Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বয়ে বেড়াচ্ছি পরিবারের পাঁচ সদস্য হারানোর স্মৃতি

Icon

ডা. সৈয়দ আকতার ফারুক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বয়ে বেড়াচ্ছি পরিবারের পাঁচ সদস্য হারানোর স্মৃতি

জীবনের অনেক অর্থ থাকতে পারে। আমার কাছে এটা একটা স্মৃতির ডাইরি, যার পাতায় পাতায় রয়েছে সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, আনন্দ-বেদনার ঘটনা। কিছু দুঃখের স্মৃতি মানুষকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়, যা পার্থিব কোনো আনন্দ কিংবা প্রাপ্যতায় পূর্ণ হয় না। আমার এবং আমার পরিবারের জন্য ৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালের দিনটি মুক্তিযুদ্ধের অন্য ২৬৬ দিনের মতো ছিল না। সেদিনও ভোর হয়েছিল, বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছিল। অন্ধকারময় রাত এসেছিল-এ রাত সম্ভবত আমাদের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘায়িত আর চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনী হয়ে থাকবে।

আমাদের সাত ভাই-বোনের মধ্যে আমি মেজ এবং ১৯৭১ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। আমার বাবা শহিদ মো. বদিউজ্জামান চট্টগ্রাম বন্দর মেরিন ওয়ার্কশপে চাকরি করতেন এবং সেই সুবাদে আমরা সবাই পোর্ট কলোনির একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতাম। সবচেয়ে ছোট দুই-ভাই ছাড়া অন্য সবাই স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী। সবচেয়ে বড় ভাই সদ্য সেনাবাহিনীতে কমিশন পদে ক্যাডেট হিসাবে নির্বাচিত হয়ে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র বোনটি পোর্ট গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া। আমাদের স্নেহময়ী মা এতগুলো ভাই-বোনকে পরম যত্নে বড় করে তুলছিলেন এক বুক স্বপ্ন নিয়ে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর পোর্ট এলাকা ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে পড়ছিল। সম্ভবত মার্চের ২৯/৩০ তারিখের দিকে নিরাপত্তার কথা ভেবে বাবা আমাদের পোর্ট এলাকায় হাইস্কুল কলোনিতে স্থানান্তর করলেন। নিজ বাসা ছেড়ে অন্য একটি বাসায় অজানা শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাতে থাকলাম। এরই মধ্যে আমার সবচেয়ে ছোট চাচা তাহের আহমেদ সিদ্দিক পূর্ব পাকিস্তানের কর্মস্থল ত্যাগ করে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। বাবা-মা ও ছোট চাচা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়াই অধিক শ্রেয় ও নিরাপদ মনে করলেন। ৬ এপ্রিল প্রত্যুষে যাওয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলো।

দিনগুলো কাটছিল অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার মধ্যে। বাবা অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, রাতের আঁধারে আমি আর বড় ভাই চুপি চুপি ব্যাগ নিয়ে বের হতাম বাজারে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে। যা পেতাম তাই নিয়ে আসতাম-পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগ ছিল না। মাছ-মাংসের স্বাদ ভুলে যেতে বসলাম। আমাদের মা পান পছন্দ করতেন; কিন্তু বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে চাইতেন না সন্তানদের। এক রাতে বড় ভাই কিভাবে যেন কিছু পান নিয়ে আসতে পেরেছিলেন মায়ের জন্য। এটাই ছিল আমাদের মায়ের মুখের শেষ আনন্দের স্মৃতিচিহ্ন।

অবশেষে এলো ৬ এপ্রিল। ভোরবেলা উঠে সবাই তৈরি হলাম। যৎসামান্য প্রস্তুতি, ভারী কোনো কিছু নেওয়া যাবে না, দীর্ঘপথ হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। স্পষ্ট মনে আছে, মা আমার ভোরে উঠে সবার জন্য গরম ভাত আর মিষ্টি কুমড়া ভাজি করেছিলেন। এমন খাদ্য সংকটের মধ্যে, বিদ্যুৎ নেই পানি নেই, তবুও মা কাঠের চুলায় সবার অন্নের সংস্থান করেছেন। মায়ের হাতের ওটাই ছিল শেষ খাবার। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মিষ্টি কুমড়ার তরকারি দেখলে মায়ের মুখ আর সেদিনের সকালের কথা মনে পড়ে যায়। নিজের অজান্তেই বুকভরা কষ্টের এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হারিয়ে যাই সেই দুঃখস্মৃতি বেদনা-ক্ষণে। হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে কষ্টগুলো হু হু করে কান্নার অশ্রু হয়ে দুচোখ বেয়ে পড়ে।

ছোট চাচাসহ আমরা দশজন বেরিয়ে হাইস্কুলের মাঠে জড়ো হলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী আরও পাঁচ-ছয়টি পরিবার, যাদের গন্তব্য ছিল গ্রামের বাড়ি মিরেরশ্বরাই, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলায়। মনে পড়ে, পরিবারপ্রধানরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা বলে আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করেন পোর্টসংলগ্ন হালিশহর গ্রাম দিয়ে ফৌজদারহাটের দিকে। সেখানে অপেক্ষমাণ ছিল আমাদের বহনকারী বাসগুলো। লক্ষ করলাম, গ্রামের মধ্যে কোলাহল নেই, তেমন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। বরং আমাদের গমনাগমনে কিছুটা নীরবতা ভেঙে সরব হয়ে উঠেছিল জনপদ।

আমার মনের মধ্যে একটা অজানা শঙ্কা কাজ করতে শুরু করল। মনে হলো ২৫ মার্চ কালো রাতের পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতার ছায়ায় ঢেকে গেছে সমগ্র গ্রামাঞ্চল। পুরুষশূন্য গ্রামের চিত্র আমাকে আরও বেশি বিচলিত করেছিল। আমার মাত্র দুই বছরের সবচেয়ে ছোট ভাইকে কোলে-পিঠে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা গ্রাম পেরিয়ে সাগর পাড়ে পৌঁছালাম। বন্দরগামী রেলওয়ে পথকে অনুসরণ করে সবাই কাট্টলী রেলওয়ে ব্রিজ অতিক্রম করার আগমুহূর্তে সব নীরবতা ভঙ্গ করে গ্রামের মধ্যে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। আমরা সবাই সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে গেলাম। এর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি এবং আমাদের মধ্যে আগে-পিছে দুটি দলে ভাগ হয়ে গেছে।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম পূর্বদিক থেকে গ্রামের সবুজ বেষ্টনী ভেদ করে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে ছুটে আসছে এবং সঙ্গে একদল বেসামরিক লোক, যাদের হাতে মনে হলো লাঠি আর ধারালো তরবারির মতো কিছু। পরে জানলাম তারা হালিশহরে থাকা ক্যাম্পের বিহারি। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। আমরা যারা সামনের দিকে ছিলাম, তারা সামনের একটা ছোটখাল অতিক্রম করে ফৌজদারহাটের দিকে দৌড়াতে থাকলাম আর পেছন ফিরে ফিরে দেখছিলাম কী ঘটছে।

দেখলাম আমাদের পেছনের দলকে তারা ঘিরে ফেলেছে- সেখানে আমার বাবা, মা আর একমাত্র বোনটি ছিল। এটা দেখে আমার অন্য দুই ভাই, যারা আমার সঙ্গে ছিল, তারা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে আবার পেছনে ফিরে গিয়ে বাবা-মা-বোনের সঙ্গে যোগ দিল। তারপর কী হলো কিছুই বুঝতে পারিনি। সেদিন আমাদের ছোট চাচা সঙ্গে না থাকলে হয়তো আমরা চার ভাই বেঁচে থাকতাম না। তিনি আমাদের আগলে ধরে নিয়ে এসেছিলেন ফৌজদারহাট বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে বড় ভাইকে (যিনি সেনাবাহিনীর কমিশন পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন) রেখে এসেছিলেন পরিস্থিতি দেখে সম্ভব হলে সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে।

আমরা দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরলাম। ক্লান্ত-শ্রান্ত বিধ্বস্ত সবাই অজানা শঙ্কায় কান্নাকাটি করছিলাম। আমার সবচেয়ে ছোট অবুঝ দুই ভাই মায়ের জন্য অঝোরে কাঁদছিল। গভীর রাতে বড়ভাই বাড়ি ফিরলেন একা। সবার একটি প্রশ্ন-বাবা-মা-বোন ভাইরা কোথায়? কোনো উত্তর নেই ভাইয়ার মুখে। শুধু কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন সব শেষ হয়ে গেছে বলে। ঘাতকরা আমাদের পরিবারের পাঁচজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে।

সন্ধ্যা অবধি তাদের সেখানে পাহারা দিয়ে রেখেছিল, যাতে লাশ কেউ নিতে না পারে। ওরা সন্ধ্যার পর চলে গেলে আমার ভাই গ্রামের কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কোনোরকমে পাঁচটি লাশ দাফন করেছিলেন রাতের অন্ধকারে। সেদিন পাকসেনাদের সহায়তায় বিহারিরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে আমার নিরপরাধ বাবা, মা, দুই ভাই আর একমাত্র বোনকে। তাদের নিথর দেহ সেই জায়গায় মাটিচাপা ছিল এদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাঁচটি কবর স্থানান্তর করে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

আজ সোনার বাংলা স্বাধীন হয়েছে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে। অজানা শহিদের ভিড়ে হারিয়ে গেছে হাজারো নাম। একদিন হারিয়ে যাবে আমার পিতা-মাতা-ভাই-বোনদের নামও। দীর্ঘ ৫০টি বছর বুকে ধারণ করে আছি শুধু তাদের স্মৃতি। নেই কোনো ছবি, তবুও আছে অনেক স্মৃতি।

ডা. সৈয়দ আকতার ফারুক : লেখক ও শহিদ সন্তান

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম