Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মোটরসাইকেল চলাচল হোক ঝুঁকিহীন

Icon

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মোটরসাইকেল চলাচল হোক ঝুঁকিহীন

বিলাসিতা নয়, প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ মোটরসাইকেল কেনে, ব্যবহার করে। আর গণপরিবহণের স্বল্পতা ও যানজটের এ নগরীতে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে এ দুই চাকার বাহনটির উপযোগিতাও অনেক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত ৫০ লাখ যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলই প্রায় ৩৪ লাখ, যা মোট যানবাহনের প্রায় ৭০ শতাংশ।

বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। শুধু ঢাকাতেই নিয়মিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। বাংলাদেশে প্রতি ৪৮ জনে, ভারতে প্রতি ২০ জনে এবং পাকিস্তানে প্রতি ১৭ জনে একজনের মোটরসাইকেল আছে। উন্নয়নশীল দেশ যেমন-থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে ব্যক্তিগত যানবাহন হিসাবে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক। আমরাও হয়তো সেদিকে ধাবিত হচ্ছি। তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা মোটরসাইকেলের ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল নিয়ে। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চলাচল ব্যাপক সড়ক দুর্ঘটনা, বহুবিধ বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণে কত তরুণের প্রাণ যে ঝরে যাচ্ছে, কত মানুষ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, তা অনেকেরই মাথায় নেই। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর হিসাবমতে, ২০২০ সালে দেশে সংঘটিত ৩ হাজার ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেলজনিত দুর্ঘটনা। এর চালক ও আরোহীদের মধ্যে তরুণই বেশি। যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৭৯ শতাংশের বয়স ছিল ২১ বছরের কম।

আমাদের ছেলেরা রাস্তাঘাটে যেভাবে মোটরসাইকেল চালায়, তা দেখে গা শিউরে ওঠে। বিদঘুটে শব্দের হর্ন বাজিয়ে পাগলা ঘোড়ার গতিতে চারদিক প্রকম্পিত করে চালাতে গিয়ে তারা শুধু নিজের জীবনই বিপন্ন করে না, একইসঙ্গে পথচারী ও অন্যান্য যানবাহনেরও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেখা যায়, কখনো হেলেদুলে, কখনো জোরে চালিয়ে, প্রচণ্ড শব্দ করে ফুটপাতের উপর দিয়ে পাশাপাশি চলমান দুই মোটরসাইকেলে আরোহী বন্ধুরা হাত ধরাধরি করে চালাচ্ছে।

শহর, বন্দর, পাড়া, মহল্লায়, রাজপথ থেকে শুরু করে সরু গলি সবখানেই তাদের অবাধ চলাচল, কোথাও তারা নিয়মনীতি মেনে চলে না। তাদের কে বোঝাবে? কে শেখাবে? কিছু বলতে গেলেই দুর্ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে আমাদের দেশের তুলনায় আরও বেশি মোটরসাইকেল চলে, কিন্তু ওখানে আশপাশ দিয়ে মোটরসাইকেল গেলে ভয় লাগে না। আর আমাদের এখানে কেন ভয়ে কুঁকড়ে যেতে হয়, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।

বুয়েটের সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে এবং এসব দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশ ঘটে মফস্বল এলাকায়। পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর বাইরে থেকে আসা আহতদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আগত রোগীদের বেশিরভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়া দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ।

পঙ্গু হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসা নিতে আসা ৮০/৯০ শতাংশ রোগী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শিকার। কোনো কোনো সময় (রাতের বেলা) চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শতভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। বেশিরভাগ রোগীর অবস্থাই খারাপ থাকে, হাত-পা কেটে ফেলতে হয়, অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।

মোটরসাইকেল বিপণনকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানির পর্যালোচনা মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে যানবাহনের বেপরোয়া চালনা, ওভারটেকিং ও হুটহাট লেন পরিবর্তন, ভাঙাচোরা রাস্তা, রাস্তার চেয়ে ম্যানহোলের উঁচু অথবা নিচু ঢাকনা, অপ্রয়োজনীয় গতিরোধক, পথচারীদের অসতর্ক চলাচল অন্যতম।

‘রাইড শেয়ারিং’ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ সন্দেহ নেই, এর মাধ্যমে বেকার তরুণ ও যুবকদের কর্মসংস্থানের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। কোটির উপরে জনবসতির এ মহানগরীতে হাজার হাজার তরুণ-যুবকের ভাগ্য রচিত হচ্ছে। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে স্বকর্মসংস্থানের এ পদ্ধতি তাদের আরও বড় ও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করছে। একইসঙ্গে ব্যাপক জনসংখ্যার এ মহানগরীতে স্বল্প আয়ের মানুষের যাতায়াতকে সহজ করেছে।

দ্রুত ও স্বল্প খরচে যে কোনো গন্তব্যে, বিশেষত অফিস বা কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করতে পারছে। অন্যদিকে আবার রাইড শেয়ারিং দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়িয়ে দিয়েছে। কী এর কারণ? দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেকার যুবকদের অনেকেই রাজধানীতে আসছে। ঝটপট ভাগ্য ফেরানোর আশায় যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই মোটরসাইকেলে উঠে বসছে, অনভিজ্ঞ নবিশরা না চিনে শহরের রাস্তা, না বোঝে ট্রাফিক সিগন্যাল, না জানে ঠিকভাবে চালাতে, ফলে দুর্ঘটনা হয়ে উঠছে তাদের নিত্যসঙ্গী। বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে, এতে দেখা যায় ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের ‘ড্রাইভিং’ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই আরোহীদের আস্থাশীল রাখার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে।

বাজারে নিম্নমানের হেলমেট রাইড শেয়ারিংয়ে ব্যবহার করা হয়। দুর্ঘটনায় এগুলো চালক ও আরোহীকে সুরক্ষা দিতে পারে না। হাসপাতালের রিপোর্টমতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশ রোগী মারা যায় মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ার কারণে, মানসম্পন্ন হেলমেট ব্যবহারে আহত অনেকেই হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভালো মানের হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ।

মোটরসাইকেল রাস্তায় বের করার আগে চালককে নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা যাচাই এবং বাহনটির প্রতিটি যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে হবে। বেপরোয়া গতি পরিহার করতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা এমনিতেই কমে যাবে। এজন্য বাহনটির চালকদের মোটিভেট করতে হবে। আর এ ব্যাপারে পরিবারকেই সবার আগে উদ্যোগ নিতে হবে।

দুই চাকার বাহনের ভারসাম্য এমনিতেই নাজুক। তার ওপর যদি হেলমেট না পরে, হ্যান্ডেল না ধরে, দুহাত ছেড়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে, হেলেদুলে, ইচ্ছামতো লেন পরিবর্তন করে মোটরসাইকেল চালানো হয়, তাহলে মনোযোগ বিঘ্নিত হতে বাধ্য। ফলে দুর্ঘটনার মাত্রা ও হার বাড়তে থাকে। আমাদের তরুণরা এগুলো নিয়মিতই চর্চা করে যাচ্ছে। এসব বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় মোটরসাইকেলের জন্য রাস্তায় পৃথক লেন করে দিয়ে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা গেলে। তাহলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।

ঝড়-বৃষ্টির কারেণে রাস্তা পিচ্ছিল থাকায় সময় যানবাহন চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রায় ৩৮ শতাংশ ঘটছে বৃষ্টির মৌসুমে রাতের বেলা। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই সময় মোটরসাইকেল না চালানোই ভালো।

বাংলাদেশে মোটরসাইকেল চালানো শেখার কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের অভাবে অধিকাংশ চালকেরই যথোপযুক্ত দক্ষতা থাকে না, ফলে দুর্ঘটনা হয়ে যায় নিত্যসঙ্গী। তাই চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের ‘হোম ডেলিভারি’ ব্যবস্থা বিগত বছরগুলোতে একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে করোনাকালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর এ কাজে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যানজটের এ শহরে ফাঁকফোকর গলিয়ে, ফুটপাত মাড়িয়ে শর্টকাটে পথ অতিক্রমে মোটরসাইকেলের জুড়ি নেই। এর চলাচল যদি ঝুঁকিহীন বা কম ঝুঁকিপূর্ণ থাকত, তাহলে অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী এ যানটি একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বাহনে পরিণত হতো। গতির প্রতি চালকের মাত্রাজ্ঞানহীন দুর্বলতা একে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাহনে পরিণত করেছে।

আমাদের এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। পরিবার, শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে এসব আলোচনা করতে হবে। বাইকারদের ধীরস্থির হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। মোটরসাইকেলে বসে নিজেকে ভিনগ্রহের বাসিন্দা ভাবলেও আকাশে যেমন ভেসে বেড়ানো যায় না, ঠিক তেমনি পৃথিবীটাও রঙিন হয়ে যায় না। স্বপ্নবিলাসী তরুণ-যুবকদের বোঝাতে হবে এবং তাদের মন-মগজে গেঁথে দিতে হবে- ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে বীরত্ব প্রকাশ করা বা হিরো হওয়া যায় না, তাতে শুধু জীবনবিনাশী বিপদকেই আহ্বান করা হয়।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী

snagari2012@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম