Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

Icon

তন্ময় চৌধুরী

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

শেকসপিয়রের কালজয়ী নাটক ‘হ্যামলেটে’র প্রথম অঙ্কে রাজপ্রাসাদের প্রহরীকে ঘোর অমানিশার মাঝে দাঁড়িয়ে বলতে শোনা যায়, ‘Something is rotten in the state of Denmark’। রাজহত্যা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে ছা-পোষা এক প্রহরীর ছোট মন্তব্য পাঠককে হ্যামলেট নাটকের পুঁতিগন্ধময় রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। শেকসপিয়রের মুনশিয়ানা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। কথা হচ্ছে, অমানিশা আর অনিশ্চয়তার মাঝে দাঁড়িয়ে ডেনমার্কের এই প্রহরীর যে ‘আত্মজিজ্ঞাসা’, তা আজকের বিশ্বমোড়ল আমেরিকার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে দেওয়া ভাষণে গণতন্ত্রের কথিত চ্যাম্পিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (ইউডিএইচআর) প্রতি বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বিশ্বকে নিরাপদ ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকারও করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সবার প্রতি নজর রাখতে গিয়েই বোধহয় যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়েছে; যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায়। ডেনমার্কের মতোই নিজ ঘরে পচনের উৎস খুঁজে বের করা তাই অত্যন্ত জরুরি।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ল্যানসেটে’র একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩৯ বছরে (১৯৮০-২০১৯) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে প্রায় ৩২ হাজার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে শুধু ২০১৯ সালেই ঘটে ১ হাজার ১৯০টি ঘটনা। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এ হত্যাগুলোর সঙ্গে বর্ণবাদের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে, কারণ পুলিশের সহিংসতায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি। ল্যানসেটের সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার ৮০০, সরকারি তথ্যের সঙ্গে যার ফারাক প্রায় ১৭ হাজার ১০০। অর্থাৎ প্রায় ৫৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশি হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রতিবেদন ঠিকমতো দাখিল করা হয়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের বর্ণবাদী ভাবনা সর্বজনবিদিত হলেও ক্ষমতাসীন বাইডেন প্রশাসনের অধীনেও বর্ণবাদী পুলিশি সহিংসতা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সংকট উত্তরণে বাইডেনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ২০২১ সালে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে ৯৯৬ জন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের আইনে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুরক্ষা রয়েছে। এর ফলে এসব হত্যাকাণ্ড বহুলাংশে বিচারের আওতামুক্ত থাকে।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঝান্ডাধারী মার্কিন মুলুকে কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের ধারণা এখনো দাসত্ব ও উপনিবেশবাদ সময়ের ভাবনার মাঝেই আটকে আছে। গত বছর করোনা মহামারির মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়। মাস দুয়েক আগে ফ্লয়েডের মতো আরেক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ব্রেওনা টেইলরও একই পরিস্থিতির শিকার হন। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই দরজা ভেঙে ব্রেওনার ঘরে ঢুকে পড়ে সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা, এরপর টানা ৩২ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয় ব্রেওনার পরিবারকে লক্ষ্য করে। ফ্লয়েড ও টেইলর তাই যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যবশত, সব ভুক্তভোগীই ব্রেওনা ও ফ্লয়েডের মতো মিডিয়ায় সমান মনোযোগ পায় না। ম্যাপিং দ্য পুলিশ ভায়োলেন্সের (এমপিভি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালে পুলিশ কর্তৃক মোট নিহতের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ২৮ শতাংশ, অথচ আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ।

উল্লেখ্য, কোভিড মহামারির মধ্যে লকডাউনে অনেক জরুরি সেবা এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলেও খোলা ছিল বন্দুকের দোকান। প্রতিবেদন মতে, বন্দুক বণিকদের মদদপুষ্ট সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) তদবিরেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় মার্কিন প্রশাসন। গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ২০২০ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই কোটি বন্দুক বিক্রি হয়েছে।

৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা এবং ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও জাতীয় নিরাপত্তা সমুন্নত রাখার যুক্তি দেখিয়ে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আর ভিকটিমদের আটকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় ‘আবু গারিব’ ও ‘গুয়ানতানামো বে’র মতো কারাগারগুলো। ২০১০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া বিষয়ক বৈশ্বিক সমস্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ‘এনফোর্সড ডিসপ্যারেন্স প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। আশ্চর্যজনকভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে সোচ্চার আমেরিকাই ‘আইসিপিপিইডি’ কনভেনশনটি অনুমোদন করেনি। বিদেশের মাটিতে যখন মানবাধিকারের কবর রচনা করে চলছিল বুশ প্রশাসন, তখন ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টে’র মতো বিতর্কিত ও নিপীড়নমূলক আইনের মাধ্যমে খর্ব করা হচ্ছিল নাগরিক অধিকার। আইনটিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা, গোপনীয়তার লঙ্ঘনকে চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের রূপ বলা চলে।

‘ফরেন পলিসি’তে প্রকাশিত কলামিস্ট চার্লি কার্পেন্টারের বক্তব্য অনুযায়ী, টার্গেটেড কিলিং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তবে ৯/১১-এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রতিনিয়ত এ আইনগুলো লঙ্ঘন করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইরানের সামরিক কৌশলবিদ কাশেম সোলাইমানি। এ কারণে ড্রোন হামলায় এ নেতাকে হত্যা করা হয়। ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ৯/১১-এর পর দীর্ঘ ২০ বছরে মার্কিন ড্রোন ও বিমান হামলায় কমপক্ষে ২২ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এসব আইন লঙ্ঘনের পরও জেনারেল সোলেইমানির হত্যাকে যুক্তরাষ্ট্র ‘ন্যায়সঙ্গত’ বলে উল্লেখ করেছে এবং মার্কিনিদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেয় পেন্টাগন।

এসব অপরাধ সংঘটিত হওয়ার জন্য মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারের ভূমিকাকে দায়ী করছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বিদ্যমান ‘ক্যাসল ডকট্রিন’ এবং ‘স্ট্যান্ড ইওর গ্রাউন্ড’ আইনের ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। সম্ভবত সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

একটি দেশ প্রতিনিয়ত নিজ দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উপেক্ষা করে যখন অন্য দেশের মানবাধিকার প্রসঙ্গে কথা বলে, তখন বিষয়টি অনেক বেশি অসংলগ্ন দেখায়। এসব মানবাধিকারের বুলি মূলত বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের প্রতি বাধা এমন দেশগুলোকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার। ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনিজুয়েলা ও চীনসহ বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নানা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে হয়েছে। মূলত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রক্ষার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় টার্গেটেড ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার মূল উদ্দেশ্য থাকে এসব দেশকে রাজনৈতিকভাবে চাপের মধ্যে রেখে নিজ স্বার্থ হাসিল করা। অন্যদিকে, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনকারী মিত্রদেশ ইসরাইল ও সৌদি আরবের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সৌদি আরব শুধু মিত্রদেশই নয়, মার্কিন যুদ্ধাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতাও বটে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সৌদি আরব মোট যে পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র কিনেছে, তার ৬০ শতাংশই কেনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসব যুদ্ধাস্ত্র পরে ব্যবহার করা হয়েছে ইয়েমেনে আগ্রাসনের ক্ষেত্রে, যাতে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার শিশুও। অর্থাৎ নিজের যুদ্ধাস্ত্রের খদ্দেরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে মুখে কুলুপ আঁটতে বাধে না এই বিশ্বমোড়লের।

নির্বাচনি প্রচারণায় যেমনটা বলা হয়েছিল-বাইডেন প্রশাসন যদি সত্যিই বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসারে আন্তরিক হয়-তবে ওয়াশিংটনের উচিত হবে প্রথমে নিজের ঘর সামলানো। উগ্র ডানপন্থি, নব্য নাৎসি এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের উত্থান-সব মিলিয়ে আমেরিকার ডান রাজনীতির এখন বল্গাছাড়া দশা। বলা যায়, ৪৩তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে কোনো একক সমস্যা ছিলেন না, বরং তার উত্থান ছিল আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে পুরোনো ও বহুমুখী পচনের একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বছরের পর বছর ধরে আমেরিকার কথিত প্রগতিশীল বা মধ্যপন্থি ডেমোক্র্যাট পার্টির পাহাড় সমান ব্যর্থতা আর শঠতাই ডোনাল্ড ট্রাম্পদের সৃষ্টি করেছে। বলা বাহুল্য, পরবর্তী ‘ট্রাম্প’ কট্টরপন্থায় পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে যাবেন। মার্কিন মানবাধিকারের ‘প্রকৃত’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার বৈদেশিক নীতির লঙ্ঘন, দ্বৈততা ও ‘অনৈতিক’ দিকগুলো পরিহার করতে হবে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় দেশটির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

লেখক: গবেষক ও লেখক

ctonmoy555@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম