ইসলাম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
মাওলানা মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভী
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘হে মানবজাতি! আমি নর ও নারী থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর আমি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার’। (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত : ১৩)।
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানুষ হিসাবে আমরা সবাই এক জাতি। আদম ও হাওয়া (আ.) থেকে সৃষ্ট মানবমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে সবাই আল্লাহতায়ালার কাছে সমমর্যাদার অধিকারী।
চামড়ার রং, ধনসম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদি দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার হতে পারে।
মহানবি (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে তাকওয়া তথা আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকি)।
আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর এ মহান বাণীতে ইসলামের অনন্য আদর্শ বিশেষত জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার নির্দেশনা উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। খোদার পৃথিবীতে বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।
এসব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার ঐক্য, সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার নামই হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটায়। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, গৃহযুদ্ধেও রূপ নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ইহকাল-পরকালের সব নেকির কাজও ধ্বংস হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। এটি এমন এক সার্বজনীন ও শান্তিময় জীবনব্যবস্থা, যেখানে শুধু মানব সম্প্রদায়ই নয় বরং পশুপাখি ও প্রকৃতির অধিকারও সংরক্ষিত রয়েছে। এ ধর্মে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইসলাম কায়েম করতে চায়, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বল প্রয়োগ নেই। কারণ সৎপথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।’ (সূরা আল বাকারার ২৫৬) ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকত, তাহলে হজরত রাসূল করিম (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি! এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সঙ্গেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সবার সৃষ্টি যেহেতু একই উৎস থেকে, তাহলে কেন একে অপরের সঙ্গে বিরোধ? কুরআন-হাদিস ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথের বাইরে যা কিছুই করা হবে তা ইসলাম নয়। আজকের সমাজে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ ধর্মের নামে বল প্রয়োগ, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি জুলুম-অত্যাচর করতে চান-যা মোটেও ইসলাম সমর্থন করে না।
ইসলাম সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ধর্ম পালনে কেউ বাধাগ্রস্ত হবে না। তাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয় ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে কোনোরূপ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কোনো মুসলমানের জন্য সমর্থনযোগ্য নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা (মূর্তিপূজক) ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।’ (সূরা আনয়াম : ১০৮) অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি) অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা সামর্থ্যবহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা জোর করে তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায়, তবে কেয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হবো (আবু দাউদ)।’
মহানবি (সা.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ ঘোষণা করেন, এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা রয়েছে। মদিনায় মুসলমান, ইহুদি এবং আওস ও খাযরায গোত্রসহ ১২টি উপগোত্রের বসবাস ছিল। চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে সব গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করা যায় মহানবি (সা.) মদিনাকে তার একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবি (সা.) ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। যেমন-সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। বহু ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মদিনার সনদ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মদিনার সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন সমাজের গোত্রগুলোর অন্তর্কলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয় (আবু দাউদ)।’
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার, রাসূল (সা.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে চিরতরে হারাম ও নাজায়েজ ঘোষণা করা হয়েছে।
মাওলানা মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভী : পেশ ইমাম ও ভারপ্রাপ্ত খতিব, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম
