অন্যমত
এ বছরটা অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা মহামারির অস্থিরতা কাটিয়ে কিছুটা স্থিতাবস্থায় রয়েছে পৃথিবী; যদিও এখন করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়ছে।
কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে করোনার অভিঘাতের আশঙ্কা এখনো পুরোপুরি দূর হয়ে যায়নি। এর মধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কেমন যাবে কোভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতি? আসলে ২০২২ সালটি সবার জন্যই একটু চ্যালেঞ্জিং হবে। বলতে গেলে গ্লোবাল অর্থনীতির জন্যই এ বছরটি চ্যালেঞ্জিং।
কারণ ২০২২ সালে গ্লোবাল ইকোনমিক অস্থিরতা চলবেই। বিশ্বের অনেক দেশকেই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগোতে হবে। কারণ ইতোমধ্যেই বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে। এর ঢেউ বাংলাদেশেও লাগছে। বাংলাদেশকেও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই চলতে হবে।
পণ্য এবং জনশক্তি রপ্তানি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। করোনার ভয়াবহতা না বাড়লে আমাদের এ দুটি সেক্টরের পরিধি বাড়বে। পণ্য রপ্তানির কথা বলা যায় না; তবে জনশক্তি রপ্তানি হয়তো বাড়তে পারে। আমাদের এক্সপোর্ট বৃদ্ধি না পেলেও এক্সপোর্টের যে গ্রোথ লেভেল আছে, সেটা যদি বজায় রাখতে পারে, তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। যে বছরটি আমরা পার করলাম, সেটা মোটামুটি ভালোই গেছে বাংলাদেশের জন্য। আগের তুলনায় কিছুটা খারাপ থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে অতটা খারাপ যায়নি। কারণ বিশ্বের কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। আর এ খারাপ অবস্থাটি ছিল করোনা অভিঘাতের ফল।
২০২০ ও ২০২১-এ দুটি বছর করোনার মহামারির মধ্য দিয়েই কেটেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই লকডাউন থাকার ফলে অর্থনীতির চাকাও ছিল বন্ধ। কোনো কোনো দেশে অর্ধেক লকডাউন, আবার কোনো কোনো দেশে পুরো লকডাউন কার্যকর ছিল; যার কারণে রিটেইল ব্যবসা, পর্যটক থেকে আরম্ভ করে হোটেল ব্যবসা, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা ও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধের মতো অবস্থায় ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভোগের ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যে কারণে চাহিদা নিচের দিকে পড়ন্ত অবস্থায় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে ভোগ এবং চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়েছে। বিশ্বের অনেক শিল্প ও কলকারখানায় শ্রমিকদের ছুটিতে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এ কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা ধস নামে। বিশ্ব অর্থনীতির এ ধস থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অনেক দেশই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে আমরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় আমাদেরও ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হলে যেটা দরকার, সেটি হচ্ছে-পুর্ণোদ্যমে এক্সপোর্ট বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, নতুন নতুন বাজার ধরতে হবে। চীনা ও ভারতীয় বাজার আমাদের জন্য পার্সপেক্টিভ। চীন বিশ্বে প্রায় এক নম্বর অর্থনীতির দেশ। তবে চীনা মার্কেটে আমাদের অবস্থান তেমন মজবুত নয়। তাদের কাছে যা কিছু বিক্রি হয়, সেটার পরিসংখ্যান ওয়ান বিলিয়ন ডলারেরও কম। ভারতের বাজারে আমাদের প্রবেশও ওই একই রকমই। সুতরাং আমাদের ভারত ও চীনা মার্কেট ধরার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। চীন তো আমাদের ট্যাক্স রিলেটেড অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে; কিন্তু সে সুযোগ-সুবিধাগুলো আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারছি, সেটাই হলো দেখার বিষয়। ভারতও আমাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে; কিন্তু সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে।
আমাদের বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ নিজে নিজে উন্নতি করতে পারবে না। বাংলাদেশ যতটা উন্নতি করে বা করবে, সেটা গ্লোবাল ইকোনমির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দুবাইয়ে আমরা কোনো অ্যাগ্রিমেন্ট সাইন করতে পারিনি। যদিও ভিয়েতনাম এ ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিশ্বের অনেক দেশই এগিয়েছে। বলতে গেলে আমাদের আশপাশের অনেক দেশই এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। তাহলে আমরা পিছিয়ে থাকব কেন? বাংলাদেশ বিশ্বের কাছ থেকে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো আগে থেকেই পেয়ে আসছিল, সেগুলো নিয়েই পড়ে আছে। ওই ভিত্তিতেই চলছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ বৃত্তবলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙা করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের পরিধি বাড়াতে হবে। আমাদের বসে থাকলে চলবে না। আমি মনে করি, গ্লোবালি কোনো ইকোনকিম অ্যাসোসিয়েশন বা ফ্রি ইকোনমিক জোনের সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া উচিত। যেখানে যেখানে আমাদের বাই-লেটারাল প্রসপেক্ট আছে, সেখানে সেখানে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে মজবুতভাবে সংযুক্ত করতে হবে। এজন্য আমাদের যা যা করা দরকার, তা করতে হবে; হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
২০২২-এ কিছু সুখবর হয়তো আমাদের আসতে পারে; সেটি হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হয়ে যেতে পারে, ঈশ্বরদীতে অ্যাটোমিক পাওয়ার প্ল্যান্টও অনেকটা শেষ হওয়ার পথে থাকবে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার কথা। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে টানেল চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এগুলো যদি চালু হয়ে যায়, সেটি আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে। কারণ সরকার এসব মেগা প্রকল্প অনেক অর্থ ব্যয়ে সাহসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সফলভাবে এ কয়েকটি মেগা প্রকল্প যদি শেষ করতে পারে, সেটি বাংলাদেশের চেহারা অনেকটা পালটে দেবে। কারণ এ মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে দেশে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেকাংশেই বাড়বে। দেশের অর্থনীতি অনেকটা চাঙা হয়ে উঠবে।
তবে ২০২২-এর অর্থনৈতিক দৃশ্যপটও যে ২০২১ সাল থেকে অনেক বেশি ভালো হবে, এটাও আশা করা ঠিক হবে না। কেননা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যেই রিপোর্ট আসতে শুরু করেছে, বিশ্বে খাদ্য সম্পর্কিত মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশের সামনে যে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেটি হলো চাল আমদানির বিষয়টি। চাল আমদানিতে বাংলাদেশের আমদানি মূল্য অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। কেননা বিশ্বে খাদ্য সম্পর্কিত মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে বাংলাদেশের চাল আমদানির সময় গ্লোবালি প্রাইস বাড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ যেসব মার্কেট থেকে পণ্য আমদানি করবে, সেখানে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। এতে অভ্যন্তরীণ মার্কেটে চালের দাম বা চালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে আইটেমগুলো রয়েছে, সেগুলোর দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকার আশঙ্কা খুব বেশি। এতে করে গরিব মানুষের জীবনযাত্রা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরিব যারা, তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাদের আগের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
অপরপক্ষে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বাড়তে পারে অথবা বর্তমানে দারিদ্র্যের সংখ্যা যে পর্যায়ে রয়েছে, সে পর্যায়েই থাকতে পারে। ইতোমধ্যেই ডলারের বিপরীতে ইন্ডিয়ান রুপি অনেক মূল্য হারিয়েছে। শ্রীলংকার রিজার্ভ প্রায় শূন্যতে চলে এসেছে। বাংলাদেশে একটা সুবিধা এখনো আছে, ৪৫ বিলিয়ন ডলার আমরা অফিশিয়ালি রিজার্ভ দেখাতে সক্ষম হয়েছি, যেটা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে দীর্ঘমেয়াদি ট্রেড ইমব্যালেন্স যদি চলতে থাকে, তাহলে এক্সটার্নাল সেক্টরে অনেকটা চাপ পড়তে পারে।
ইউএস ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকাও মূল্য হারাচ্ছে। এ টাকার মান আমাদের যতটা ধরে রাখা যায়, ততটা আমাদের অর্জন হবে। এ ধরনের বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের টাকার ভ্যালু হয়তো কমতে পারে। কিন্তু সেটি দ্রুত যাতে না কমে, সেদিকে নজর দিতে হবে। বেশি ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আশা করা ঠিক হবে না। এখানে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন; সেটি হলো, বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুটি বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়টি সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। সামাজিক অস্থিরতা না কমে বরং বাড়তে পারে। অবশ্য এটা নির্ভর করবে সরকারের পলিসির ওপর। জাতি যদি একটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে পারে, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান নিজে থেকেই হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের অর্থবছর; যেটা চলতি বছর জুলাই থেকে শুরু হতে যাচ্ছে, সেখানে যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ বজায় রাখা যায়, সেটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন হবে। ৭.৫ হলে তো আরও ভালো। এখানে আমি একটা কথা বলে রাখতে চাই, ব্যাংকিং সেক্টরের ওপরে একটা চাপ পড়ছে। ব্যাংকিং সেক্টর কু-ঋণ বা অনাদায়ি দেনা নিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এ কারণে ইতোমধ্যেই কয়েকটি ব্যাংক প্রায় অকার্যকর অবস্থায় আছে। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। কুঋণ আদায়ের জন্য সরকার প্রণোদনাও দিচ্ছে। তবে কিছু কিছু প্রণোদনার অপব্যবহারও হচ্ছে। সরকারকে এসব ব্যাপারে কঠিন অবস্থান নিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা উচিত। কেননা পুরো পৃথিবীতেই ঋণগ্রস্ত অর্থনীতি বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাংলাদেশের একটা সুবিধা এখনো আছে আর সেটি হলো, বাংলাদেশ অতটা ঋণগ্রস্ত নয়। কিন্তু পাবলিক এক্সপেনডিচার যদি কমাতে না পারে বা সুশৃঙ্খলভাবে না রাখতে পারে, তাহলে সরকারি ঋণ অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে। সেটা পুরো অর্থনীতির জন্য একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
এজন্য আমি মনে করি, সরকারের রেভিনিউ এক্সপেনডিচারের ওপর লাগাম টেনে ধরা উচিত। অন্তত এক বছরের জন্য হলেও পাবলিক সেক্টরে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন করা উচিত। আমি বলব না যে, প্রকল্পগুলোতে এটা চালু করা হোক। প্রকল্পগুলো তার সঠিক গতিতেই চলতে থাকুক। তবে প্রকল্পগুলোয় সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিত। যে কোনো প্রকল্প সিলেকশনের সময় অনেক চিন্তাভাবনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ অনেক প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক বেশি খরচ দেখানো হচ্ছে। দেখা গেছে, অনেক প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ এবং এ কারণে দেশের অর্থনীতিতে একটা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এগুলো যেন দেখার কেউ নেই।
সরকারের উচিত হবে এ বিষয়গুলো সামনে এনে সঠিকভাবে মনিটরিং করা। প্ল্যানিং কমিশনেরও এ বিষয়টি দেখা উচিত যে, আমরা যেসব প্রজেক্ট দিচ্ছি, সে প্রজেক্টগুলোয় টাকার সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি না; নাকি দুর্নীতির মাধ্যমে সিস্টেম লস হচ্ছে। একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত, জনগণ তাদের কষ্টার্জিত টাকা থেকে সরকারকে ট্যাক্স দেয়। জনগণের এ কষ্টার্জিত টাকার অপব্যবহার যেন না হয়। এ টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
আবু আহমেদ : অর্থনীতিবিদ; সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়