বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও তার কার্টুনের বিষয়বস্তু হয়েছিল

পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
মৃত্যুর এক মহামিছিল চলছে, কে কখন হঠাৎ চলতে চলতে তার মধ্যে ঢুকে পড়ে বলা দুষ্কর। তবু এক দীর্ঘ ও মূল্যবান সৃষ্টিজীবন পার হয়ে, শতাব্দীছোঁয়ার মাত্র দুই বছর আগে প্রয়াত হলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের এক অসামান্য স্রষ্টা, যিনি নিজেকে গ্রন্থচিত্রী বলার চেয়ে ‘শিশুসাহিত্যিক’ বলতে বেশি পছন্দ করতেন।
তার ওই পছন্দের সঙ্গে আমরা শতকরা দুশ ভাগ একমত। তিনি আসলে কী ছিলেন আর কী ছিলেন না, তা আমরা এখানে একটু সন্ধান করব।
আমার মনে আছে, ছেলেবেলায়, মানে পূর্ববাংলার গ্রাম থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসে পশ্চিম বাংলায় আমাদের ১৯৪৭-৫৪-এর ছেলেবেলায়, দেব সাহিত্য কুটিরের বইগুলো-নানা ধরনের রহস্য-রোমাঞ্চ (যেমন, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘রাত্রির যাত্রী’ বা বুদ্ধদেব বসুর ‘ছায়া কালো কালো’), বা ‘রাঙারাখী’র মতো পূজাবার্ষিকী যখন আমরা কিনতাম বা বন্ধুদের কাছে চেয়েচিন্তে পড়তাম, তখন নারায়ণ দেবনাথ সেসবের শিল্পী হিসাবে আসেননি। সেখানে শিল্পী ছিলেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ণ চক্রবর্তী, শৈল চক্রবর্তী, সমর দে, বলাইবন্ধু রায়, ফণীন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ।
তাদের কেউ কেউ শরৎ সাহিত্য ভবন বা আশুতোষ লাইব্রেরির সঙ্গে হয়তো বেশি যুক্ত ছিলেন।
প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি করার কারণ আছে। ১৯৫০ সাল নাগাদ যখন নারায়ণ দেবনাথ দেব সাহিত্য কুটিরের প্রকাশনায় কাজ করতে শুরু করলেন, তখন তিনি যেন আখ্যানচিত্রণে খানিকটা প্রতুলবাবুকে অনুসরণ করতেন, এমনকি ছবির নিচের কোনায় সইও করতেন দু-লাইনে, উপরে নারায়ণ, নিচে দেবনাথ, আর প্রতুলবাবুর মতোই ডানদিকে দুটি স্ল্যাশ বা হেলনচিহ্ন দিয়ে। তখন তিনি গল্পের ছবিতে যেমন হয়-বাস্তবধর্মী ছবিই আঁকতেন, আর্ট কলেজে যা বাণিজ্যিক শিল্প বা কমার্শিয়াল আর্ট বিষয়ে পড়ানো হয়।
হ্যাঁ, তিনি পড়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। পূর্ববঙ্গের পুরোনো ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের এই সন্তানের পরিবার অনেক আগেই হাওড়ার শিবপুরে এসে পৌঁছেছিল। সেখানেই ১৯২৫ সালে নারায়ণের জন্ম হয়। পরে শিবপুর পাড়ার শৈশব-কৈশোর তার ‘হাঁদাভোঁদা’, ‘নন্টেফন্টে’দের সৃষ্টির পেছনে একটা বড় ভূমিকা নেয়। সোনা-রুপার পৈতৃক ব্যবসা ছিল, তাতে অলংকারের নানা ডিজাইনে দেখার এবং তাতে দাগা বুলোনোর সুযোগ ছিল নারায়ণের। তাই নারায়ণ অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন এইখানে যে, তার ছবি আঁকতে পাগলের মতো ভালো লাগত এবং শিল্পী হওয়ার জন্যই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যুদ্ধের অশান্তির মধ্যে কলেজের পরীক্ষা আর প্রথাগত ডিগ্রি লাভ তার হয়নি।
তবু তার নিজের যা শেখার তা তিনি শিখেছিলেন এবং তা নিয়েই তখনকার দুর্ভিক্ষ আর দাঙ্গাপীড়িত কলকাতায়-যেখানে যে কোনো জীবিকা ছিল দুর্লভ-অন্ন সংস্থানের প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন কয়েক বছর। কখনো প্রসাধনের লোগো বা মাস্টহেড এঁকে, কখনো বাংলা সিনেমার গল্প ও গান নিয়ে তখন যে ছোট বই বের হতো, তার ছবি এঁকে। একে কোনো জীবিকা বলা চলে না।
জীবিকার মতো একটা কিছু শুরু হলো, যখন ১৯৫০ নাগাদ তিনি দেব সাহিত্য কুটিরের (তখন ‘কুটীর’ বানান) পরিচালক সুবোধচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে পরিচিত হলেন। সেখানে তিনি কাজ শুরু করলেন ‘ইলাস্ট্রেটর’ হিসাবে।
সেখানে নারায়ণ দেবনাথ ‘নারায়ণ দেবনাথ’ হয়ে ওঠেননি প্রথমে। কারণ, ওই যে বলেছি, আখ্যান নির্মাণে তার ভূমিকা তো গৌণ, তিনি গল্পকে দৃশ্যমান করেন মাত্র, আসল রচয়িতা তো লেখক। তাতেও যে তার কুশলতা যথেষ্ট ছিল, তা দেব সাহিত্য কুটিরের কয়েক প্রজন্মের পাঠকরা উচ্চৈঃস্বরে বলবে, যার মধ্যে আমাদের প্রজন্মও আছে।
সেই সুযোগ এলো ১৯৬২ সালে। দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার সুবোধ মজুমদারের ভাই ক্ষীরোদ মজুমদারের পরামর্শে শুরু হলো বিদেশি পত্রিকার ধরনে কার্টুন ধারাবাহিক, ‘হাঁদা ভোঁদার জয়’ নামে। এই এক সিরিয়ালেই বাজি জিতে গেলেন নারায়ণ, তা বিপুলভাবে জনপ্রিয় হলো। শুধু কিশোর পাঠকদের কাছে নয়, তাদের অভিভাবকদের কাছেও। এর আগে ‘শুকতারা’ বড়রা পড়তেন, কিন্তু নারায়ণবাবুর এই নতুন উদ্যোগে তার বয়স-অতিক্রমী গ্রহণযোগ্যতা যেন অনেক বেড়ে গেল। পিসেমশায়ের আশ্রিত দুটি বালক, তাদের পরস্পরের দুষ্টুমির প্রতিযোগিতা এবং সব মিলিয়ে নানা কিম্ভূত ভন্ডুলকাণ্ড-নারায়ণের অসাধারণ উর্বর মস্তিষ্ক থেকে অবিশ্রান্ত ধারায় বের হতে লাগল।
আবার এরই মধ্যে এসে গেল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যাতে বাঙালির মনের মধ্যে এক বীর-উত্তম বা সুপার হিরোর কল্পনা অনুকূল বাতাস পেল, তৈরি হলো ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। কুস্তিগিরের মতো পোশাক পরা অতিকায় বক্ষদেশ ও উলটানো পিরামিডের মতো শরীরের বাঁটুল, যার গায়ে লেগে মেশিনগানের গুলি ছিটকে যায়, আর যে একাই একাধিক প্যাটন ট্যাঙ্ক রুখে দিতে, ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারে। তার শক্তি আর বুদ্ধিমত্তার সীমা নেই।
তার জন্য নারায়ণবাবু যাকে সম্ভব বলে তার দেওয়ালকে ভেঙে মাঠ করে দিয়েছেন। ‘হ্যারি পটার’ তবু জাদুর ক্ষমতায় জেতে, কিন্তু ‘বাঁটুল’ জেতে নিজের শক্তিতে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও বাঁটুলের কৃতিত্বের শোভাযাত্রা চলে এবং স্রষ্টার মৃত্যুতে তা শেষ হলো বলা যায়। এখানেই নারায়ণ একেবারে নিজেই স্রষ্টা, কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এক স্রষ্টা। তার ভূমিকা কোনো গল্পলেখকের চিত্রানুসারী হিসাবে নয়। হয়তো প্রাথমিকভাবে কিছু বিদেশি কার্টুন সিরিজকে তিনি আদল হিসাবে নিয়েছিলেন, যেমন জার্মান বশ্-এর Max and Monty, যার ইংরজি সংস্করণও বেরিয়েছিল, কিংবা হার্জ-এর Quick and Flupke, কিন্তু নারায়ণ ওই আদলগুলোকে বহুদূর পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন এবং বাঙালির মনে এক কার্টুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন।
আমাদের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে তার ‘রবিছবি’ বা স্বামী বিবেকানন্দের জন্মশতবর্ষের উদ্যোগে তার ‘রাজার রাজা’ চিত্রকথাগুলোর কথা মনে আছে। বা ১৯৬৪-র ‘শুক্তি মুক্তি’। কিন্তু সেগুলোও অন্যের লেখা, স্বনামধন্য ‘মৌমাছি’ ওরফে বিমল ঘোষের কাহিনি।
বরং কাফি খাঁ বা পিসিএল (প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী)-এর নেতাজির জীবন নিয়ে একটি চিত্রপুস্তকের কথা আমাদের মনে পড়ছে, যার রচনা আর চিত্রায়ণ কাফি খাঁ একাই করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে বিদেশ থেকে নেওয়া চিত্রের ফ্রেম সাজিয়ে গল্প বলার একটি ঐতিহ্য বাংলা সংবাদ-সাময়িকীপত্রে আগেও ছিল।
‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সাপ্তাহিক আনন্দমেলার পাতায় মৌমাছির গল্পের সঙ্গে ধীরেন বলের চিত্র থাকত, ‘যুগান্তরে’ (পশ্চিম বাংলার বিলুপ্ত সংবাদপত্র) হরেন ঘটকের ছড়ার সঙ্গে থাকত কাফি খাঁর কার্টুন। কিন্তু কাফি খাঁ ছাড়া একাধারে গল্পকার ও তার কার্টুনবদ্ধ রূপদাতা নারায়ণবাবুর মতো আর খুব বেশি ছিলেন না।
জানি না, কার্টুন তার ভেতরকার সমর্থ চিত্রশিল্পীটিকে আড়ালে নিয়ে ফেলেছে কি না। ফেললেও এ তার নিজের নির্বাচিত প্রকাশ, তিনি যেন কার্টুনকেই স্বক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছেন। এখানে তিনি যেমন স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তেমনই বাঙালি পাঠকও তার প্রাণঢালা অনুরাগ ও শ্রদ্ধা দিয়েছে, আখ্যান আর চিত্রকলার একক যুগলবন্দি-স্বরূপ নারায়ণ দেবনাথের প্রতি।
কার্টুনে তার শৈলীরও পরিবর্তন হয়েছে, যেমন হওয়ার কথা। আগেকার ত্রিমাত্রিকতাভিত্তিক বাস্তবসম্মত ছবির বদলে কার্টুনে মানবশরীরগুলোর বিকৃতি বা অতিরঞ্জন যেমন এসেছে, তেমনই সেগুলো রেখাপ্রধান দ্বিমাত্রিকতাকে মূলত আশ্রয় করেছে। তাতে কখনো হালকা বা গাঢ় লাল রং যোগ করেছেন লেখক। কিন্তু তিনি তো এখানে শুধু চিত্রকর নন, তিনি লেখকও বটে। এবং এক অনন্তভাবে সৃষ্টিশীল লেখক।
ক্রমে দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্গে থেকেও স্বাধীন স্রষ্টার মতো তিনি পত্র ভারতীর ‘কিশোর ভারতী’ মাসিকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, সেখানেও তার কার্টুন-কথা ‘নন্টে-ফন্টে’ প্রকাশিত হয়ে চলেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির স্মৃতিমেদুর হোস্টেল জীবন, তার সুপারিনটেনডেন্ট, bully চরিত্র কেল্টুদা-সব মিলিয়ে মহা জমজমাট আখ্যান। প্রতিটি চরিত্রের অমোঘ সংলাপ, আর ধ্বন্যাত্মক শব্দের কী মৌলিক উদ্ভাবন! আর নতুন নতুন প্লটের, প্লটের মধ্যে ঘটনার কী অনর্গল, অফুরন্ত, অনিঃশেষ এক প্রবাহ, কী অভিনব কল্পনা!
নারায়ণ দেবনাথ আসন্ন মৃত্যুভয়ের কানাকড়ি মূল্য না দিয়ে হাসপাতালের শয্যায় বসে ছবি এঁকেছেন, আজই এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে শুনলাম খবরটা। এখানে তিনি সব শিল্পী বা স্রষ্টার বেঁচে থাকার আর সৃষ্টি করার এক মডেল হয়ে ওঠেন, শ্রদ্ধায় তার প্রতি আমাদের মাথা নুয়ে আসে।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা