মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সের গৌরবময় ভূমিকা

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.)
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম কোর্স বা ‘পাইওনিয়ার কোর্সে’র বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় ভূমিকার কথা ইতঃপূর্বে লিখেছি (যুগান্তর, ১৫.১১.২১)। এবার লিখছি দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সের ভূমিকার কথা।
প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ৬১ জন গেরিলা ক্যাডেটের প্রশিক্ষণ চলাকালীনই মুক্তিযুদ্ধে আরও জুনিয়র নেতৃত্বের প্রয়োজনে জেনারেল ওসমানী ও প্রবাসী মুজিবনগর সরকার আরও ওয়ার কোর্স পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশ সরকার তা অনুমোদন করে।
ফলে দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সের ক্যাডেট নির্বাচন কমিটি বিভিন্ন সেক্টর ও ইউনিট পরিদর্শন করে আরও ৭০ জন তরুণ অভিজ্ঞ, সুশিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন চৌকশ গেরিলা যোদ্ধাকে নির্বাচিত করে দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ক্যাডেট হিসাবে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাদের প্রেরণ করা হয় অ্যাডহক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, ভারতের মূর্তি নামক স্থানে। একই সিলেবাসে তাদের সুকঠিন প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের সুসংবাদ তখন সবার মুখে মুখে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তাদের প্রশিক্ষণের মাত্রা আরও তীব্রতর করা হয়। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ সুসম্পন্ন করা হয়।
সমাপনী কুচকাওয়াজের জন্য দুদিন তাদের রিহার্সেল প্যারেডও অনুশীলন করা হয়। কিন্তু ক্যাডেটদের কমিশনড অফিসার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আটকে যায়। এ অবস্থায় তাদের মনোবলে ভীষণ আঘাত লাগে। সবাই এ অমানবিক পরিশ্রম ও কঠিন প্রশিক্ষণের পর ভবিষ্যৎ নিয়ে একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েন।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়োল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সর্বত্র কমান্ড চ্যানেলও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। নিজেদের সুসংগঠিত করতে না পেরে সুসংহত অবস্থানেও ছিল না সেনাবাহিনী। কারণ আমাদের সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যা হোক, অনেকে ভুলে গেলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী তার ছেলেদের ভুলে যেতে পারেননি।
তিনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেই সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের ক্যাডেটদের স্বাধীন দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। অতঃপর বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে সাতটি ট্রাকে করে ৭০ জন ক্যাডেটকে মূর্তি থেকে শিলিগুড়ি বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশের পঞ্চগড় হয়ে রংপুর সেনানিবাসে আনা হয়। সেখানে তাদের ক্যাডেট (পরবর্তীকালে মেজর) মেসবাহ ও ক্যাপ্টেন (পরবর্তীকালে কর্নেল) নওয়াজেশ অভ্যর্থনা জানান।
একদিন রংপুরে অবস্থান করার পর তাদের ট্রেনযোগে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয়। এখানে আসার পর সবাইকে ১০ দিনের ছুটি প্রদান করা হয়। কিন্তু ছুটি শেষে ৬১ জন যোগদান করেন এবং ৯ জন অনুপস্থিত থাকেন।
হয়তো দীর্ঘদিন কঠোর প্রশিক্ষণের পরও কমিশন না পেয়ে এই ৯ জন হতাশ হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য আরও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হয়ে যোগদানে বিরত থাকেন। সুতরাং অবশিষ্ট ৬১ জনকে নিয়েই সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের কঠিন প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়।
শুরু হয় সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের অগ্নিপরীক্ষা। প্রথমেই তাদের অন-জব প্রশিক্ষণের জন্য সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। তারা মার্চ, এপ্রিল ও মে পর্যন্ত তিন মাসের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। অতঃপর আরও দুই মাসের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের জন্য সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের এসব ক্যাডেটের জন্য ঢাকা সেনানিবাসের কচুক্ষেতে মিলিটারি একাডেমির আদলে একটি অস্থায়ী ব্যাটল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন ৪৬ স্বতন্ত্র ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল জিয়াউদ্দিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর কিংবদন্তি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ‘দালাইলামা’ নামে পরিচিত ছিলেন।
তিনি স্বয়ং অস্থায়ী ব্যাটল স্কুলে (২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কর্তৃক পরিচালিত) বর্ধিত প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিন স্বভাবগতভাবেই অত্যন্ত ন্যায়নীতিবান ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক অফিসার ছিলেন। তার একনিষ্ঠতায় ক্যাডেটদের জীবন কঠিন হলেও দীর্ঘ দুই মাসের যে প্রশিক্ষণ তারা পেলেন, তা দিয়ে তারা তৈরি হলেন ইস্পাত কঠিন পেশাগত দক্ষ সামরিক অফিসার হিসাবে। ফলে সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের মোট প্রশিক্ষণকাল ছিল মূর্তিতে চার মাস, ইউনিটে তিন মাস এবং ব্যাটল স্কুলে দুই মাস; মোট নয় মাসের পূর্ণাঙ্গ সামরিক প্রশিক্ষণ, যা সামরিক ইতিহাসে বিরল।
কঠোর প্রশিক্ষণ শেয়ে ৬১ জন ক্যাডেটের বহু লালিত স্বপ্নের দিন সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ৬১ জনের মধ্যে ১৫ জনকে অযোগ্য ঘোষণা করে বাদ দেওয়া হয়। যা হোক, ঢাকা সেনানিবাসের বর্তমান সিগন্যাল মসজিদের বিপরীতে ২ ইস্ট বেঙ্গলের প্রশিক্ষণ মাঠে সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমির প্রথম পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট। সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু তখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তাই এ প্যারেডে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এ ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের অধিকাংশ সদস্য, সিনিয়র রাজনীতিকরা এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন এ জমকালো কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম পাসিং আউট প্যারেড। প্যারেড কমান্ডার ছিলেন ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার (বিএসইউও) মোদাচ্ছের হোসেন খান বীর প্রতীক, যিনি প্রথম স্থান অধিকারী হিসাবে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ‘সোর্ড অব অনার’ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মোদাচ্ছের হোসাইন খান ছিলেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ৪৭তম লং কোর্সের ক্যাডেট। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তার মায়ের অসুস্থতার কারণে ছুটিতে এসে পাকিস্তানে ফেরত না গিয়ে যোগদান করেন মুক্তিযুদ্ধে।
বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক র্যাঙ্কব্যাজ প্রদান : ৫ আগস্ট সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হলেও সেদিন সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের ক্যাডেটদের বহু লালিত স্বপ্ন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে র্যাঙ্ক ব্যাজ পরিধান করতে পারেননি। কারণ সে সময়ে বঙ্গবন্ধু গলব্লাডার অপারেশনের জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন।
সেখান থেকে তিনি নির্দেশ দেন, সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের অফিসারদের যেন বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভোজসভার মাধ্যমে সম্মানিত করে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং র্যাঙ্ক ব্যাজ পরিয়ে দেন। সুতরাং সে অনুযায়ী ৬ আগস্ট মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৪৬ জন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টকে বহু প্রতীক্ষিত কমিশন ও র্যাঙ্ক প্রদান করেন, যা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এ মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের জন্য একটি উচ্চ সম্মানের সোনালি অধ্যায়। অতঃপর তাদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আর্মস ও সার্ভিসেস ইউনিটে বদলি আদেশ প্রদান করা হয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ওয়ার কোর্সের ক্যাডেট হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল যুদ্ধরত সুশিক্ষিত টগবগে তরুণ-যুবকদের। যারা ততদিনে সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের সেসব দুঃসাহসী ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব অর্জন করেন।
দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের মোট আটজন কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অসামান্য ও দুঃসাহসিক অবদান রাখার জন্য বীরত্বসূচক উপাধিতে ভূষিত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন তিনজন ‘বীর বিক্রম’-মেজবাহ্ উদ্দিন আহমেদ, কাজী কামাল উদ্দিন আহমেদ ও কামরুল হক স্বপন (ক্র্যাক প্লাটুন থেকে দুজন) এবং পাঁচজন ‘বীর প্রতীক’-মোদাচ্ছের হোসাইন খান, সৈয়দ ইকরামুল হক খন্দকার, এম হুমায়ুন কবির চৌধুরী, রওশন ইয়াজদানি ভূঁইয়া ও জাহাঙ্গীর ওসমান ভূঁইয়া। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে কমিশনপ্রাপ্ত এ ব্যাচের সব অফিসারই ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ও দুর্দান্ত সাহসী।
এ কোর্স থেকে মেজর জেনারেল র্যাঙ্কে অলংকৃত হয়েছেন আ ল ম ফজলুর রহমান ও জীবন কানাই দাস। এ কোর্সের মেধাবী, দুঃসাহসী ও চৌকস অফিসাররা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখেছেন। এ কোর্সের সবচেয়ে পরিচিত মুখ মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান, যিনি রৌমারী-পাদুয়া যুদ্ধের সিংহপুরুষ হিসাবে বিশেষভাবে পরিচিত।
একটি মজার ব্যাপার হলো, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ও দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের সব অফিসারই অংশগ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর প্রথম কোর্স বা ‘পাইওনিয়ার কোর্স’ হলো ‘First Bangladesh War Course’। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং দুটি ওয়ার কোর্স একই সূত্রে গাঁথা। অন্য কোনো কোর্সের এত বেশিসংখ্যক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাননি।
বর্তমান বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমিরই ধারাবাহিকতার ধারক ও বাহক। বাংলাদেশ এমনি এমনি স্বাধীনতা লাভ করেনি। এর পেছনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের পূর্বসূরি সামরিক কর্মকর্তারা ও আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাবাহিনী।
তাদের রক্ত, ঘাম, সুবিশাল আত্মত্যাগ জড়িয়ে আছে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে। এত বিশাল ত্যাগ ও রক্তের ঋণ আমাদের দেশ ও জাতি কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রতি যথাযথ সম্মান, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্মরণ করে এবং আমাদের পূর্বসূরি বীরদের সম্মানিত ও মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য দোয়া করার মাধ্যমে আমরা এক গর্বিত জাতিতে পরিণত হতে পারি।
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com