বুদ্ধিজীবী ভীতির আবর্তেই চলছে স্বদেশ
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটি দেশের মেধাবী মানুষ, মেধাচর্চাই যাদের জীবন ও জীবিকা তারাই বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হন। একটি দেশের দেশপ্রেমিক নীতিনির্ধারকরা দেশকে-সমাজকে এগিয়ে নিতে বুদ্ধিজীবীদের মেধা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মনে করেন। তাদের সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দেন দেশের স্বার্থে, আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করার জন্য।
অন্যদিকে দুর্বল রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকরা, গণবিরোধী আচরণ যারা করেন-ভুলের কুয়াশার চাদর পরিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান তাদের সবচেয়ে বড় ভীতি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। কারণ সুস্থ ধারার-সুস্থ মানসিকতার বুদ্ধিজীবী অসত্য অন্যায়কে মানুষের সামনে উন্মোচন করেন, আলোকিত করেন মানুষকে। তাই গণবিরোধী সরকারগুলো বুদ্ধিজীবীদের সাধারণত শত্রু জ্ঞান করে থাকে।
বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র ছিলেন গ্রিক বীর মহান আলেকজান্ডার। এ মেধাবী বিজেতা মিসর জয় করার পর নতুন শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে। তার নামে মিসরের প্রধান বন্দর নগরীর নামকরণ করা হয় আলেকজান্দ্রিয়া। তিনি আলেকজান্দ্রিয়াকে জ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণার পীঠস্থান তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আলেকজান্ডার বুঝেছিলেন সব গবেষণার সাফল্য আসবে যদি নানা অঞ্চল থেকে প্রখ্যাত গবেষক অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করা যায়। এ লক্ষ্যে তিনি রোম, গ্রিস, মিসরসহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী-দার্শনিক-গবেষকদের তার প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগারে যুক্ত করেন; তাদের নানাভাবে সম্মানিত করার ব্যবস্থাও করা হয়।
অন্যদিকে ১৯৭১ সালের অন্ধকারাচ্ছন্ন পাকিস্তানি শাসকদের হিংস্র চেহারা ১৪ ডিসেম্বর এলে পুনরায় আমাদের মনে পড়ে। একইসঙ্গে মনে পড়ে তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামী, আলবদর, আল শামসদের কথা। তারা তাদের হিংস্র দৃষ্টিতে টার্গেট করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের। এদের চোখে বুদ্ধিজীবীদের অপরাধের অন্ত নেই। এদেশের বুদ্ধিজীবীরা আইয়ুববিরোধী বাঙালির আন্দোলনে পেছন থেকে রাজনীতিবিদদের নানাভাবে চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধেও প্রেরণার সঞ্চার করেছেন।
অন্যদিকে যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তাদের চূড়ান্ত পরাজয় আসন্ন, তখন জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য ভয়ংকর মানবতাবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেনি তারা। অতি নিম্ন মানসিকতার বলেই পাকিস্তানিরা চেয়েছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যাতে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে না পারে। তাই নতুন দেশের চালিকাশক্তি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করে তারা; এ লক্ষ্য পূরণে জামায়াতে ইসলামীর খুনিদের ব্যবহার করা হয়েছিল।
এ কারণে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের বেশ কদিন আগে থেকেই ঢাকাসহ দেশের নানা অংশের প্রতিথযশা শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক-এমন নানা পেশার মানুষদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে কালো দিন হিসাবে পরিচিত ১৪ ডিসেম্বর আমরা শোকাবহ হৃদয়ে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসাবে পালন করি।
ঔপনিবেশিক শাসক ইংরেজ ও পাকিস্তানিদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো ব্রিটিশ শাসকরা তাদের ঔপনিবেশিকতার নীতিমালা অনুযায়ী দীর্ঘদিনের উপনিবেশ থেকে যখন সবকিছু গুটিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করত বা করতে বাধ্য হতেন, তার আগে নিজেদের একটি শোভন দায়িত্ব পালন করে যেতেন। উপনিবেশ ছেড়ে চূড়ান্তভাবে যাওয়ার আগে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতেন তারা। কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ পাকিস্তানিরা বাঙালি নতুন স্বাধীন দেশ পরিচালনায় যাতে সংকটে পড়ে সে লক্ষ্যে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিতে চেয়েছিল।
এটা শুধু পাকিস্তানি হানাদার শাসকদের মানসিকতাই নয়, পরে স্বাধীন দেশের নানা পর্বের শাসকদের ভেতরও অনেকটা কাছাকাছি মানসিকতা যেন কাজ করছে। রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার নীতিতে দুর্বলতা থাকে বলে এক ধরনের গণঅসন্তুষ্টির ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এ কারণেই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। বুদ্ধিজীবীদের খলনায়ক বানানোর চেষ্টা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের নিরপেক্ষ শক্তি-সাহসের জায়গাটিতে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা হয়। বুদ্ধিজীবী পরিচয়ের মেধাবী মানুষদের অনেকের সাধারণ রাজনৈতিক চেতনাকে দূষিত করে দলীয় রাজনীতির লোভী চক্রে বন্দি করে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
এভাবে বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে দলীয় রাজনীতির বিদূষকে পরিণত করা হয়। তাদের তখন আর নিজ বিবেক কাজ করে না। তারা তখন রাজনীতিকদের তাঁবেদারিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে ফাটল ধরানো হয় বুদ্ধিজীবীদের নিরপেক্ষ মননে। পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের শারীরিকভাবে খুন করেছিল আর এখনকার রাজনীতির অঞ্চলে সুবিধাবাদী মানুষরা নষ্ট করছেন বুদ্ধিজীবীদের একাংশের বিবেক। সামান্য পদ-পদবির লোভে অনেকেই বিকিয়ে যাচ্ছেন।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নানা পর্বে জাতীয় নেতারা পরামর্শের জন্য-পথ নির্দেশনার জন্য ছুটে যেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শানিত মেধার শিক্ষকদের কাছে। এখন কোনো কোনো শিক্ষকই নিজ বা দলীয় স্বার্থ অর্জনের জন্য রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর কাছে ছুটে যান। এসব স্খলনের কারণে এখন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের অনেকে প্রায়ই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কটাক্ষ করতে দেখি।
দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকা যে খুব দোষের বিষয়, তা বলছি না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকেই স্বীয় ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে পারছেন না। বুদ্ধিজীবীদের হওয়ার কথা ছিল স্ব স্ব দলের নেতা-নেত্রী-কর্মীদের গাইড, ফিলোসফার। তার বদলে সব কিছুই যেন উলটে যাচ্ছে। আমাদের মনে হয় এদেশের রাজনীতিকরা নিজ নিজ কর্তৃত্ব রক্ষার স্বার্থে বুদ্ধিজীবী অনেকের চারিত্রিক সৌন্দর্যকে সফলভাবেই নষ্ট করতে পেরেছেন। ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ ধারণ করে যেসব বুদ্ধিজীবী আপন অঞ্চলে প্রভা ছড়ান তাদের নিষ্প্রভ করে দেওয়ার চেষ্টা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির আকর অঞ্চল তাই এ অঞ্চলের নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বরাবর প্রতিথযশা শিক্ষক অধ্যাপকরাই নিয়োজিত হতেন।
তাই দু-তিন দশক আগে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদে সর্বজন বিদিত-শ্রদ্ধেয় পণ্ডিতদের দেখা যেত। তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। ফলে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির পরিবেশ ছিল সর্বত্র। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা নিজেদের বলয় ঠিক রাখতে নিজ অনুগত তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষমতা-কেন্দ্রগুলোকে সজ্জিত করেন। প্রকৃত জ্ঞানী ও বিবেকবান অধ্যাপকরা অনেকটা অচ্ছুৎ হয়ে যাচ্ছেন এ কারণে। এসবের ফল হিসাবে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক বিবেচনায় নগণ্যের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই নন সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী অধিকাংশ পেশাজীবী নেতারাই বিভাজনের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে বুদ্ধিচর্চার সৌন্দর্যকে ফিকে করে দিচ্ছেন। তারা দলীয় নেতানেত্রীর বন্দনার মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীর গরিমাকে ম্লান করে দিচ্ছেন।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এসব বাস্তবতাকে অস্বীকার করি কেমন করে। বাস্তবতার কারণে আমাদের মনে হয় ১৯৭১-এ এমন দলীয় বৃত্তে নিজেদের স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থাকলে তাদের নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না পাকহানাদাররা। জামায়াতের আলবদর আল শামসদের ছুরি শানিয়ে খুনির ভূমিকায় নামতে হতো না। কারণ ওরা জানত এমন সুবিধাবাদী ‘বুদ্ধিজীবী’ সম্প্রদায় দেশ পুনর্গঠনে তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না। কিন্তু সবাই মানবেন একাত্তরের ডিসেম্বরে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তারা ছিলেন এ দেশের সূর্যসন্তান। অন্ধকারের শক্তি এমন উজ্জ্বল আলোর দিশারীদের ভয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়বে এটিই স্বাভাবিক।
একাত্তরের শহিদ বুদ্ধিজীবীরা একটি স্বাধীন দেশ অর্জনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে কেউ কেউ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের লেখা উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিকামী মানুষকে। দেশকে ভালোবাসার অপরাধে শত্রুর হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে শহিদ হয়েছেন তারা। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণ করতে গিয়ে বারবার নিজেদের অপরাধী মানতে হচ্ছে। এখনো সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মেধাবী সৎ বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। দলীয় রাজনীতিতে নিজেদের বিকিয়ে দেননি বলে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। সুবিধা প্রত্যাশী বুদ্ধিজীবীদের আচরণের কারণে সাধারণ্যে তাদের সম্মান অনেকটা কমে গেছে। তাই বিশেষ করে রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাবানরা সুযোগ পেলেই আলোকিত মানুষদেরও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। এ বিভক্তি একটি দেশের জন্য কল্যাণকর নয়।
আমরা আশা করব, একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি অর্জনের জন্য দেশের মেধাবী আলোকিত মানুষের পরিচর্যা পাবে বাংলাদেশের মানুষ। বুদ্ধিজীবী দিবসে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ যেমন বাংলার স্বাধীনতাকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করাতে শক্তি জোগায়, তেমনি আমরা প্রত্যাশা করব, এ সময়ের বুদ্ধিজীবীদের দলীয় পরিচয়ের সংকীর্ণতায় আটকে না রেখে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে তাদের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করার পথ তৈরি করা হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com