Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’ সমস্যা

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’ সমস্যা

আজ ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখ। পাঁচ দিন পরই আমাদের মহান বিজয় দিবস। দিনটি এবার হবে বাংলা পৌষ মাসের ১ তারিখ। জমিতে আমন ফসল। অনেক জায়গায় আমন ঘরে তুলেছেন আমাদের কৃষক ভাইয়েরা। এ মুহূর্তে আবহাওয়া বৈরী। বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালসহ অনেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

এর মধ্যেও এবার বিজয় দিবস পালনে কোনো কমতি হবে না। গেল বছর করোনার কারণে ছিল অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এবার জনজীবনে একটু স্বস্তি ফিরে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যুগপৎভাবে পালিত হচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ আসছেন বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে।

২০২১ সালের বিজয় দিবস আমাদের ৫১তম বিজয় দিবস। ৫০ বছর একটা জাতি ও দেশের জীবনে কম সময় নয়। এর মধ্যে সবকিছু বদলে দেওয়া যায়। বদলে দেওয়া যে যায়, তা আমাদের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রমাণ করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের প্রথম বিজয় দিবসের পর ২০২১ সালের বিজয় দিবসে আমরা যে বাংলাদেশ দেখছি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাংলাদেশ, নতুন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আমূল বদলে গেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক-সবদিক থেকেই এটা নতুন উচ্চতার বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার পরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করেছিলেন। এ নিয়ে কত কথা, বাংলাদেশ বিরোধীদের কত ‘আনন্দ’, তা ওই সময়ের কথা যাদের মনে আছে তারা সবাই জানেন। আজ বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, উন্নয়নের রোল মডেল। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম অর্থনীতি।

সাপ্তাহিক ‘ইকোনমিস্টের’ মতে, এখনই আমরা ৬৬টি এমার্জিং অর্থনীতির মধ্যে নবম অর্থনীতির দেশ। বিগত ৫০ বছরে আমাদের অগ্রগতি ও অর্জন অনন্য। সারা বিশ্বে আমরা উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। ইতোমধ্যেই আমরা পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছি। স্বাধীনতার সময় আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ১৪০ ডলারের মতো। আর আজ? সর্বশেষ হিসাবে আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ২৫৫৪ ডলার।

আমাদের অর্থনীতির আকার বা জিডিপির আকার হচ্ছে ৪০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত যোগ হচ্ছে। কৃষিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ফসল। শিল্প ও সেবা খাতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা। একথা আজ জলের মতো পরিষ্কার, বিগত ৫০ বছরে দেশে বিরাট এক উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যাদের পেছনের শক্তি ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা।

আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ৫০ বছরে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েছেন সাড়ে তিন গুণ। চালে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। না খেয়ে কেউ মারা যায় না। কেউ উপোস থাকে না। ‘মঙ্গা’ শব্দটি তিরোহিত। গরিব কৃষক ভাইয়েদের সন্তানরা লাখে লাখে যাচ্ছে বিদেশে কাজ করতে। এক কোটির উপরে বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, পানীয়জল ইত্যাদির নানা সূচকে আমরা এগিয়ে-ভারত ও পাকিস্তানের থেকেও।

পাকিস্তানিরা বলত, ‘স্বাধীন হলে তোমরা না খেয়ে মরবে।’ আজ ৫০ বছর পর পাকিস্তান থেকে আমরা সব ক্ষেত্রে এগিয়ে। আমাদের জিডিপির আকার যখন ৪০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার, তখন পাকিস্তানের জিডিপির আকার হচ্ছে ২৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আমাদের মাথাপিছু জিডিপি ২৫৫৪ ডলার, আর পাকিস্তানের ১৪১০ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকাশনার নিবন্ধের মতে, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৩২৯ কোটি ডলার। আর আমাদের ৪৬০০-৪৭০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ৪ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার।

পাকিস্তানের মোট রপ্তানির পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৮১৫ কোটি ডলার। ৮৫-৮৬ টাকায় আমরা এক ডলার কিনি, পাকিস্তানিরা কিনে ১৭০ পাকিস্তানি রুপিতে। এভাবে দেখা যায়, ৫০ বছরে পাকিস্তানকে আমরা বহু পেছনে ফেলে দিয়েছি। শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সূচকেও আমরা এগিয়ে। এই অগ্রগতির সিংহভাগ অর্জিত হয়েছে বিগত ১০-১৫ বছরের মধ্যে। এভাবে দেখলে বোঝা যায়, ২০২১ সালের বিজয় দিবসে আমাদের গর্ব করার মতো অনেক ‘পারফরম্যান্স’ আছে।

৫০ বছরের অগ্রগতি ও অর্জনের সামান্য একটা চিত্র উপরে তুলে ধরলাম, যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা ছবি আমাদের চোখের সামনে থাকে। বস্তুত অর্জনের ব্যাপারে প্রশ্ন এখন কেউ করে না। প্রশ্ন উঠছে অন্যত্র, যা আলোচনায় আসা দরকার, যাতে আমরা এখনই ‘কারেকটিভ স্টেপ’ নিতে পারি। যাতে সরকার করণীয় সম্পর্কে অধিকতর সজাগ হয় এবং দেশবাসী আমাদের উন্নয়নের কয়েকটা দুর্বল দিক সম্পর্কেও সজাগ থাকে।

বেশকিছু দুর্বল দিকের মধ্যে আমি আজকের নিবন্ধে দুই-তিনটি দুর্বলতার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর কিছু বলা দরকার। দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের অর্জন ও অগ্রগতি অসামান্য। স্বাধীনতার আগে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। দরিদ্র মানুষ ভাত নয়, ভাতের ফ্যানের জন্য ধনীদের বাড়িতে বাড়িতে যেত। গায়ে কাপড় ছিল না, পায়ে জুতা-স্যান্ডেল ছিল না।

এ পরিস্থিতি ও অবস্থা থেকে আজ আমরা দারিদ্র্য বহুলাংশে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি। আজ দারিদ্র্যসীমার নিচে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ (করোনার হিসাব বাদে)। মাত্র ১০ শতাংশের মতো মানুষ অতি দরিদ্র। শতকরা হিসাবে এ পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সংখ্যার হিসাবে গেলে বিপত্তি ঘটে। সংখ্যার হিসাবে চার কোটিরও বেশি মানুষ দুবেলা ভাত পায় না। এ সংখ্যাটি নিতান্ত কম নয়। তাও স্বাধীনতার ৫০ বছর পর। আবার দারিদ্র্যের আরেকটি চিত্রও বিবেচনায় নিতে হবে। দারিদ্র্য সারা দেশে সমান নয়।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (বিবিএস) মতে, উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দারিদ্র্য ব্যাপক। ওই অঞ্চলটি দেশের দরিদ্রতম অঞ্চল। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম জেলার লোকেরা দরিদ্রতম। এই কুড়িগ্রাম আলোচনায় আজ থেকে নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য অবস্থার কথা শুনে আসছি। কুড়িগ্রাম না হয় বাংলাদেশের দূরবর্তী উত্তরাঞ্চলের একটা সীমান্ত অঞ্চল, কিন্তু বৃহত্তর ময়মনসিংহ কী? বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুরও দেশের অন্যতম দরিদ্র্য অঞ্চল। এ অঞ্চলটি রাজধানী ঢাকার কাছে। বড় বড় নেতা ছিলেন এবং আছেন ওই অঞ্চলের।

এতদসত্ত্বেও ওই অঞ্চলের দারিদ্র্য যাচ্ছে না। তারপর আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সিলেট অঞ্চলের দারিদ্র্য। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ দরিদ্র অঞ্চল। ভাবা যায়! বৃহত্তর সিলেটের মাটির নিচে তেল ও গ্যাস। উপরে বড় বড় চা বাগান। তাছাড়া এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ প্রবাসী, যাদের অনেকেই বিলিয়ন ডলারের মালিক। সিলেটে তাদের বাড়িঘর দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বরাবরই অঙ্গীকার করে থাকেন।

সর্বোপরি ওই অঞ্চল থেকে শক্তিশালী তিনজন অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ উপহার পেয়েছে। তারপরও সিলেটের এ দারিদ্র্য অবস্থা। কী উত্তর এসবের? পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এ প্রবণতাকে ‘পকেট অফ পভার্টি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হয়তো তা ‘পকেট অফ পভার্টিই’ হবে। কিন্তু ৫০ বছর পরেও? এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে এর সঙ্গে যখন আমরা আঞ্চলিক দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিবেচনা করি।

‘পকেট অফ পভার্টির’ সঙ্গে সঙ্গে আমরা বৈষম্য প্রকট হতে দেখতে পাচ্ছি। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, যা আমাদের বড় শত্রু, তা দিন দিন বাড়ছে। এবং তা বাড়ছে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও। বাংলাদেশের সৃষ্টির বৈষম্য। মুশকিল হচ্ছে, এ বৈষম্য এখন আমাদের পীড়িত করছে। আয়-বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য দুটিই প্রকট। এর মধ্যে একটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে ঢাকা শহরকে নিয়ে। এ শহরটি সারা দেশকে বঞ্চিত করে বেড়ে উঠেছে এবং উঠছে। একে সরকার নিয়ন্ত্রিত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ‘অতিবৃদ্ধি’ সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে।

অতিবৃদ্ধির বিষয়টি আজকে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এর শুরু অনেক আগে থেকেই। বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমি নেত্রকোনায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানকার মহাশোল মাছ বিখ্যাত। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম যে এ মাছটি এখন দুর্লভ। যা পাওয়া যায় তা চলে যায় ঢাকায় ‘ভেট’ হিসাবে। সেখানকার ধনীরা অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখেন জেলেদের। ধরা পড়লেই ধনী লোকজন, সরকারি বড় কর্মকর্তারা তা কিনে নেয় এবং পাঠায় ঢাকায় আরও শক্তিশালী ব্যক্তিদের ভোগের জন্য।

জানলাম, শুধু মহাশোল নয়, অন্যান্য মাছেরও একই অবস্থা। ভালো বড় মাছ, তাজা মাছ, হাঁস-মুরগি, শাক-সবজি ইত্যাদিও চলে আসে ঢাকায়। ভোররাতে বাস-ট্রাকে এসব তোলা হয়। সকাল সকাল ঢাকায় পৌঁছে যায়। ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, এমনকি সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকেও ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের জন্য ভোগ্যপণ্য আসে, মাছ-সবজি আসে। বরিশাল ইত্যাদি প্রত্যন্ত অঞ্চল, চাঁদপুর থেকে আসে ইলিশ মাছ।

আমাদের এক বন্ধু অনেকদিন আগে অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘ঢাকাইয়াদের’ যন্ত্রণায় আমরা গ্রামবাসী কিছু খেতে পারি না। ঢাকার চেয়ে গ্রামে জিনিসপত্র, মাছের দাম বেশি। সব ঢাকায় চলে যায়। কথাটার কোনো ভিত্তি আছে কিনা আমার জানা ছিল না। এখন বিআইডিএসের গবেষণা থেকে বুঝলাম কথাটা সর্বাংশে সত্য। ঢাকা একটা সর্বগ্রাসী শহর হিসাবে গড়ে উঠছে। সব সুযোগ-সুবিধা যেহেতু এখানে, তাই সবাই ঢাকামুখী।

সবগুলো ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস ঢাকায় (রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বাদে)। সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, কলেজ, মহিলা কলেজ; সবচেয়ে ভালো হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শক্তিশালী লোকজন-সব ঢাকায়। ঢাকার বাইরে বস্তুত কিছুই গড়ে উঠছে না। ফলে সবাই ঢাকামুখী। আবার কেউ ঢাকার বাইরে যেতে চায় না। এর ফল কী? প্রথমেই বলি ব্যাংকের কথা।

সারা দেশে সব ব্যাংকের যে আমানত (ডিপোজিট) আছে, তার ৫০ শতাংশের উপরে ঢাকা শহরের ব্যাংক শাখাগুলোতে। ঋণের চিত্রও তাই। সব ঋণ, বড় বড় ঋণই ঢাকা শহরে। মিল-ফ্যাক্টরিগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক। এর প্রতিফলন পাওয়া যায় জিডিপিতে (গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট)। বিআইডিএসের মতে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০ শতাংশের বেশি আসছে ঢাকা নগর থেকে।

দেশের শহুরে জনসংখ্যার ৩২ শতাংশের বসবাস ঢাকা মহানগরীতে। বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, তার ৪৬ শতাংশই ঢাকায় ব্যবহৃত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনের অন্য কোনো পরিসংখ্যান কাগজে দেখলাম না। তবে খুব সহজেই অনুমান করা যায় চিনি, তেল, মসলা, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, মরিচ ইত্যাদিও ভোগ হয় ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি। আমার ধারণা, এসব ভোগ্যপণ্য সারা দেশে যা ভোগ হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি হয় ঢাকায়।

এখন বলা হচ্ছে, ঢাকার এ অতিবৃদ্ধির ফলে আমাদের জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৬ থেকে ১০ শতাংশ। এটা কিন্তু পরিমাণে অনেক। শুধু যে জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, সমাজের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। ঢাকার অতিবৃদ্ধির ফলে অন্য শহর ভালোভাবে গড়ে উঠছে না। ঢাকা শহরবাসীই ধনী দেশবাসী। সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ঢাকা শহরের লোকেরাই ভোগ করে। ফলে গ্রাম থেকে প্রতিদিন শত শত, হাজার হাজার কর্মহীন মানুষ ঢাকায় আসছে কাজের সন্ধানে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কথা বলা যায়।

আগে ঢাকা শহরে উত্তরবঙ্গের কোনো মানুষ দেখা যেত না। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার ফলে এখন উত্তরবঙ্গ থেকে প্রচুর মানুষ আসছে, বিশেষ করে রংপুর, গাইবান্ধা থেকে। পাকিস্তান আমলে রিকশা চালাত ফরিদপুর ও নোয়াখালী জেলার লোকেরা। এখন সেই স্থান দখল করেছে উত্তরবঙ্গের লোকেরা। ফরিদপুর ও নোয়াখালীর লোকেরা স্থায়ী দোকানের মালিক হয়েছে। অনেকেই চলে গেছে বিদেশে। ডলার রোজগার করছে।

এমনকি এখন কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার রিকশাওয়ালাও দেখা যায়। এরা আগে ঢাকায় আসত না। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুরের লোকেরা এখন বাসাবাড়িতেও কাজ করে। এর একটা অর্থনৈতিক ফল আছে। এরা ঢাকায় রোজগার করে গ্রামে ‘ক্যাশ’ পাঠায়। এতে গ্রামে ‘ক্যাশের’ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে তাদের বাড়িঘরও আধুনিক করেছে। গ্রামে তারা নানা সুযোগ-সুবিধাও গড়ে তুলছে। কৃষিতেও তারা বিনিয়োগ করছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ঢাকার।

ঢাকার অতিবৃদ্ধিজনিত কারণে এখানকার দারিদ্র্য বেড়েছে, যাকে বলা হচ্ছে নগর দারিদ্র্য। ঢাকা শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে কম। ফলে পানীয়জল, পয়ঃনিষ্কাশন, আবাসন, যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সেবায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন অবস্থা এমন যে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করতে। শোনা যায়, ঢাকার অধিবাসীদের জন্য পানীয়জল আনতে হবে সুদূর যমুনা নদী থেকে।

এসবের কারণে সম্পদ ব্যবহারে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে। আমরা জানি, আমাদের রাজস্ব অফুরন্ত নয়। প্রতিবছরই বাজেট ঘাটতি হয়। ‘নুন আনতে পান্থা ফুরায়’ অবস্থা। রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অথচ খরচ বেড়েই যাচ্ছে। টাকার অভাব হচ্ছে। এ কারণে রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয়ে আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

সরকার ঢাকা শহরের চাহিদা মেটাবে, না গ্রামের চাহিদা মেটাবে? ঢাকা শহরবাসী সোচ্চার একটা জনগোষ্ঠী। কথায় কথায় তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারে। এ কারণে তাদের সন্তুষ্ট রাখাটাই সরকারের প্রধান কাজ। গ্রামকে কিছুটা অবহেলা করলেও চলে। গ্রামের বরাদ্দ কম হলেও চলে। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা যদি গ্রামের অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়নে কাজে লাগানো যেত, তাহলে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষিত হতো অনেক বেশি।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম