Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ই-কমার্স প্রতারণা আদৌ বন্ধ হবে কি?

Icon

ডা. জাহেদ উর রহমান

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ই-কমার্স প্রতারণা আদৌ বন্ধ হবে কি?

কয়েকটি প্রতারক ই-কমার্স কোম্পানির পতনের পর লাখ লাখ মানুষ তাদের বিপুল অঙ্কের অর্থ হারিয়েছেন। বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর এখন সবরকম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকেই নানা কথা আসছে। চলছে একে অপরের ওপর দায় চাপানো এবং সবকিছু শেষ হওয়ার পর ক্ষেত্রবিশেষে সক্রিয়তা দেখানো।

ইভ্যালির মালিকদের গ্রেফতারের পর এ ব্যবসাগুলো যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, সেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সরাসরি দায় দেখছেন অর্থমন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রী অবশ্য সেটা মানতে নারাজ। ইভ্যালি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক কিছু বললেও জোর করেও কোনো আশা দেখাতে পারেননি। তার বক্তব্যে এটা মোটামুটি স্পষ্টই করেছেন যে, ইভ্যালির গ্রাহকদের টাকা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতির দায় সরকার নেবে না বলে জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ইভ্যালিসহ যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করেছে, তাদের কাছে গ্রাহকের যে পাওনা, তা পরিশোধের ব্যাপারে সরকার কোনো দায় নেবে না।’ সরকারের আর্থিক দায় নেওয়া প্রসঙ্গে কেন তিনি এটা বলেছেন, তার কারণ রয়েছে সম্প্রতি শেষ হওয়া সংসদ অধিবেশনে তোলা একটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

ধরে নেওয়া যাক, আলোচিত এই ই-কমার্স সাইটগুলো ইভ্যালির চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতো তাদের ব্যবসা শুরুর জন্য বেশকিছু দিন এ রকম অফার করেছে। ধরে নেওয়া যাক, এ খাতে তারা কয়েকশ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর তারা ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি কমিয়ে একটা সাধারণ ই-কমার্স সাইটে পরিণত হবে। এবং এটাও মনে করে নেওয়া যাক, ক্রেতাদের পণ্য প্রাপ্তিতে কিংবা পণ্য না পেলে টাকা ফেরত পাওয়াতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

মজার ব্যাপার, এ ইউটোপিয়ান পরিস্থিতিতেও এটা একেবারেই বেআইনি, এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়ার কথা ছিল না। পশ্চিমের অ্যান্টি-ট্রাস্ট ল-এর আদলে বাংলাদেশেও আইন আছে- প্রতিযোগিতা আইন ২০১২। আইনটি নিয়ে বিস্তারিত আলাপের জায়গা এ কলাম নয়। তবে আইনের নামটি দেখে নিশ্চয়ই বোঝা যায়, এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা।

এ আইনে একটি প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করার কথা এবং সেটা বাংলাদেশে আছে। আইনে সেই কমিশনের কার‌্যাবলি যা হবে তার প্রথম কথাটি হচ্ছে- ৮.১(ক) বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনগুলোকে নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা ও বজায় রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা। এরপর আইনের ১৫ ও ১৬ ধারায় উল্লেখ আছে, বাজারে প্রতিযোগিতা ক্ষুণ্ন করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিতে পারে না।

ইভ্যালি তো নিজের পণ্য দিয়ে ব্যবসা করেনি; তার নিজের কোনো পণ্য ছিল না। ইভ্যালি মূলত একটা ই-কমার্স প্ল্যাটফরম, যা বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে সংযোগ ঘটানোর দায়িত্ব পালন করেছে। এমনকি কোনো পণ্য উৎপাদনকারী যদি সেই পণ্যের মূল্যমানের তুলনায় অনেক কম দামে মাসের পর মাস পণ্য বিক্রি করতে থাকে, তাহলেও প্রতিযোগিতা কমিশনের সেই ব্যবসা চলতে দেওয়ার কথা নয়। আর ইভ্যালি তো নিজের কোনো পণ্য দিয়ে কাজটা করেনি; বরং অসংখ্য ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কাউকে কাউকে পণ্য দিয়ে যা করছিল সেটা বিশ্বব্যাপী অতি পরিচিত প্রতারণা- ‘পঞ্জি স্কিম’। ফলে এমন তথাকথিত ব্যবসা কীভাবে চলতে দেওয়া হলো?

হঠাৎ মানুষের টাকা মেরে না দিলেও শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বাজারে এমন একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইভ্যালি এবং অন্য ই-কমার্স সাইটগুলো কোনোভাবেই তৈরি করতে পারে না। এরপর আরও কয়েক মাস আগেই যখন জানা যাচ্ছিল ইভ্যালি মানুষের পণ্য দিতে পারছে না এবং পণ্য না পাওয়া মানুষের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না, তখন তো এ কোম্পানির চরিত্র সম্পর্কে দ্বিধার আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তখনো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই ব্যবসা আরও চলতে দিয়ে বহু মানুষের বড় ক্ষতির কারণ হতে দেওয়া হয়েছে; যত দিন গেছে তত বেশি মানুষ এ জালে জড়িয়েছে।

ইভ্যালির মালিকরা গ্রেফতার হওয়ার পর শোরগোলের মুখে ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান ই-কমার্স ব্যবসার লোকজনের সঙ্গে বসে অনিয়মের ব্যাপারে ‘হুংকার’ দেন। তিনি বলেন, ‘গ্রাহকদের প্রতারিত করার লক্ষ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য বিক্রি করেছে। ব্যবসাও করছে গ্রাহকের টাকায়। আগামীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে।’ তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, প্রতারণায় অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে গত বছর ১২ আগস্ট কমিশন মামলা করেছিল।

মজার ব্যাপার, যে দুটি প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যাপারে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারত তার মধ্যে প্রতিযোগিতা কমিশন একটি। এক বছরের বেশি সময় আগে মামলা করে সেটার অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে করোনাকে অজুহাত হিসাবে দেখিয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান। অথচ প্রতিযোগিতা আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী কমিশন কোনো ব্যবসা জনগণের বড় ক্ষতি করতে পারে এমন সন্দেহ করলে দুই দফায় ৬০ দিন করে মোট ১২০ দিন অর্থাৎ ৪ মাস ব্যবসাটি বন্ধ করে রাখতে পারত। কিন্তু সেটা তারা করেনি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মানুষকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারত। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ প্রতিষ্ঠানটি চাইলে সন্দেহজনক লেনদেনের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে পারে। সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালির লেনদেন এক মাস বন্ধও রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ওই নিষেধাজ্ঞা আর বাড়ানো হয়নি।

অথচ এটা কয়েক দফা বাড়িয়ে তদন্তের মাধ্যমে এ ব্যবসাগুলো অনেক আগে বন্ধ করে দিলে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ সংকটে পড়ত না। এ দুই সংস্থা এই সামান্য পদক্ষেপও নিয়েছে শুধু ইভ্যালির বিরুদ্ধে, ই-অরেঞ্জসহ একই ধরনের আরও ১৫-এর অধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা মিডিয়ায় অন্তত আসেনি। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানগুলোও গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা মেরে দিয়েছে।

সাম্প্রতিককালে ডিজিটাল মাধ্যমকে ভিত্তি করে এ কাণ্ডগুলো ঘটছে। কিন্তু এ ধরনের পঞ্জি স্কিমের ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অনেক ঘটেছে। যুবক, ইউনিপেটুইউ, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ মানুষকে পথে বসিয়েছে। চলার সময়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শেষে যখন কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তখন তাতে গ্রাহকের অন্তত কোনো লাভ হয়নি। গ্রাহক টাকা ফেরত পাননি। এখনো দেখা যাচ্ছে ঠিক একই পরিস্থিতি।

আমরা আলোচনার খাতিরে ধরে নিতে পারি- কোনো দেশে কিছু মানুষ নানা অন্যায় পথে সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করবে। হতে পারে সেটা ঘুস, চুরি, ডাকাতি বা প্রতারণা। একটি রাষ্ট্রের জনগণ তাদের করের টাকায় একটা সরকারকে পোষার পেছনে অনেক কারণের গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে এ ধরনের অন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়া। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলো কোনো গোপন ব্যবসা করেনি।

অসংখ্য মানুষকে ‘লোভের ফাঁদে ফেলে’ মাসের পর মাস এই ই-কমার্স সাইটগুলো তাদের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মিডিয়ায় অসংখ্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা। তাদের কেউ জাতীয় ক্রিকেট টিমের স্পনসর হয়েছে। বহু নামিদামি তারকা তাদের বিজ্ঞাপন করেছে বা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছে। মন্ত্রীরা তাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রশংসা করেছেন। তাহলে প্রশ্ন আসে, সেই সময় এ অন্যায়গুলো ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কী করছিল?

অতীতের প্রতারণাগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা হয়েছে। একটু পেছনে যাওয়া যাক। ডেসটিনি, যুবক বা ইউনিপেটুইউর ক্ষেত্রে আমরা কি দেখেছি কোনো একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কাউকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হয়েছে? ফৌজদারি ব্যবস্থা দূরেই থাকুক, কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তো জানি না আমরা।

এবারও যখন আমরা প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কথা বলছি, তখনো আমরা অনেকেই রাষ্ট্রীয় রেগুলেটরদের আইনের আওতায় আনার কথা বলছি না। অথচ রেগুলেটর, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ক্ষমতাশালী মানুষদের যোগসাজশ ছাড়া একেবারে প্রকাশ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে এমন প্রতারণা চালিয়ে যেতে পারার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

কিছুদিন আগে শেষ হওয়া সংসদ অধিবেশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে কথা বলতে গিয়ে বিএনপিদলীয় হুইপ দাবি করেছিলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রতারিত মানুষের হারানো অর্থ সরকারকে ফেরত দিতে হবে। সংসদে উত্থাপিত হওয়ার কারণেই বোধকরি বাণিজ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার এ আর্থিক দায়িত্ব নেবে না। এ ছাড়া কিছু আইনজীবী ও বিশ্লেষকও বলছেন, জনগণের করের টাকা দিয়ে এ ক্ষতিপূরণ সরকার দিতে পারে না।

এসব প্রতারণার ক্ষেত্রে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলাটা কি অযৌক্তিক? সরকারকে যেহেতু প্রতারিত জনগণের আর্থিক দায় নিতে হয় না, তাই সরকারের কিছু যায় আসে না এসব প্রতারণায় মানুষ সর্বস্বান্ত হলেও। তাই সরকারের রেগুলেটরদের নাকের ডগায় বসে এসব প্রকাশ্য প্রতারণার জন্য সরকারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করা গেলে সেটা সরকারকে ভবিষ্যতে একই ধরনের প্রকাশ্য প্রতারণা দ্রুত বন্ধ করার ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে বাধ্য করবে। সর্বোপরি প্রতিটি প্রকাশ্য প্রতারণার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল রেগুলেটরদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে রেগুলেটররা অদক্ষতা কিংবা অন্যায় যোগসাজশে যুক্ত হবে না।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব বিরোধিতা করলেও এ ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য নানা দিক থেকে একটি নতুন পূর্ণাঙ্গ আইন করার কথা বলা হচ্ছে। এমন একটা আয়নার দরকার আছে বলে মনে করি। কিন্তু যখন এর মধ্যে থাকা আইনগুলোর প্রয়োগ হয় না ঠিকমতো, তখন একটি নতুন আইন হলেই সেটা ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে, এমন আস্থা সরকারের ওপর রাখা যায় কি?

এ প্রতারণা ঠেকানোর জন্য সবকিছুর আগে যে বিষয়টি দরকার তা না থাকলে কোনো আইন জনগণের পাশে দাঁড়াবে সেটি আমি বিশ্বাস করি না। সেটি হলো সদিচ্ছা। সরকারের কি তা আছে? না থাকলে ভিন্ন চেহারায় এ ধরনের প্রতারণা আবারও হবে।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম