Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশপ্রেমের চশমা

স্বপ্নভঙ্গের নানা এপিসোড

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নভঙ্গের নানা এপিসোড

মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। সে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়। স্বপ্ন দেখে বলেই মানুষ কাজকর্মে উৎসাহ পায়। স্বপ্ন না থাকলে মানুষ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে তার সব কাজকর্মে। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ এখন স্বপ্ন দেখতে পারেন না। তারা স্বপ্ন দেখতে ভয় পান। বারবার স্বপ্ন ভেঙে পড়ায় তারা কাজকর্মে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। তবে কিছু অসৎ, দুর্নীতিবাজ মানুষের স্বপ্ন আছে। এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা সব সময় স্বপ্নে বিভোর। এরা বড় বড় স্বপ্ন দেখেন। সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন। স্বপ্ন সফলও করতে পারেন। কারণ, তাদের হাত বড়। সব জায়গায় লোকজন আছে। আছে নেটওয়ার্ক আর টাকা। অনেক টাকা। সেই টাকার বর্ণ সাদা না কালো তা না বলাই ভালো।

অবৈধ পথে উপার্জনকারীরা স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রায় সবার সহযোগিতা পান। সহযোগিতা পান রাজনীতিবিদ, আমলা, এমনকি সরকারেরও। কালো টাকার পরিমাণ বেশি হলে সে টাকা সাদা করতে এরা সরকারের সহায়তা পান। ফলে আমলা আর রাজনীতিবিদদের সহায়তা অর্জনে এদের অসুবিধা হয় না। এরা দেশে বিনিয়োগ করেন। বিদেশেও টাকা পাচার করে গড়ে তোলেন সম্পদের প্রাচুর্য। এদের সন্তানরা বিদেশে লেখাপড়া করেন। সর্দি-কাশি হলে চিকিৎসার জন্য এরা চেন্নাই, বামুনগ্রাদ বা কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে যান। সরাসরি রাজনীতি না করলেও এদের একটি অনিবন্ধিত দল আছে। সে দলের নাম এজিবি (অলওয়েজ গভর্নমেন্ট পার্টি)। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সখ্য সৃষ্টিতে এরা পেশাদার। এদের চোখে সম্পদ বৃদ্ধির স্বপ্ন লেগে থাকে। নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করলে ব্যাংক এদের ঋণ দেয়। এরা ঋণ পরিশোধ না করেও অনেক সময় পার পেয়ে যান। পার পাওয়ার অনেক রাস্তা এদের জানা। সে রাস্তায় ট্রাফিক আছে। তবে তারা এদের বাধা দেওয়ার পরিবর্তে সালাম দেন। এরা স্বাচ্ছন্দ্যে সম্পদ বৃদ্ধির গাড়ি চালান। স্বপ্নে বিভোর হয়ে সময় কাটান।

এখন একটি ‘গণতান্ত্রিক’ দাবিদার সরকার ক্ষমতায়। নাগরিক মনে স্বপ্ন নির্মাণ করা সরকারের কাজ। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও দুর্নীতিবাজদের মনে স্বপ্ন নির্মাণে সফল। দু-এক সময় ছোট দুর্নীতিবাজদের সাজা হলেও বড় দুর্নীতিবাজদের কিছুই হয় না। তারা ইউরোপ-আমেরিকায় বিনিয়োগ করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা জমান। সরকার এদের হয়রানি করেন না। হিসাবের ভুলচুক হলে এদের অনেককে অনেক সময় থানায়, কোর্টে বা দুদকে যেতে দেখা যায়। তবে পরে আবার তারা হাসিমুখে বের হয়ে আসেন। জেলে গেলে এরা বেশিরভাগ সময় কাটান হাসপাতালে। সব মিলিয়ে একটি শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি দেশে বেশ সক্রিয়।

তবে সরকার সাধারণ মানুষের মনে স্বপ্ন নির্মাণে ব্যর্থ। নাগরিক সমাজ দ্রব্যমূল্যের চাপে অতিষ্ঠ। দেশের অধিকাংশ কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষ দ্রব্যমূল্যের চাপে অতিষ্ঠ। তারা কষ্টের জীবনযাপন করছেন। সরকারি চাকরিজীবীদের কথা অবশ্য ভিন্ন। তারা মাস গেলে বেতন পান। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছেন। গ্রামে তাদের কাজ নেই। অনেকেরই জমি নেই। অন্যের জমি চাষ করেন। এদের একটি বড় অংশ অর্থ উপার্জনের তাগিদে শহরে ভিড় করেন। শহরে এসে কেউ রিকশা চালান। কেউ গার্মেন্টসে কাজ খোঁজেন। কেউ কাজ পান। কেউ পান না। কাজ পেলে বাড়িতে বিকাশ-নগদে টাকা পাঠান। আবার অনেকে দালালের পাল্লায় পড়ে জমি বিক্রয় করে মধ্যপ্রাচ্যে যান। কেউ সফল হন। আবার কেউ হন প্রতারিত। নারী গৃহকর্মীদের অনেকে স্বপ্ন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে যুগপৎ স্বপ্ন ও সম্ভ্রম হারিয়ে দেশে ফেরেন।

সবচেয়ে খারাপ খবর হলো, দেশের যুব ও ছাত্রসমাজের চোখে স্বপ্ন নেই। এরা যতদিন লেখাপড়া করেন, ততদিন একটি স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে থাকেন। এদের অনেকের ঘাড়েই বিসিএসের ভূত চাপে। কিন্তু লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। এদের কয়জন স্বপ্নের হরিণের দেখা পান? আর মেধাবী হলেই যে এরা এ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে চাকরি পাবেন, এমনটি বলতে পারলে ভালো হতো। এসব পরীক্ষায় সবসময় যে ফেয়ার প্লে হয় এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সবচেয়ে মন্দ বিষয় হলো, বিসিএস পরীক্ষার ভাইভায় ২০০ নম্বর থাকা। তদবির ও সুপারিশ কালচারের দেশে এটি ৫০ বা ১০০ নম্বর হলে ভালো হতো। এ রকম মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় একজন পিএসসি সদস্য সাধারণত ভাইভা বোর্ডের সভাপতিত্ব করে থাকেন। কাজেই এদের কাছে যে শহরের প্রভাবশালী পরিবারের প্রার্থীদের পক্ষে কোনো অনুরোধ আসে না, এমনটি বলা যায় কি? কাজেই যেসব প্রার্থীর মন্ত্রী ও বড় আমলা আত্মীয়স্বজন আছেন, তারা এ পরীক্ষায় তদবির করার সুযোগ পান বলে অভিযোগ শোনা যায়। গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পক্ষে তদবির করার লোক না থাকায় তাদের অনেকে যোগ্য হলেও তাদের বিসিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন সফল হয় না।

কেবল সাধারণ মানুষ বা শিক্ষার্থী সমাজেরই যে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে তা নয়। বিরাজিত সামাজিক ব্যবস্থায় নাগরিক সমাজ, সুশীলসমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবীকে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এমন কোনো অফিস-আদালত নেই, যেখানে সবকিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পাদিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, বিচারাঙ্গন, শিক্ষাঙ্গন, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, ক্রীড়াঙ্গন, এমনকি আর্থিক খাতেও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচন, ভোট, নির্বাচনি প্রচারণায়ও চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। এমন বিশৃঙ্খলা ও হয়রানির মধ্যে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে কি? বিরাট সম্ভাবনা থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগ করতে এসে পদে পদে হয়রানির শিকার হন। এ কারণে অনেক বিনিয়োগকারী এ দেশে বিনিয়োগ না করে ফিরে যান। কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেও এ বিশৃঙ্খলা দূর করা যাচ্ছে না।

যারা বাংলাদেশকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ মনে করে এ দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চান, তারা পদে পদে হয়রানির শিকার হন। আমি নিজের উদাহরণ দিতে পারি। শিক্ষকতার সূত্রে বিদেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে একাধিকবার আমি সেখানে থেকে যাওয়ার সুযোগ পাই। কিন্তু দেশপ্রেমের টানে বিদেশে না থেকে দেশে চলে আসি। এজন্য আমি কখনো মনে করিনি যে আমি ভুল করেছি। অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও নিজের দেশে বাস করার আনন্দ আছে। কিন্তু দেশে আসার পর শিক্ষকতা করতে গিয়ে পদে পদে বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখি ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি চর্চার তীব্রতা। হল দখল, সিট দখল, ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বের সংস্কৃতি, শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যদের বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে অযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া, বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া, ক্যাম্পাসে ধাওয়া-পালটাধাওয়া এবং আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা হতে দেখে ব্যথিত হই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্মানিত শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে স্বাধীনতা ভোগ করার স্পৃহা প্রবল হলেও দায়িত্ব পালনের প্রবণতা জোরালো নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানেই যখন এমন বিশৃঙ্খলা, তখন অন্য সব প্রতিষ্ঠানে যে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে তা অনুমেয়। এহেন বিশৃঙ্খলার কারণে এখন আর বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত বিদেশি শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে আসেন না।

শ্রমিক সস্তা হওয়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চান। কিন্তু পদে পদে বিশৃঙ্খলা দেখে তাদের অনেকেই বিনিয়োগ করতে এসে দুর্নীতিসহ নানাবিধ হয়রানির শিকার হয়ে বিনিয়োগ না করে অন্য দেশে গিয়ে বিনিয়োগ করেন। এর ফলে দেশে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়। এ হয়রানি ও বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচার উপায় কী? অবিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকার যদি দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে মনোযোগী হয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে ক্রমান্বয়ে মানুষের এ হয়রানি কমতে পারে। এখন নাগরিক সমাজ তাদের দৈনন্দিন জীবনে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

বাজারে গেলে সিন্ডিকেটবাজদের কারসাজিতে বর্ধিত মূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে হচ্ছে। রাজধানীর বিশেষ বিশেষ এলাকায় বাড়ি করতে গেলে চাঁদাবাজদের চাঁদা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। রাজধানী থেকে ট্রেনে করে গ্রামে যেতে চাইলে টিকিটের জন্য কালোবাজারিদের শরণাপন্ন হতে হয়। বাসে গেলে দুর্ঘটনার দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। লঞ্চেও নিরাপত্তা নেই। কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় নদীর মধ্যে লঞ্চে আগুন লেগে নিহত হওয়ার ভয় থাকে। এত হয়রানি আর ঝুঁকি নিয়ে মানুষ কীভাবে বাঁচবে? কীভাবে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখবে? এ কারণে বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের স্বপ্নগুলো নিষ্প্রভ হয়ে আসছে। বেকারত্বের ভয়ে অনেকেই, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবসমাজের একটি অংশ বিদেশে গিয়ে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিক যোগ্যদের অনেকে ইউরোপ-আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন। অন্যরা তা না পারলে সম্প্রতি জার্মানি, রাশিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি দেশে যেতে চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য একটাই। যুবসমাজ নিজ দেশে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বেকার না থেকে তাদের স্বপ্নপূরণের জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এ ব্রেইন-ড্রেইন দেশকে মেধাশূন্য করছে। এ থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে যুবসমাজকে দেশেই তাদের স্বপ্নপূরণের সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যে কোনো কর্ম উদ্যোগ যেন হয়রানির মুখে না পড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম