ্ঞান এটা মানে না; মানুষের কল্পনাপ্রবণ মন হয়তো সেটি মানা না মানার দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলে থাকে। যেমন একটা কাগজের বই। হয়তো বইয়ের রূপটা সাধারণ; কিন্তু বইয়ের ভেতরে পুঞ্জীভূত কালো অক্ষরগুলোর শক্তি অনেক। বই মানুষের ভেতর আরেকটা মানুষ তৈরি করে।
বইটা না পড়লে মানুষটা হয়তো জানত না, তার ভেতরে আরেকটা মানুষ আছে। অনেকে বলতে পারে, বই তো মানুষ লিখেছে। হয়তো বইটা মানুষ কোনো এক সময় লিখেছে। একদিন মানুষটা হারিয়ে গেছে; কিন্তু বইটা মানুষটার লেখক সত্তাকে যুগের পর যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। একটা সময় পর্যন্ত লেখক বইকে বাঁচিয়ে রাখে; কিন্তু সে সময় পেরিয়ে গেলে একটা বই অনন্তকাল ধরে একজন লেখককে বাঁচিয়ে রাখে।
মানুষ অদেখাকে দেখতে শিখুক, অচেনাকে চিনতে শিখুক। মানুষ গভীরভাবে ভাবুক, ভাবতে ভাবতে অতলের তলটিকে স্পর্শ করুক। সেখান থেকে নতুন নতুন ভাবনা ও বিশ্বাসের জন্ম হোক-যে ভাবনা ও বিশ্বাসগুলো অণুবীক্ষণ যন্ত্র হয়ে খুব ছোট ছোট জিনিসকে অনেক বড় করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর