ফিরে আসুক বাহাত্তরের সংবিধান

মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পা রেখেছে বাংলাদেশ। একটি রক্তাক্ত ও মৃত্যুময় মহাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। পূর্বসূরি বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার মিশ্রণ ঘটিয়ে বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত করেন শেখ মুজিব। ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। মুক্তিকামী, দিশেহারা জনতাকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ণতা দেন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় সূচিত হয় রক্তস্নাত বাংলাদেশের।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এক অলৌকিক কল্পনামাত্র। জীবনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার আদায়ে আপসহীন ছিলেন। জুলুম-নিপীড়ন-অত্যাচার সহ্য করেও তিনি আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকার বারবার তাকে জেলবন্দি করেছে, ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছে, তবু মাথানত করেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু এক দুঃসাহসী অভিযাত্রিক। নিষ্পেষিত পূর্ববঙ্গের মানুষের বেদনার কান্না তার কণ্ঠে বজ্রধ্বনি হয়ে উচ্চারিত হয়েছিল। লাখ লাখ শোষিত বাঙালির সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান বাঙালি জাতিকে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম করে কীভাবে একটি উপনিবেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপ দেওয়া যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধু তা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে গেছেন। বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ একটি আধুনিক ধারার রাজনৈতিক মতবাদ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। শ্মশান বাংলাকে ‘সোনার বাংলা’ হিসাবে গড়ে তুলতে তিনি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোর বাস্তবায়ন করা গেলে সত্যিকার অর্থেই বাংলা ‘সোনার বাংলা’ হয়ে উঠত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে ঘাতকের গুলিতে সপরিবারে নিহত হন বাংলার জননায়ক বঙ্গবন্ধু। তার আকস্মিক মৃত্যুতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি শাসনক্ষমতা দখল করে দেশকে সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে দিতে থাকে। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, হত্যা ও দুর্নীতির কবলে পড়ে দিকভ্রষ্ট হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা বিকৃত হতে থাকে ক্ষমতাবানদের ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীদের হাতে। একটি প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় বেড়ে ওঠে। তাদের মনোজগৎ এখনো পাকিস্তানি মৌলবাদী ভাবাদর্শ দ্বারা আচ্ছন্ন।
দীর্ঘ একুশ বছর লড়াই-সংগ্রাম করে, বিকৃত ইতিহাসের পাহাড় ঠেলে জয়ী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পিতার মতোই মৃত্যু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার দৃঢ় নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ইতোমধ্যে তিনি যেসব ‘মেগা’ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। দেশবিরোধী শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে, বিদেশি এজেন্টদের দুরভিসন্ধি ধ্বংস করে সত্যিই যদি বাংলার বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা মোটেই অসম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি প্রধানত তিনটি ধারায় বিভক্ত ছিল। এ তিনটি ধারা হলো-গণতান্ত্রিক ধারা, বাম প্রগতিশীল ধারা ও ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী ধারা। গণতান্ত্রিক ও বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারা এক সময় বেশ সক্রিয় হলেও এখন বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে। বাম প্রগতিশীল নেতাদের ক্ষমতার লোভ ও জনবিচ্ছিন্নতা তাদের ছিন্নভিন্ন করে শক্তিহীন করে ফেলেছে। এদের ব্যর্থতার সুযোগ পুরোটাই কাজে লাগিয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। দেশি-বিদেশি এজেন্টদের আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতায় এরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটাই ডান দিকে হেলে পড়েছে। এটা অশনিসংকেত বলেই মনে হয়। অবক্ষয়ের পথ ধরেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ দল, অন্যদিকে ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী। এ দুই ধারা আজ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। বাম প্রগতিশীল ধারা নিস্তেজ হয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ডানপন্থি দলগুলো এক হয়ে গণতান্ত্রিক আওয়ামী ধারার রাজনীতিকে পরাজিত করতে সক্ষম হলে বাংলাদেশ হবে মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য।
আজ অনেকেই অন্ধের মতো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের বিরূপ সমালোচনা করেন। যারা আওয়ামী লীগের সমালোচক তারা কী অস্বীকার করতে পারবেন, আওয়ামী লীগের আশ্রয়টুকুই আজ বাঙালির শেষ ঠিকানা। সুবিধাবাদী, ভীরু, দুর্বল আদর্শের রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার কারণে বাম প্রগতিশীল ধারার শক্তি সঞ্চয় তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগের প্যারালাল কোনো গণতান্ত্রিক দলও গঠন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এটা দেখে লজ্জা পাই যে, জনপ্রতিনিধিরাও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে ভাষণ-বক্তৃতা দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এমন চরমতম দুঃসাহস অনাকাঙ্ক্ষিত। অসংখ্য ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে হবে।
দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকলে সে দলে কিছু দুর্বৃত্ত এসে যোগ দেয়। এসব দুর্বৃত্ত দুর্নীতি করে দলকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ শোষণ নয়, দুর্নীতি নয়, জনগণের সেবা। সেবার আদর্শ নিয়ে যারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আসবে তারাই সত্যিকারের মুজিব সেনা। দুর্বৃত্তদের কুকর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাপক উন্নয়ন করেও আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এখনই যদি এসব দুর্বৃত্তকে শাস্তি দিয়ে দমন করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
বর্তমান উন্মত্ত পৃথিবীতে সব দেশই কমবেশি করোনা দুর্যোগের শিকার। যে কোনো মহামারির মুহূর্তেই মানুষ কিছুটা স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু মানুষকে আরও বেশি আতঙ্কিত ও অসহায় করে তুলেছে। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আঁধার ঘিরে এলেও বাংলাদেশ এখনো কিছুটা সবল আছে বলেই বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে বাংলার নিরন্ন মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ঘটিয়ে একটি নতুন আর্থসামাজিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান আওয়ামী লীগই প্রথম তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। বিজ্ঞান-প্রযুুক্তি খাতে বিপ্লব ঘটাতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানো দরকার। যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করে নতুন যুগের বাঙালি সন্তানদের উপযুক্ত করে তৈরি করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। সোনার বাংলার পাশাপাশি তিনি একটি শোষণ-নিপীড়নহীন মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থা প্রত্যাশা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে যেভাবে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন, তাতে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হচ্ছে। বাংলাদেশকে উন্নত বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলেই বিপর্যয় অনিবার্য।
ঘাতকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই তার নাম মুছে ফেলা যাবে এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আজ বঙ্গবন্ধুর নাম আকাশে-বাতাসে জ্বলজ্বল করছে। তার নামে ইতিহাসে আজ নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে উদ্যাপিত হচ্ছে তার জন্মশতবর্ষ। সূর্যের মতো আলো ছড়িয়ে শোষিত মানুষকে পরিবর্তনের উত্তাপ জোগাচ্ছেন তিনি। তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের এ সময় বাংলাদেশ বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করুক এমনটাই এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক জনগণের প্রত্যাশা। আশা করি, বাহাত্তরের সংবিধান প্রবর্তন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে লেখা বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ