আশেপাশে চারপাশে
সিঙ্গাপুর যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা দমনে সফল হয়েছে

চপল বাশার
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ থেকে খুব দূরে নয় দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। ঢাকা থেকে বিমানে চার ঘণ্টার পথ। শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। সেদেশে ৩০ বছর আগে থেকে বলবৎ রয়েছে একটি কঠোর আইন-যা জাতিগত, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে।
আইনটির নাম Maintenance of Religious Harmony Act, সংক্ষেপে MRHA (ধর্মীয় সম্প্রীতি সংরক্ষণ আইন)। সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ ১৯৯০ সালে আইনটি প্রণয়ন করেন এবং ১৯৯২ সালের ৩১ মার্চ থেকে এটি কার্যকর হয়। এ আইনে যে কোনো ধরনের ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাত-সহিংসতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব অপরাধ ঘটানোর মতো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কার্যকলাপ ও উসকানির জন্যও কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে আইনে।
আইনটি কার্যকর হওয়ার পর সেদেশে সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সিঙ্গাপুরের সব মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে। দেশটির সর্বক্ষেত্রে রয়েছে শৃঙ্খলা। এ কারণে দ্বীপরাষ্ট্রটি সার্বিকভাবে সমৃদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে।
কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন লি কুয়ান ইউ কঠোর আইন ‘এমআরএইচএ’ করেছিলেন, সেটি ফিরে দেখা যাক। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এর মধ্যে দেশের স্থায়ী বাসিন্দা বা নাগরিক প্রায় ৪০ লাখ, অন্যরা অস্থায়ী বা অভিবাসী। স্থায়ী বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশ চীনা, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া ১৫ শতাংশ মালয়ী মুসলিম, অবশিষ্ট ১৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও অন্যান্য।
সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী অথবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কখনো কখনো দ্বন্দ্ব বা ছোটখাটো সংঘাতের ঘটনা ঘটত। বড় ধরনের সহিংসতা ঘটে ১৯৬৪ সালের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে। চীনা ও মালয়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে সিঙ্গাপুরের সর্বত্র। এ দাঙ্গায় প্রাণ হারান ৩৬ জন, আহত হন পাঁচ শতাধিক। ব্রিটিশ শাসন থেকে সদ্যস্বাধীন সিঙ্গাপুর মালয় ফেডারেশনে যোগ দেয় ১৯৬৩ সালে। সিঙ্গাপুরের সরকারপ্রধান লি কুয়ান ইউ কঠোরহাতে দাঙ্গা দমন করেন। সমগ্র দ্বীপে দীর্ঘমেয়াদে কারফিউ জারি করা হয়। গ্রেফতার হয় দেড় হাজারের বেশি। এ দাঙ্গার পরই লি কুয়ান ইউ মালয় ফেডারেশন থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সিঙ্গাপুরকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট। দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সরকার গঠন করেন লি কুয়ান ইউ। চীনারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তার সরকারে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হন। সত্যিকার অর্থেই একটি জাতি ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই সেদেশের প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে। লি কুয়ান ইউর নেতৃত্বেই সিঙ্গাপুর একটি সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠে। সেদেশের জনগণ লি কুয়ান ইউকে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির জনকের মর্যাদা দিয়েছে।
১৯৬৪ সালের সেই দাঙ্গার পরই লি কুয়ান ইউ উপলব্ধি করেন, চীনা-মালয়ী জাতিগত তথা ধর্মীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের স্থায়ী অবসান প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি জোরদার করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সংখ্যালঘুরা যাতে যথাযথ মর্যাদায় নিরাপদ থাকে তাও নিশ্চিত করেন। ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার আগে তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতি সংরক্ষণ আইন (এমআরএইচএ) প্রণয়ন করেন। এ আইনের বিধান খুবই কঠোর। এতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে-কোনো ব্যক্তি লিখিত বা মৌখিকভাবে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, যে কোনো স্থানে বা অনুষ্ঠানে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত করতে পারে এমন কিছু করতে বা বলতে পারবেন না। আইন লঙ্ঘনকারীর জন্য দীর্ঘ মেয়াদের জেল ও ১০ হাজার ডলার জরিমানার বিধান রয়েছে। একই ব্যক্তি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে তাকে আরও বেশি সময়ের জন্য জেল ও ২০ হাজার ডলার জরিমানা করা হবে।
সিঙ্গাপুরের Inter-Religious Organisation, সংক্ষেপে IRO (আন্তঃধর্মীয় সংস্থা) সেদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সব ধর্মের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১৯৪৯ সালে আইআরও গঠিত হয়। সংস্থাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা ও তা সংহত রাখা। ২০০৩ সালে আইআরও Singapore Declaration of Religious Harmoû (ধর্মীয় সম্প্রীতিবিষয়ক সিঙ্গাপুর ঘোষণা) প্রদান করে। এ ঘোষণাকে গাইডলাইন হিসাবে নিয়ে আইআরও কাজ করে যাচ্ছে এবং মূল্যবান অবদান রাখছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে।
সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যে সহিংসতা আমরা দেখলাম, তার পরিপ্রেক্ষিতেই সিঙ্গাপুর সম্পর্কে কিছু বলা হলো। সিঙ্গাপুর সেখানকার সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সম্প্রীতি সমুন্নত রেখে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। সম্প্রীতি অটুট রাখার লক্ষ্যে কঠোর আইন করেছে। আমাদের দেশে এমন কোনো আইন আছে কি? সিঙ্গাপুরের মতো কঠোর আইন নেই। এমনকি প্রচলিত ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যা আছে, তাও সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। ফলে সহিংসতায় জড়িত অপরাধীরা দণ্ডিত হয় না, তারা অপরাধ করতেই থাকে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে আমাদের প্রয়োজন সিঙ্গাপুরের মতো কঠোর আইন, যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান থাকবে। আইন যাতে সঠিকভাবে সময়মতো প্রয়োগ হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সহিংসতার পর বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তাদের বক্তব্যে দেখা যায়, সবাই বিচারহীনতার কথা বলেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যত ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটারই বিচার হয়নি, কেউ শাস্তি পায়নি। এ কারণে সাম্প্রদায়িকতা ও সহিংসতা বেড়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে সহিংসতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জয়লাভ করার পরপরই ভোলা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় সব জেলা এবং উত্তরাঞ্চলে সিরাজগঞ্জ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা শুরু হয়। শিশুসহ হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হন। বহু বাড়ি লুট ও দখল করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে। নির্যাতিত বহু পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। শত শত হিন্দু পরিবার গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এবং অন্যত্র আশ্রয় নেয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এ নির্যাতন ও সহিংসতার জন্য আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল ও সামাজিক সংগঠন বিএনপি ক্যাডারদের দায়ী করে। যদিও বিএনপি নেতৃত্ব এ অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি, হামলাকারীদের গ্রেফতার বা বিচারও করেনি।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। ২০০৯ সালে ২০০১ সালের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট সুপারিশসহ জমা দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। এ কমিশনের রিপোর্ট যদিও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, কমিশন ১৮ হাজারের বেশি নারী ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করেছে। ৩ হাজার ৬২৫টি সহিংসতার ঘটনা তদন্ত করেছে। কমিশন সেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ২৫ হাজার লোককে দায়ী করে বলেছে. এ হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটের অন্তত ২৫ জন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি জড়িত ছিলেন। কমিশনের রিপোর্টে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুট ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনারও উল্লেখ করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার তখন বলেছিল, তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট মোতাবেক অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কমিশন রিপোর্ট দিলেও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার খবর পাওয়া যায়নি, কেবল সিরাজগঞ্জে এক নারীকে ধর্ষণের দায়ে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার খবর গণমাধ্যমে পাওয়া যায়।
এত বড় একটি সহিংসতার ঘটনা ঘটল ২০০১ সালে, বিচার কমিশন তদন্ত করল অথচ অপরাধীদের ধরা গেল না, বিচারও হলো না! এ কারণেই বিচারহীনতার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। অপরাধীর বিচার না হলে অপরাধীরা প্রশ্রয় পাবে, উৎসাহিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক ধরপাকড় হয়েছে। ইকবাল নামক মূল অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জানা যায়নি তার পেছনে কারা ছিল বা আছে। কবে জানা যাবে বা আদৌ জানা যাবে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
সাম্প্রদায়িকতা দমনে সিঙ্গাপুরের কঠোর আইন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। সিঙ্গাপুর কঠোর আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছে। এ ধরনের আইন আমাদের দেশেও করার কথা বলেছি। কিন্তু এখন ভাবছি কঠোর আইন করে কী হবে, তা যদি কাগজে-কলমে আর কিতাবেই থাকে? আইনের সাফল্য এর যথাযথ প্রয়োগের মধ্যেই থাকে। অন্যথায় বিচারহীনতার অভিযোগ থেকেই যাবে।
চপল বাশার : লেখক, সাংবাদিক
basharbd@gmail.com