![আরশির মুখে পড়শি দেখা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/10/26/image-479914-1635194601.jpg)
দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার চলাকালেই তালেবানরা আফগানিস্তানের দখল নেয়। উদ্ভূত সংকটময় পরিস্থিতিতে সেসময় কাবুল বিমানবন্দরে যাত্রীদের দেশ ছাড়ার হিড়িক চলছিল। বিরাজ করছিল ব্যাপক আতঙ্ক ও অরাজকতা। ২৬ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের স্থানীয় শাখা আইএস-কে (ইসলামিক স্টেট খোরাসান)-এর সন্ত্রাসী হামলার কয়েকদিন পরই ভয়াবহ একটি ড্রোন হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
একদিকে যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি এবং অন্যদিকে আইএস-কে’র হামলার প্রতিশোধের প্রেক্ষাপটেই চালানো হয় এ হামলা। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, আইএস-কে’র সদস্য সন্দেহে জামাইরি আহমাদি নামের যে ব্যক্তিকে লক্ষ করে এ ড্রোন হামলা চালানো হয়, তিনি ছিলেন পেশায় একজন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার এবং আফগানিস্তানে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সংস্থা নিউট্রিশন অ্যান্ড এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের দীর্ঘদিনের কর্মকর্তা। ওই হামলায় তার পরিবারের দশজন বেসামরিক লোক নিহত হয়।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি ঘটনাটিকে ‘ট্রাজিক মিসটেক’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জীবন নিয়ে এ কেমন ভুল? এ ভুলের পর আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
‘ফরেন পলিসি’তে চার্লি কার্পেন্টারের বক্তব্য অনুযায়ী, টার্গেটেড কিলিং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তবে ৯/১১-এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রতিনিয়ত এ আইনগুলো লঙ্ঘন করে আসছে। যা হোক, এটিই একমাত্র নিষেধাজ্ঞা নয়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লঙ্ঘন করেছে। গত বছর জানুয়ারিতে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের’ পর্যায়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এ নেতা। এ কারণে হত্যা করা হয় সামরিক এ কৌশলবিদকে।
ওই হামলায় আরও নিহত হন ইরাকি সিনিয়র মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিস। পরে ইরানের আরেক পরমাণু বিজ্ঞানীকেও হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনানুসারে এরা সবাই ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তি। এসব ‘টার্গেটেড কিলিং’ ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের পরিপন্থি।
আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম ছাড়াও টার্গেটেড কিলিং হলো ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’, এবং এটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া এবং ‘ন্যায়বিচারের অধিকার’কে অতিক্রম করে। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, ৯/১১-এর পর দীর্ঘ ২০ বছরে মার্কিন ড্রোন ও বিমান হামলায় কমপক্ষে ২২ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এসব আইন লঙ্ঘনের পরও জেনারেল সোলেইমানির হত্যাকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যায়সঙ্গত বলে উল্লেখ করেছে এবং মার্কিনিদের স্বার্থরক্ষায় প্রয়োজনে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেয় পেন্টাগন।
মার্কিন সমাজ প্রতিনিয়ত বর্ণবাদী বৈষম্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশের সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। উপরন্তু, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও রয়েছে দায়মুক্তির সংস্কৃতি। ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চ্যাম্পিয়ন’ নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশেই মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। আমেরিকায় পুলিশের মধ্যে বর্ণবাদ ও পুলিশের সহিংস আচরণ দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের ধারণা এখনো দাসত্ব ও উপনিবেশবাদের সময়েই আটকে আছে। চলমান মহামারির মধ্যেই, ২০২০ সালের মে মাসে, যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ (বিএলএম) নামে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়। ফ্লয়েডের মতো আরেক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ব্রেওনা টেইলরও একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, যখন তাকে আটকের অভিযানে পুলিশ আটবার গুলি করে। এরপর থেকে ফ্লয়েড ও টেইলর জাতিগত সহিংসতা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। দুর্ভাগ্যবশত, সব ভুক্তভোগী মিডিয়ায় সমান মনোযোগ পাননি।
ম্যাপিং দ্য পুলিশ ভায়োলেন্সের (এমপিভি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালে পুলিশ কর্তৃক মোট নিহতদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ২৮ শতাংশ, অথচ আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ হলো কৃষ্ণাঙ্গ। তদুপরি পুলিশ ভায়োলেন্স রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, পুলিশের হাতে ১১২০ জন নিহত হয়েছে; কিন্তু ৯৯ শতাংশ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। আমেরিকার আইনে পুলিশ অফিসারদের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ আইনি সুরক্ষা রয়েছে। এর ফলে এসব হত্যাকাণ্ড বিচারের আওতামুক্ত থাকে।
২০১০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া বিষয়ক বৈশ্বিক সমস্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ‘এনফোর্সড ডিসপ্যারেন্স প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। আশ্চর্যজনকভাবে এক দশক পর ২০২০ সালে মাত্র ১৩টি ইইউ সদস্যরাষ্ট্র ‘আইসিপিপিইডি’ কনভেনশনটি অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে বেশ সোচ্চার থাকে।
কিন্তু বিষয়টি যখন তার মিত্রদের বেলায় ঘটে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতালে’র ভূমিকা পালন করে। ইসরাইল, সৌদি আরব ও মিসরসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, আইনি অধিকার অস্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের হত্যা।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার পর থেকে ক্রমাগত ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা এবং জাতীয় নিরাপত্তা সমুন্নত রাখার যুক্তি’র অধীনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক নিখোঁজের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। ‘আবু গারিব’ ও ‘গুয়ানতানামো বে’র মতো কারাগারগুলো ভিকটিমদের আটকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। এআই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সেখানে অন্তত ৩৯ জন বন্দি ছিল।
এসব অপরাধ সংঘটিত হওয়ার জন্য মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারের ভূমিকাকে দায়ী করছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বিদ্যমান ‘ক্যাসল ডকট্রিন’ এবং ‘স্ট্যান্ড ইওর গ্রাউন্ড’ আইনের ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। সম্ভবত সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে, শুধু ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ মিলিয়ন বন্দুক বিক্রি হয়েছে। উল্লেখ্য, মহামারির মধ্যে মার্কিন প্রশাসন বন্দুকের দোকানকে অপরিহার্য দোকান হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে।
একটি দেশ প্রতিনিয়ত নিজ দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উপেক্ষা করে যখন অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে, তখন ব্যাপারটা দাঁড়ায় অনেকটা ‘আরশির মুখে পড়শি দেখা’র মতো। নিজ স্বার্থ হাসিলের কৌশল হিসাবে টার্গেটেড দেশগুলোর মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলে মূলত এসব দেশকে চাপের মধ্যে রাখাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।
মানবাধিকারের ‘প্রকৃত’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার বৈদেশিক নীতির লঙ্ঘন, দ্বৈততা ও ‘অনৈতিক’ দিকগুলো পরিহার করতে হবে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় দেশটির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তন্ময় চৌধুরী : গবেষক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক
ctonmoy555@gmail.com