
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৮:০১ এএম
একটি ব্রিজ বদলে দিতে পারে গ্রামীণ চিত্র

এমএ খালেক
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন
সম্প্রতি দুদিনের ব্যক্তিগত সফরে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার পাকুল্যা এলাকায় গিয়েছিলাম। আমি যে গ্রামে যাই তার নাম শুকতা। এটি একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের সঙ্গে এ গ্রামের তেমন কোনো পার্থক্য বা ভিন্নতা নেই। তবে গ্রামটি বর্ধিষ্ণু বলেই মনে হলো। আবহমান বাংলার চিরাচরিত সাধারণ দৃশ্যসংবলিত গ্রামটি দেখতে খুবই সুন্দর। গ্রামের মানুষগুলোর আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো বলেই অনুমিত হলো। আমরা ঢাকা থেকে সড়কপথে পাকুল্যা যাই। সেখানে গিয়ে আমরা মেইন রোড থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে মাহমুদপুর ঘাট পর্যন্ত যাই। মাহমুদপুর ঘাটের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে ঢাকার ধামরাইয়ের দিকে। এ রাস্তাটি বেশ সুন্দর এবং প্রশস্ত। রাস্তা নির্মাণে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে।
কিন্তু মাহমুদপুর ঘাটে নামার পর আমরা বিপাকে পড়ে যাই। এরপর আর গাড়ি যাবে না বলে আমাদের জানানো হলো। মির্জাপুর থানার ছয় আনাইতারা ইউনিয়নের মাহমুদপুর ঘাটটি যে শীর্ণ নদীর পাড়ে অবস্থিত, সেই নদীর ওপর কোনো ব্রিজ নেই। ফলে সাধারণ মানুষকে হেঁটে নদী পার হতে হয়। আমরাও হেঁটেই নদী পার হলাম। নদীটি (আসলে এখন একে খাল বলাই শ্রেয়) শুকিয়ে গেছে। নদীর তলদেশ কর্দমাক্ত। আমরা সেই কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে নদীর অপর পাড়ে চলে গেলাম। সেখান থেকে আমাদের উদ্দিষ্ট শুকতা গ্রামের দূরত্ব এক কিলোমিটার বা তারও কিছু বেশি হবে। আমরা ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়িতে সওয়ার হয়ে রওনা দিলাম। কিন্তু রাস্তা এতটাই সরু এবং ভগ্ন যে, পড়ে যাওয়ার ভয় মন থেকে কখনোই দূর করতে পারছিলাম না। ভ্যানের ঝাঁকুনিতে গা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আমাদের যাত্রাপথের দুদিকে সরষে আবাদ করা হয়েছে। সরষে ফুলের গন্ধে মন ভরে যাচ্ছিল আনন্দে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভ্যান গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ভাবনায় ছেদ পড়ছিল। রাস্তা এমনই সরু যে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
একটি প্রবাদ বাক্য মনে পড়ে গেল। একজন রসিক ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল/কিছুদূর গিয়া মর্দ রওনা হইল।’ সম্ভবত এমন কোনো রাস্তা দেখেই উল্লেখিত রসিক ব্যক্তি এ প্রবাদটি রচনা করেছিলেন। যাহোক আমরা ভ্যানে বেশ মজা করেই যাচ্ছিলাম। নির্জন দুপুরে চারদিকে সুনসান নীরবতা ভালোই লাগছিল। মাঝে মাঝে ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। পরে জেনেছি এ এলাকার মানুষ বন্য পশু-পাখির কোনো ক্ষতি করে না। ফলে এরা নিরাপদেই এ জনপদে বসবাস করছে মানুষের প্রতিবেশী হয়ে। আমরা এক সময় উদ্দিষ্ট গন্তব্যে উপনীত হলাম। যাওয়ার পথে একটি বিষয় লক্ষ করলাম। রাস্তার পাশে পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাঁশ অথবা রশি বেঁধে ভ্যান গাড়ির যাত্রা রোধ করছে। তারা বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে চাঁদা আদায় করছে। বয়স্ক ব্যক্তিরাও কাছে বসে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের কাছে এটি হয়তো নিছক একটি বিনোদন মাত্র। কিন্তু এ ধরনের বিনোদনের ভবিষ্যৎ ক্ষতিকর দিক কি কেউ ভেবে দেখেছে? এভাবে চাঁদাবাজিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর তারা এক সময় এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই অভিভাবকদের উচিত হবে এ ধরনের কাজে কোনো উৎসাহ না দেওয়া। কারণ বিনোদন হোক বা যাই হোক, কোনোভাবেই এমন কাজকে উৎসাহিত করা উচিত নয়।
উদ্দিষ্ট গন্তব্যে উপনীত হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে এলাকা পরিদর্শনে বেরোলাম। প্রথমেই আশপাশের এলাকার কয়েকটি বাড়িতে গেলাম। তারপর সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে স্থানীয় বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হলো। আমার সঙ্গে ছিলেন শুকতা মধ্যপাড়া জামে মসজিদের পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি মো. মুজাম্মেল হক। তিনি এলাকায় একজন সম্মানিত ব্যক্তি এবং সমাজকর্মী হিসাবে পরিচিত। বাজারে বেশ কয়েকজন ইউপি মেম্বার পদপ্রার্থীর সঙ্গে আলাপ হলো। তারা নিজ নিজ প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে নির্বাচনী এলাকায় কোনো কোনো প্রার্থী পেশিশক্তির দাপট দেখাচ্ছেন বলে তারা অভিযোগ করেন। যাই হোক, তারপরও এলাকার নির্বাচনি আমেজ দেখে বেশ ভালোই লাগলো। কোনো কোনো প্রার্থী নির্বাচনের দিন সহিংসতা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। এলাকার লোকজন জানালেন, তাদের এলাকার উন্নয়নের জন্য মুহমুদপুর ঘাটসংলগ্ন এলাকায় একটি পাকা ব্রিজ নির্মাণ করা খুবই জরুরি। এ নদীর অপর পাড়ে অনেক গ্রাম রয়েছে। এসব গ্রামের মানুষ ব্রিজের অভাবে তাদের নিত্যদিনের কার্যসম্পাদন করতে বেশ অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন। শুকতা, চর বিলশা, টেগরি, শেওয়াইল, দত্তপাড়া ইত্যাদি গ্রামে প্রায় ৫/৬ লাখ মানুষ বাস করেন। যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে এসব গ্রামের মানুষকে খুবই অসুবিধা ভোগ করতে হচ্ছে। গ্রামগুলো মির্জাপুর থানার শেষ প্রান্তে অবস্থিত বলে জেলার মূল এলাকা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। একজন জানালেন, গ্রামগুলো আওয়ামী লীগসমর্থিত এলাকা হিসাবে পরিচিত। কিন্তু বর্তমান সরকার আমলেও এ এলাকার উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। এলাকায় বসবাসকারীদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যোগাযোগ ব্যবস্থার এ দুর্গতির কারণে এলাকার মেয়েদের ভালো বিয়ে হচ্ছে না। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে পছন্দ হলেও এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তারা শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান। এসব গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এলাকাটি কার্যত কৃষিপ্রধান। এখানে যে ফসল উৎপাদিত হয়, তা যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে কৃষক সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না। একটি এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য দুটি উন্নয়ন উপকরণের সমন্বিত উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিদ্যুৎ। এ দুটি উন্নয়ন উপকরণ সমন্বিতভাবে কোনো এলাকায় থাকলে সেই এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। সরকার উন্নয়ন করবে না। উন্নয়ন করবে স্থানীয় জনগণ। কিন্তু সরকারকে উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামো তৈরি করে দিতে হবে। এটাই নিয়ম।
উপরোল্লেখিত এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু শুধু উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এ এলাকাটি এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। বর্তমান সরকার আমলে দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এ এলাকাটি কেন যেন দৃষ্টিসীমানার বাইরে রয়ে গেছে। একটি ব্রিজ নির্মিত হলে এসব গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র পালটে যেতে পারে। এলাকার মানুষজন অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। তারা কারও করুণা বা দয়া চায় না। তারা একটি ব্রিজ এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ পাওয়া একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো এ এলাকাগুলো এখনো উন্নয়নের ছোঁয়াবঞ্চিত রয়েছে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন আমরা যতই বলি না কেন, সেই উন্নয়ন যদি সামান্য কিছু এলাকাকেন্দ্রিক হয়, তাহলে সেটি কোনোভাবেই কার্যকর এবং টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। শরীরের সব রক্ত মুখে এসে জমা হলে তাকে যেমন সুস্বাস্থ্য বলা যায় না, তেমনি কোনো অঞ্চলকে বঞ্চিত করে বিশেষ কোনো এলাকা নিয়ে মেতে থাকলে তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না। দেশের সব এলাকাকে সমভাবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল টেকসই এবং সঠিক উন্নয়ন হতে পারে। তার আগে দেশের প্রতিটি এলাকাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে ডেভেলপমেন্ট জোনিং করা যেতে পারে। কোন এলাকায় কীভাবে উন্নয়ন হতে পারে তা নির্ধারণ করা খুবই প্রয়োজন।
এ এলাকায় যারা বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে মাহমুদপুর ঘাটসংলগ্ন খাতে পাকা ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের সেই প্রতিশ্রুতি পরবর্তীকালে রক্ষিত হয়নি। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের সবাই কোনো না কোনোভাবে এ ব্রিজ নির্মাণের জন্য অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরে এ এলাকার মানুষকে হতাশ হতে হয়েছে। বর্ণিত গ্রামগুলোর একদিকে রয়েছে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানা এবং অন্যদিকে ঢাকার ধামরাই থানা। সাটুরিয়া ও ধামরাইতেও যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মির্জাপুরের এ গ্রামগুলো এখনো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এলাকাগুলোতে বসবাসকারীদের মধ্যে অনেকেই শিল্প-কারখানা স্থাপনের মতো আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন। তারা চাইলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবদান রাখতে পারেন। এ গ্রামগুলোর অনেকেই কর্মসংস্থান উপলক্ষ্যে বিদেশে অবস্থান করছেন। তারাও এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার এ দীনতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এলাকার মাটি বেশ উর্বর। এখানে সামান্য পরিশ্রমে যে কোনো ফসল উৎপাদিত হতে পারে। গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে প্রচুর ফসল ফলে। আমি একদিন দুরাত এ এলাকায় ছিলাম। এলাকার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, তারা এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য মুখিয়ে আছে। এখন শুধু প্রয়োজন উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া। এটি তাদের নৈতিক ও মানবিক দাবিও বটে। আমরা প্রত্যাশা করব, জরুরি ভিত্তিতে মাহমুদপুর ঘাটসংলগ্ন নদীর ওপর একটি পাকা ব্রিজ নির্মাণ করে এলাকার মানুষের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা হবে। একটি পাকা ব্রিজ এবং পাকা সড়ক নির্মিত হলে এলাকার কর্মঠ লোকজন নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই করতে পারবে।
মির্জাপুরের এ অঞ্চলটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসাবে পরিচিত। গত ২০ বছর ধরে এ সংসদীয় আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। এলাকার মানুষ সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়। কিন্তু একটি পাকা রাস্তা ও ব্রিজের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এলাকার অনেকেই বলেন, এ নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ইতোমধ্যেই ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু এসব তথ্যের কোনো বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এলাকার মানুষ শুধু এটাই জানে যে, তাদের এখনো কর্দমাক্ত নদীতল পেরিয়ে পারাপার হতে হয়। আর কতদিন তারা একটি পাকা ব্রিজের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনবে?
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমন্টে ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক