Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চাই দেশপ্রেমের নবজাগরণ

Icon

ড. হারুন রশীদ

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চাই দেশপ্রেমের নবজাগরণ

ফাইল ছবি

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাঙালি জাতির জন্য এ বছরটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীনতার রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নতুন এক উদ্দীপনা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী হলো ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্তি পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত একটি বার্ষিক পরিকল্পনা, যা নতুন করে জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে।

ডিসেম্বর শুরু হলেই নবজাগরণের গান গেয়ে উঠি আমরা। কেননা ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে এক অনন্য গৌরবের মাস। এ মাসেই বাঙালি জাতি পায় তার লালিত স্বপ্নের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সব শ্রেণির মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।

৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ শহিদের আত্মদানের পর আমরা লাভ করি স্বাধীনতা। সামরিক শক্তির দিক থেকে এক অসম যুদ্ধ হলেও দেশমাতৃকার জন্য বাঙালির সর্বোচ্চ ত্যাগ আমাদের মুক্তির সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। পাকবাহিনী এ দেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ডিসেম্বরের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটতে থাকে। একে একে মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা হয়। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর আসে চূড়ান্ত ক্ষণ। হানাদারমুক্ত হয় দেশ। পাকবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের জন্ম থেকেই শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। যারা এ দেশের জন্ম হোক এটা চায়নি তারা নানাভাবে তাদের হীন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে, যা শুরু হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাত্র ২ দিন আগে লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য জাতিকে মেধাশূন্য করার এ নীলনকশা বাস্তবায়ন করে এ দেশের পাকহানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর, আলশামস বাহিনী। বস্তুতপক্ষে এ ষড়যন্ত্র স্বাধীনতা লাভের পরও থেমে থাকেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

শুধু তাই নয়, একই বছর ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মম নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর সামরিক শাসন চেপে বসে। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয়। দেশকে নিয়ে যায় পেছনের দিকে। কিন্তু এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেয়নি। তাই একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে এখন বাংলাদেশে। ইতোমধ্যেই চিহ্নিত চার যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যদেরও বিচার চলছে। এর মধ্য দিয়ে জাতি অভিশাপমুক্ত হচ্ছে। সমাপ্তি ঘটছে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম, যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ-যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরা দেখতে পাই-জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখিয়েছে। জাতির পিতা কীভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাকশিল্প, ঔষধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে।

নানা ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে গেলেও এখনো রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি হয়নি জাতীয় অনেক ইস্যুতে। নির্বাচন ব্যবস্থা বিতর্কমুক্ত নয়। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা জন-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে। গ্রাম-শহরে, নারী-পুরুষে, ধনী-গরিবে বৈষম্য প্রকট। বেকারত্ব পাহাড়সম। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি। দুর্নীতি শেকড় গেড়ে বসেছে। ব্যাংক বিমাসহ নানা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে জড়িত। প্রশাসন জনবান্ধব কতটা এ প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকরা জেঁকে বসেছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো থেমে নেই। তারা নানা কায়দায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। কিন্তু সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়েই দেশবিরোধী অপতৎপরতার জবাব দিতে হবে। স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে।

শোষণমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যেখানে সবাই সবার নাগরিক অধিকার নিয়ে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে গৌরবের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। এ লক্ষ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে নতুন করে শপথ নিতে হবে।

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট

harun_press@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম