শতফুল ফুটতে দাও
হতাশাই শেষ কথা নয়
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। বাংলাদেশকে ঘিরে এর নাগরিকদের অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা ছিল। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের কথা বলতেন আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব। বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, এ দেশ অতীতে খুব সমৃদ্ধ ছিল। এটা নিছক কল্পকাহিনি নয়। বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই একটি সম্পদশালী ভূখণ্ড ছিল।
ওই একই সময়ের ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ধন-সম্পদের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের এ রূপকল্প কবি ডি এল রায়ের লেখায় অত্যন্ত আবেগমণ্ডিত ভাষায় ফুটে উঠেছিল। ডি এল রায় ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা/আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি রচনা করে ঐশ্বর্যময় বাংলাদেশের মুখোচ্ছবি এঁকেছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে দেশটি ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে দেশটি ভয়ানক রকম পেছনে পড়ে গিয়েছিল। তখন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ১৯৬৯ সালের স্তরে উন্নীত হওয়া। বাংলাদেশকে আবার কী করে সোনার বাংলায় পরিণত করা যায়, তার একটি কর্মকৌশল রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ বেনে দুম্যো। দুম্যোর প্রতিবেদনে একটি চমৎকার মন্তব্য ছিল-‘কত লোক কাজ করার আছে, কত লোক বেকার আছে’!
এ ধরনের সমস্যা শুধু বাংলাদেশের একার নয়। পৃথিবীর সব স্বল্পোন্নত দেশ এ প্যারাডক্সের মধ্যে পড়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ এমন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। তদসত্ত্বেও এই এগিয়ে যাওয়া টেকসই হয়নি। একটি দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়েছে কিনা, তা বোঝার জন্য আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় দৃষ্টিপাত করতে হয়।
কয়েক বছর আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করত। ব্যাপক দুর্নীতি সত্ত্বেও অবকাঠমো, কৃষি, শিল্প এবং বৈদেশিক রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বগতির ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ২১ শতাংশে নেমে এসেছিল। কিন্তু যেসব দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠেছিল, করোনা মহামারির ফলে তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এর একটি বড় কারণ হলো কর্মজীবী মানুষের মধ্যে বেকারত্বের বিস্তৃতি।
যারা দারিদ্র্যকে জয় করেছিল, তাদের জীবনযাত্রা মসৃণ হয়ে গেছে এমনটা দাবি করা যায় না। দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে তারা তাদের পদযুগল স্থির রাখতে পারেনি। করোনা মহামারিতে তারা ফসকে নিচে পড়ে গেছে। কেউ কেউ মনে করেন, যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে তাদের সংখ্যা ২ কোটি। এই হিসাব কিছুটা অনুমাননির্ভর। কারণ বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জরিপ করে দেখা হয় না কারা কাজ হারিয়ে আবারও দরিদ্র হয়ে গেছে। কত মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে একথা সত্য যে অনেক মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে।
পরিবেশ অর্থনীতির সংজ্ঞানুসারে সাসটেইনেবিলিটি দুই ধরনের, যথাক্রমে Strong sustainability ও Weak sustainability. Strong sustainability নিশ্চিত করতে হলে প্রকৃতির গায়ে আঁচড় কাটা মেনে নেওয়া হয় না। অর্থনীতিবিদরা বাস্তবসম্মত সমাধানে বিশ্বাসী। তারা Weak sustainability গ্রহণযোগ্য মনে করেন। এর অর্থ হলো দেশে বিদ্যমান পুঁজির যোগফল স্থিতিশীল রাখা। পুঁজি অনেক রকমের, যেমন-প্রাকৃতিক পুঁজি, বস্তুগত পুঁজি, মানব পুঁজি, সামাজিক পুঁজি, আর্থিক পুঁজি। Weak sustainability’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, ভিন্ন ভিন্ন পুঁজির স্টকের যোগফল যদি স্থির থাকে, তাহলে বলতে হবে অর্থনীতি টেকসই উন্নয়ন বা Sustainable Development-এর আওতার মধ্যে আছে।
যদি কোনো এক ধরনের পুঁজির স্টক হ্রাস পায় এবং অন্য এক ধরনের পুঁজির স্টক বৃদ্ধি পেয়ে সামগ্রিকভাবে সব ধরনের পুঁজির যোগফল স্থির থাকে, তাহলে Sustainable Development হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। প্রাকৃতিক পুঁজির মধ্যে রয়েছে জীববৈচিত্র্য, জলপ্রপাত, ঝরনা, নদী, জলাভূমি ও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর, বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের পরিমাণ ইত্যাদি।
জলাভূমির পানিতে যদি দূষণ হ্রাস করা যায়, বায়ু যদি দূষণমুক্ত হয় এবং শব্দদূষণ যদি কর্ণের সহন ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, তাহলে মানুষের জীবনযাত্রায় স্বর্গীয় নির্মলতা বজায় থাকবে। মানুষ শান্ত ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে বাস করতে আগ্রহী। ধারাবাহিকভাবে বছরজুড়ে এর নিশ্চয়তা না থাকলেও দেশের কিছু কিছু অঞ্চল যদি শব্দদূষণমুক্ত থাকে, তাহলে সেসব এলাকায় গিয়ে মানুষ নীরবতার স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালাবে।
এ নীরবতা এমন রূপ ধারণ করবে যে পাতায় পাতায় শিশিরের পতনের শব্দ শুনতে পাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশে লোভের সংস্কৃতিতে অনেক মানুষকে প্রাকৃতিক নীরবতা হননের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখি। যদি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভোগের মাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা Sustainable Development-এর মধ্যেই আছি।
পুঁজির বিভিন্ন ধরনের মধ্যে রয়েছে সামাজিক পুঁজি। সামাজিক পুঁজিতে যে দেশ যত সমৃদ্ধ হয়, সে দেশের উন্নয়নের গতি তত ত্বরান্বিত হয়। যে সমাজে পরার্থপরতা, সামাজিক সংহতি এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনকল্যাণের জন্য সংঘশক্তি জোরদার হয়, সে দেশ সামাজিক পুঁজির দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়। বাংলাদেশে এক সময় অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের সামাজিক পুঁজি ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে রাজনৈতিক বিভাজন পরিণত হয়েছে গোত্রগত সংঘাতের পর্যায়ে। সমাজের ভেতরকার বিরোধগুলোকে প্রশমিত না করে এগুলোকে ভয়াবহ মারমুখী করে তোলা হচ্ছে। এদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার মরণ খেলায় লিপ্ত রয়েছে। এর ফলে সামাজিক শক্তির প্রভূত সংকোচন ঘটছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে যেসব খবর পরিবেশিত হয়, তাকে ভিত্তি করে কেউ যদি মনে করে এ দেশ এবং এ সমাজ আত্মহননে লিপ্ত, তাহলে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। গত ২৮ সেপ্টেম্বরের সংবাদপত্রের একটি শিরোনাম হলো, ‘নিজের বাইকে আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ’।
স্যানিটারি সামগ্রীর ব্যবসা করে ভালোই চলছিল শওকত আলীর সংসার। করোনার কারণে তাকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়। এ ব্যবসায় তার ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়। বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহার ধারাবাহিকতায় শওকত আলী ৮০ হাজার টাকায় মোটরসাইকেল কিনে রাইড শেয়ারিংয়ের ব্যবসা শুরু করেন। সারাদিনে ৬০০-৭০০ টাকা আয় করতেন তিনি। বাজারে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকার জন্য তার রোজগার যথেষ্ট ছিল না। তবুও দিন কেটে যাচ্ছিল। ৩ সপ্তাহ আগে অ্যাপস ছাড়া রাইড শেয়ার চালানোর অপরাধে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা ট্রাফিক বিভাগ ১০০০ টাকার একটি মামলা দেয়।
২৭ সেপ্টেম্বর সকালের দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডে যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন শওকত আলী। এ সময় ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে তার কাগজপত্র নিয়ে যান। মামলা না দেওয়ার অনুরোধ করে পুলিশের কাছে গাড়ির কাগজপত্র ফেরত চান শওকত আলী। কাগজপত্র ফেরত না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
এ ঘটনার পর বাড্ডা থানা-পুলিশ শওকত আলীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশের কাছ থেকে শওকত ছাড়া পান ১১ ঘণ্টা পর। শওকত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সারাদিন মোটরসাইকেল চালাব আর অ্যাপ কোম্পানি ২৫ পারসেন্ট টাকা কেটে নিয়ে যাবে-এটা হয় না। আবার অ্যাপ ছাড়া বাইক চালালে পুলিশ মামলা দেবে-এসব ক্ষোভে আমি বাইক জ্বালিয়ে দিয়েছি।’
করোনা সংক্রমণের ফলে বাংলাদেশের গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুব কষ্টে আছে। পরিবারের মধ্যে কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হয়, তাহলে দুর্দশার সীমা থাকে না। মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার জন্য অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বে জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা ও চিন্তাভাবনা নতুন একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
শওকত আলীর ব্যথা-যন্ত্রণা ও ক্ষোভ কতটা চড়িয়ে উঠেছিল যে সে কষ্টার্জিত অর্থে কেনা মোটরসাইকেলটি ভস্মীভূত করতে দ্বিধা করেনি। বাংলাদেশে বিত্তহীন মানুষ জীবন ধারণে নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছে। এদেশের মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা নতুন নতুন কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছে।
উপায়ান্তহীন মানুষগুলোর দুঃসময়ে রাষ্ট্রকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। অথচ সামর্থ্যবানরা প্রণোদনার নামে সহায়তা পাচ্ছে। এ ভেদনীতি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল তিউনেশিয়ায়। সেখানে পুলিশ এক গরিব ফল বিক্রেতার ভ্যানগাড়ি উলটে দিয়েছিল। ফল বিক্রেতা নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফল বিক্রেতার এ বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ বিচ্ছিন্ন থাকেনি। তিউনেশিয়ায় ব্যাপক গণবিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এ বিক্ষোভের ব্যাপকতা এত বেশি ছিল যে তিউনেশিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলী জায়নুল আবেদীন দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তিউনেশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো এ বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। বেশ ক’বছর শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকার পর তিউনেশিয়ায় নতুন করে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে অবশ্য শওকত আলীর বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ বিক্ষোভের তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে আর কোন ঘটনায় ঝড় উঠবে কেউ তা বলতে পারে না। ১৯৬৮’র শেষদিকের এ ঘটনাটি তৎকালীন আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়নি। ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৮ পল্টন ময়দানে ছিল মওলানা ভাসানীর জনসভা।
সেই সভায় রিকশা শ্রমিকদের নেতা আবদুস সেলিম বেবিট্যাক্সি চালকদের ওপর ট্রাফিক পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীকে হরতাল দেওয়ার আহ্বান জানান। মওলানা ভাসানী হরতালের ডাক দিলেন। ঢাকায় ৬ ও ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮ অত্যন্ত সফল হরতাল হলো। হরতালে আব্দুল মজিদ ও আবু নামে দুই ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন।
বহুদিন পর রাজনৈতিক বন্ধ্যত্ব কেটে গেল, যা ১৯৬৯-এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সূচনা সম্ভব করে তোলে। অথচ এ ঘটনার আগে ১৯৬৪ সাল থেকে প্রতিবাদী রাজনীতির আবির্ভাবের কোনো লক্ষণ ছিল না। সর্বত্র ছিল হতাশার নিকষ কালো অন্ধকার। আমরা জানি, রাত যত গভীর হয় ভোর তত ঘনিয়ে আসে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ