
প্রিন্ট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৭ এএম
যুদ্ধও চলুক, বিজয়ও চলুক

পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
বিজয় একদিনের ঘটনা নয়। বিজয় মানে যুদ্ধে বিজয়। সব বিজয়ের আগে একটা যুদ্ধ থাকে, তার নানা রকমের চেহারা। প্রতিবাদ, মিছিল, দমনপীড়ন-বঞ্চনা-লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, শাহাদত, নির্বাচনি যুদ্ধ, পথবিদ্রোহ চলতে চলতে অস্ত্রশস্ত্র গুলিগোলা ট্যাংক জাহাজ নিয়ে যুদ্ধ, কতদিন চলবে তার ঠিক নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরবে, মানুষের সম্পত্তি ধ্বংস হবে, পশুপাখির জীবন বিপন্ন হবে, অত্যাচার হবে মানুষের ওপর, প্রকৃতি প্রতিবেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তার পরে তা একদিন শেষ হবে। বিজয় আসে, কখনো সাময়িক, কখনো চিরকালীন। দেশ স্বাধীন হবে, নতুন দেশের জন্ম হবে। ভূমানচিত্র বদলে যাবে।
যেমন হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে, বাংলাদেশের। এর যুদ্ধটাও ছিল অন্যরকম। অন্যান্য বঞ্চনা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু পুর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী নাগরিকদের কাছে যে বঞ্চনা সবচেয়ে বড় হয়ে বেজেছিল তা হলো তার ভাষার প্রতি বঞ্চনা আর অপমান। তা যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে উঠেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলার দাবি অগ্রাহ্য করে দর্পী শাসক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে, ঢাকার রাজপথে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহিদদের হত্যা করে। সেই যুদ্ধ এক সময় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেহারা নেয়, স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। এ ইতিহাস সবার জানা। এ ইতিহাসও জানা যে, তখন পৃথিবীর পরিস্থিতি এ নতুন রাষ্ট্রের প্রতি খুব অনুকূল ছিল না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া বিশ্বের তাবৎ মহাশক্তি, এমনকি চীনও বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রথমদিকে খুব প্রীতির চোখে দেখেনি, তা ইতিহাসে নথিবদ্ধ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব কিসিঞ্জার তো বলেই দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ একটা ‘ফুটো ভিক্ষের ঝুলি’ হতে চলেছে, আর তার প্রেসিডেন্ট বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহর মোতায়েন করে রেখেছিলেন, বাংলাদেশ আর তার বন্ধু ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য।
কিছুতেই কিছু হয়নি। জনগণমনঅধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে (যুদ্ধের সময় তিনি দূর পাকিস্তানের জেলে বন্দি, তবু যেন তার অদৃশ্য সেনাপতিত্ব দুর্জয় হয়ে উঠেছিল সেই যুদ্ধে) বিজয় ছিনিয়ে নিল বাংলাদেশের অকুতোভয় বাঙালিরা, কাপুরুষতার কিংবদন্তিকে চিরকালের মতো কবরে পুঁতে দিয়ে।
২.
বিজয় মানুষকে অনেক কিছু দেয়, যেমন দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। দেয় অহংকার, দেয় আত্মবিশ্বাস, দেয় নতুন এক আত্মপরিচয়, স্বাধীনতার আনন্দময় আর উত্তেজক স্বাদ। নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা, উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য নতুন দিগন্ত। কিসিঞ্জারের কথা মেলেনি, বাংলাদেশের মানুষ তার ওই দম্ভোক্তির সমুচিত জবাব দিয়েছে। এককালের অবিশ্বাসীরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কারণ শেখ মুজিবের ওই সংক্ষিপ্ত নেতৃত্বকালের মধ্যেই বাংলাদেশ প্রায় সারা পৃথিবীর স্বীকৃতি পেয়েছে। ছিল দুর্যোগ, ছিল বন্যা, ছিল খাদ্যসংকট, তা পার হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। জাতিসংঘে ১৯৭৪ সালে প্রথম বাংলাভাষা উচ্চারিত হলো, বাংলাদেশ পা দিল এক প্রগতির এক তুমুল স্বপ্নের পথে।
কিন্তু বিদেশি রূপকথার যে উপসংহার থাকে, And they lived happily ever after-‘তাহার পরে সকলে সুখে বসবাস করিতে লাগিল’, এমন কখনোই ঘটে না। বাংলাদেশ হোক এটা যেমন বাংলাদেশেই অনেকে চায়নি, তেমনই বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলবে সে সম্ভাবনাও অনেকের কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। তাই উচ্চাকাক্সক্ষী সহচররা শত্রু হয়ে উঠল, জাতির পিতাকে তীব্র নৃশংসতায় হত্যা করা হলো, বাঙালির এক অংশ বাংলার যা কিছু গৌরবময় অর্জন তাকে ধ্বংস করার চেষ্টায় নেমে পড়ল। প্রায় দুই দশকের জন্য বাংলাদেশের শাসকরা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। শাসক আর শাসকের সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গণতন্ত্রকে কোণঠাসা করে রাখল বেশ কয়েক বছর।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় যে বাঙালি জেগে উঠেছিল তাকে দমিয়ে রাখা তো অত সহজ নয়। না, আমি এমন কথা বলি না যে, কোনো পর্বেই বাঙালির যে শাসক অপছন্দ সে শাসক তার বিশ্বাস, কল্পনা আর সৃষ্টিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। পূর্ব পাকিস্তান পর্বেও মূল প্রেরণা হয়েছে তার ভাষা আন্দোলন, যার উৎস থেকে নতুন বাঙালি সাহিত্যিক ও কবিরা উঠে এসেছেন, নির্মাণ করেছেন এমন এক সাহিত্য, যা নিয়ে সমগ্র বাঙালি গর্ব করতে পারে। শিক্ষায়-গবেষণায় নতুন কীর্তি স্থাপন করেছেন কত বাঙালি গবেষক, প্রসিদ্ধ প্রবীণদের উত্তরাধিকার সমৃদ্ধ করেছেন নবীনের দল। বাঙালি চিত্রকররা দেশ-বিদেশে খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করেছেন, বাঙালি স্থাপত্যশিল্পীরা সারা বিশ্বে সম্মান কুড়িয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর বাংলা একাডেমি বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খুলে দিয়েছেন পৃথিবী বিখ্যাত নানা গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করে, আর বাংলাদেশের বাঙালি ধর্মান্ধতার বাইরে বেরিয়ে নিজের হাজার বছরের আত্মপরিচয় নির্মাণ করেছে ওই পরাধীন সময়েই, অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলোর সন্ধানে মগ্ন থেকেছেন তারা। আমি জানি, অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বমুখী ছিলেন। আগেকার সিলেট, চট্টগ্রাম আর নোয়াখালী থেকে প্রচুর মানুষ লন্ডনে- আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন, কখনো নাবিক হয়ে, কখনো অভিবাসনের লক্ষ্যে। তারাই ছিলেন কিসিঞ্জারের ওই দম্ভপূর্ণ কথার বিরুদ্ধে নতুন দেশের গ্যারান্টি যে, এ দেশ কখনো ফুটো ভিক্ষার ঝুলি হবে না।
আর বাংলাদেশের জন্মের পর এক নতুন রেনেসাঁস বা নবজাগরণ তৈরি হয়েছিল। কর্মে ও সৃষ্টিশীলতায় বাংলাদেশের মানুষ নতুন নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। আমাদের মতো মানুষ বিশেষভাবে উদ্দীপিত হয়েছিল একটি ব্যাপারে। নতুন তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে বাংলাভাষার বন্ধনসৃষ্টিতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ডাক দেওয়া হলো, আর বাংলাদেশের বাঙালিরা অদ্ভুতভাবে এগিয়ে গেলেন বাংলাভাষার জন্য ওই প্রযুক্তিকে বশ করার কাজে। প্রিয় মানুষ মোস্তাফা জব্বারের পথপ্রদর্শনকারী কাজ তো আছেই, সেই সঙ্গে ‘অভ্র’ সফ্টওয়্যার নির্মাণ বাংলা লেখার বহু ফন্ট সবার হাতে পৌঁছে দিলেন যারা, তাদের কাছেও সারা পৃথিবীর বাঙালি কৃতজ্ঞ। আমার ভালো লেগেছে দেখে যে, যে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির ‘স্বচ্ছ’ ফন্ট, যা এ ব্যক্তির প্রস্তাবে নির্মিত হয়েছিল, তা-ও অভ্রে প্রাপ্ত বর্ণমালার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনায় তো বাংলাদেশের ‘বিজয়’ ফন্ট (সম্ভবত জব্বার ভাইয়ের করা) অহরহ ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনে নব্বইয়ের বছরগুলোর গোড়ায় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ঘটল, এটি ছিল অত্যন্ত গৌরবময় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের পর আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ চলে। যাই হোক, এ শতাব্দীর গোড়া থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্রে স্থিতিশীলতা এসেছে, নানা উন্নয়নে গতিও তীব্র হয়েছে। শিক্ষায়, বিশেষত স্ত্রী শিক্ষায়, বিদ্যুৎ বিতরণে, অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে বাহুল্য হবে। বাংলাদেশের গর্বের পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হতে চলেছে, ঢাকা মহানগরীর পাতাল রেলও অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। আমি ডিসেম্বরের গোড়ায় দুবছর পরে আবার ঢাকা যাব, নিশ্চয়ই আরও অনেক ভালো পরিবর্তন দেখব।
তবু যুদ্ধ চলে। ঘরের সঙ্গে, বাইরের সঙ্গে। ঘরের যুদ্ধের সূত্রেই হলি আর্টিজান বেকারির ঘটনা বা এবারের দুর্গাপূজায় হাঙ্গামা ঘটে। এজন্যই বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করতে হয়। আমি মাও জে-দং-এর সেই পরিচিত আখ্যানটা দিয়ে শেষ করি, বাংলাদেশের বিজয়কে বারবার কুর্নিশ জানিয়ে। বিপ্লবের সময় এক ক্লান্ত নাগরিক মাওকে জিজ্ঞেস করে-কমরেড, এ বিপ্লব শেষ হয়ে কখন স্বাভাবিক অবস্থা আসবে বলুন তো। মাও বললেন, সে কী কমরেড! বিপ্লবটাই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক অবস্থা।
ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলেই। হয়তো তার রূপ ও ধরন বদলে যায়। কিন্তু তাতে বারবার বিজয় ছিনিয়ে নিতে হয়। কাজেই যুদ্ধ চলুক, নতুন নতুন বিজয় আসুক।
লেখক: খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা