Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লিখুন

Icon

ড. মুনীর উদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লিখুন

ফাইল ছবি

১৯৯৯ সালের ঘটনা। টেক্সাসের এক জুরি অস্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখার কারণে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় এক চিকিৎসককে দোষী সাব্যস্ত করে রোগীর পরিবারকে ২ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা প্রদান করার হুকুম দেন। প্রেসক্রিপশন পড়তে ভুল করে ভুল ওষুধ ডিসপেন্স করার জন্য ফার্মাসিস্টকেও একই পরিমাণ জরিমানা পরিশোধের আদেশ দেন। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. রামচন্দ্র কল্লুরু এনজাইনার জন্য রেমন ভেসকুয়েজ নামের এক রোগীকে ৬ ঘণ্টা অন্তর অন্তর ২০ মি.গ্রা. সরডিল (আইজোসরবিড ডাইনাইট্রেট) গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে প্রেসক্রিপশন প্রদান করেন। কিন্তু প্রেসক্রিপশন পড়তে না পারার কারণে ফার্মাসিস্ট রোগীকে একই মাত্রার অর্থাৎ ২০ মি. গ্রামের উচ্চ রক্তচাপের ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার গ্র“পের ওষুধ প্লেন্ডিল (ফেলোডিপিন) প্রদান করেন। উচ্চ রক্তচাপের ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার গ্র“পের এ ওষুধ প্লেন্ডিলের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা হলো ১০ মি. গ্রাম। অত্যধিক মাত্রার এ ওষুধ গ্রহণ করার একদিন পর রেমন ভেসকুয়েজ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন এবং এর কিছুদিন পর তিনি মারা যান। চিকিৎসকের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আদালত কোনো প্রশ্ন তোলেননি। রোগী মৃত্যুর জন্য অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা তার প্রেসক্রিপশনকে দায়ী করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং জরিমানা করা হয়। রেমন ভেসকুজের আইনজীবী মি. বাকিংহাম প্রশ্ন তুলে বলেন, প্রেসক্রিপশন লেখার আগে চিকিৎসকদের কি ভাবা উচিত নয় যে, তার অস্পষ্ট হাতের লেখার কারণে রোগী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? এর পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন পরবর্তী কয়েক বছরে প্রেসক্রিপশন লেখার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন চিকিৎসকদের স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসক্রিপশন লেখার পর তাতে কোনো ভুলত্র“টি আছে কি না বা তা পাঠযোগ্য কি না তা পুনর্বার পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলা হয়। যেসব চিকিৎসকের হাতের লেখা খারাপ, তাদের কম্পিউটার ব্যবহারের অনুরোধ জানানো হয় অথবা অন্তত ব্লক লেটার ব্যবহার করতে আহ্বান জানানো হয়।

আমাদের দেশেও বহু চিকিৎসক স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখেন না। এ নিয়ে ওষুধ বিক্রেতা ও রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অতীতে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো অস্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, স্পষ্ট অক্ষরে পাঠ উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন লেখার হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করায় সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী দিনাজপুরে কোনো এক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুজন চিকিৎসককে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। নোটিশে সাত দিনের মধ্যে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। নোটিশ সূত্রে জানা যায়, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দিনাজপুরের সেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন রিপোর্টার তার মাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। এ সময় চিকিৎসক তার চিকিৎসা শেষে রোগীকে প্রেসক্রিপশন দেন। লেখা স্পষ্ট না হওয়ায় রোগীর স্বজনদের প্রেসক্রিপশনে উল্লিখিত ওষুধ কিনতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ওষুধের দোকানিরা প্রেসক্রিপশনে কী লেখা রয়েছে, তা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে হাইকোর্ট থেকে চিকিৎসকদের স্পষ্ট অক্ষরে পাঠ উপযোগী ব্যবস্থাপত্র লিখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

আমি প্রায়ই অপাঠযোগ্য প্রেসক্রিপশন হাতে পাই। এর মধ্যে বেশির ভাগই পড়তে পারি না। কিছুদিন আগে এক রোগীর জন্য অর্ধডজন ডিগ্রিধারী একজন চিকিৎসক একটি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। দোকানদার/ফার্মাসিস্ট দুয়েকটি ছাড়া বাকি সব ওষুধের নাম পড়তেই পারেননি। পরিচিত রোগী প্রেসক্রিপশনটি আমার হাতে দিয়ে বললেন-দেখুন তো স্যার, প্রেসক্রিপশনের ওষুধগুলোর নাম পড়তে পারেন কি না। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, প্রেসক্রিপশন নিয়ে আমার কাছে কেন এসেছেন? ভদ্রলোক বললেন, দোকানদার কয়েকটি ওষুধের নাম পড়তে পারেনি বলে ওষুধ দেয়নি। ভাবলাম, আপনি হয়তো পড়তে পারবেন। আর কিছু না বলে প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধগুলোর নাম উদ্ধার করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু রীতিমতো দুঃসাধ্য কর্ম বলে মনে হলো। সেই সনাতনী ও চিরাচরিত প্রক্রিয়ার বাজে ও অপাঠ্য হাতের লেখা। প্রেসক্রিপশনটি হাতে নিয়ে ভাবছিলাম, স্পষ্ট অক্ষরে পাঠ উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন লেখার হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীর দিনাজপুরের দুজন চিকিৎসককে আইনি নোটিশ পাঠানো যথাযথ হয়েছিল। জেনেরিক নামে ব্লক লেটার বা প্রিন্ট করার মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন লেখার আদালতের আদেশটি আমাদের চিকিৎসকরা মেনে চলছেন না-জরিপ করলে তার প্রমাণ পেতে এখনো কোনো কষ্ট হয় না। অনেকদিন আগ থেকে ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে আমি জানতে পেরেছিলাম-আদালতের নির্দেশ মেনে প্রেসক্রিপশন লিখছেন, এমন চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই অল্প। আর এ কারণে রোগী ও ওষুধ বিক্রেতাদের ভোগান্তিও কমছে না।

পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি উচ্চ আদালত চিকিৎসকদের ব্লক লেটার বা প্রিন্ট করে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখতে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য স্বাস্থ্য সচিবের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। নির্দেশে ছয় মাস তদারকির পর আদালতের নির্দেশ মেনে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লিখছেন কি না, তা আদালতকে জানাতে বলা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চিকিৎসকসমাজ আদালতের উল্লিখিত নির্দেশ পুরোপুরি মেনে এখনো প্রেসক্রিপশন লিখছেন না।

একজন ফার্মাসিস্ট হিসাবে চিকিৎসকসমাজের কাছে আমি আহ্বান জানাই, অনুগ্রহ করে আপনারা আপনাদের চিরাচরিত আচরণ পরিবর্তন করে আদালতের নীতিমালা অনুসরণ করে পরিপূর্ণ তথ্য ও পরামর্শ প্রদানপূর্বক স্পষ্ট ও ঝকঝকে পাঠযোগ্য অক্ষরে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লিখুন। চিকিৎসা পেশার নীতিশাস্ত্রেও এই একই নির্দেশনা দেওয়া আছে। সুন্দর ও পাঠযোগ্য প্রেসক্রিপশন লিখলে আপনাদের মান-মর্যাদা ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে, মানুষও উপকৃত হবে। অপাঠ্য প্রেসক্রিপশনের ভুল ওষুধ সেবন বা গ্রহণ করে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বা মারা যাবে না।

ওষুধের অযৌক্তিক প্রয়োগের বড় উৎস হলো চিকিৎসকের রোগ নির্ণয় ও প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসক ঠিকমতো রোগ নির্ণয় করে যুক্তিসংগতভাবে ওষুধ প্রদান না করলে রোগী ওষুধের অপব্যবহারজনিত সমস্যার শিকার হবে। চিকিৎসক তার দায়িত্ব সঠিক ও নির্ভুলভাবে পালন করলেও ওষুধের ডিসপেনসিং যুক্তিসংগত বা সঠিক না হলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধ সম্পর্কে রোগীকে পর্যাপ্ত ও প্রকৃত তথ্য, পরামর্শ বা উপদেশ প্রদান করা না হলে যুক্তিহীন ব্যবহারের কারণে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশনে ওষুধ প্রদানে চিকিৎসক যত সতর্কতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করবেন, রোগী তত বেশি উপকৃত হবে। রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে চিকিৎসকদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে-চিকিৎসকের কাছে গেলে ওষুধ ছাড়াই রোগীর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক সত্য রয়েছে। কারণ, রোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় শরীর ও মনের যোগসূত্র অভিন্ন। উন্নত বিশ্বে প্রকৃত চিকিৎসা শুরুর আগে চিকিৎসকরা প্রায়ই রোগীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাঙা করার উদ্যোগ নেন। রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য প্রদান এবং চিকিৎসা সম্পর্কে অবহিত করতে চিকিৎসকরা সদা সচেষ্ট থাকেন। এতে রোগীর আস্থা ও আÍবিশ্বাস বেড়ে যায়। রোগী সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ন্যায়সংগত তথ্য জানার জন্য চিকিৎসককে প্রশ্ন করার অধিকার রাখেন। এতে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রয়োগে ভুল কম হয় বলে ওষুধের অপব্যবহারও কমে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসককে একটির বেশি দুটি প্রশ্ন করলেই চিকিৎসক বিরক্ত হন ও খ্যাপে যান। কারণ বেশি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় তাদের নেই। এ আচরণ প্রশংসনীয় নয়।

রোগীর প্রতি একটু সদয় ও সহানুভূতিশীল হলে রোগীর আস্থা অনেক বেড়ে যায়, রোগী খুশিও হয়। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা তাদের প্রেসক্রিপশনে যেসব ওষুধ লিখে থাকেন, তার সবগুলো যুক্তিসংগতভাবে লিখেন না। ওষুধের এই অযৌক্তিক প্রয়োগের পেছনে বহুবিধ কারণ কাজ করে। বহু চিকিৎসক পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে রোগীকে সঠিক ওষুধ প্রদানে সক্ষম হন না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব চিকিৎসক নিজেদের যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন না। এসব চিকিৎসক সাধারণত সনাতনী পদ্ধতিতে যুগ যুগ ধরে সেকেলে মানসিকতা নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যান বলে রোগ নির্ণয় বা ওষুধ প্রদানে প্রায়ই ভুল হয়। আমাদের মতো দেশে অতি মাত্রায় ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে রোগীর প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে চিকিৎসকরা অসর্তকতা ও অবহেলার কারণের রোগীকে সঠিক চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হন।

অন্যদিকে বহু চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক প্রভাবান্বিত ও প্রলুব্ধ হয়ে গুণগত মানসম্পন্ন এবং সস্তা ওষুধের পরিবর্তে দামি ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন। আবার অনেক চিকিৎসক দেশে উৎপাদিত মানসম্পন্ন ওষুধ বাদ দিয়ে বিদেশি নামিদামি ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। এতে রোগীর আর্থিক ক্ষতি হয়। এই আচরণ বদলানো উচিত। ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বাজারজাত করার পর ওষুধ প্রমোশনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে তাদের ওষুধের কাটতি বাড়ানোর জন্য। ওষুধের কাটতি বাড়ানোর জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর মূল টার্গেট থাকে চিকিৎসক। কারণ চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে যে ওষুধ লিখেন, রোগী মূলত সেই ওষুধই কিনে থাকে। অধিক হারে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ওষুধ কোম্পানিগুলো সাধারণত টনিক, ভিটামিন, হজমিকারক, বলবৃদ্ধিকারক, এনজাইম, কফমিকচার, অ্যালকালাইজার জাতীয় অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদনে বেশি তৎপর থাকে। কারণ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের চেয়ে এসব তথাকথিত ওষুধে মুনাফার হার বহুগুণ বেশি। এ মুনাফার হার আরও অধিক গুণে বেড়ে যায়, যখন চিকিৎসকরা তাদের প্রেসক্রিপশনে এসব ওষুধ নামধারী পণ্য নির্বিচারে প্রেসক্রাইব করে থাকেন।

ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে এসব ওষুধ প্রেসক্রাইবারদের সম্পর্ক যতটা না পেশাগত, তার চেয়ে বেশি ব্যবসায়িক। ব্রিটেনে চিকিৎসকপিছু ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতিবছর দুই লাখ টাকা ব্যয় করে। বাংলাদেশে এই ব্যয়ের প্রকৃত পরিমাণ কত, তা কে জানে! ওষুধ প্রশাসনের এক সাবেক পরিচালকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের মোট বিক্রির দশ শতাংশ অর্থ চিকিৎসকদের কমিশন দেওয়া বাবদ ব্যয় করে। তার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মোট ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মোট বিক্রির দশ শতাংশ হিসাবে প্রদত্ত কমিশনের পরিমাণ দাঁড়ায় পনেরো শ কোটি টাকা। চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে কমিশন দেয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। মজার ব্যাপার হলো, চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন পেলেও ওষুধ কোম্পানিগুলো কমিশন বাবদ প্রদত্ত সব টাকা তুলে নেয় মানুষের পকেট থেকে।

চিকিৎসকরা শুধু ওষুধ কোম্পানি থেকেই কমিশন নেয় না। তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকেও মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে থাকে। আর এ কারণেই প্রায় সব চিকিৎসক রোগীকে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক টেস্টের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো ডায়াগনস্টিক টেস্টের পেছনে অসহায় দরিদ্র রোগীদের হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, চিকিৎসকদের এ ধরনের অনৈতিক কমিশন বাণিজ্যের কারণে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় দিনদিন বেড়েই চলেছে। তবে ঢালাওভাবে সব চিকিৎসকের প্রতি এ ধরনের অভিযোগ প্রযোজ্য নয়। আমাদের দেশে অনেক চিকিৎসক আছেন, যারা এ কমিশন বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ অনৈতিক হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং তারা কোনো কমিশন নেন না।

অর্থ ছাড়াও ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের প্রচুর পরিমাণে ওষুধ ফ্রি স্যাম্পল হিসাবে উপহার দিয়ে থাকে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, এ ফ্রি স্যাম্পল আর ঘুসের মধ্যে পার্থক্য অতি নগণ্য। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, চিকিৎসকরা এ ফ্রি স্যাম্পল কেন গ্রহণ করেন বা এই ওষুধ নিয়েই বা তারা কি করেন? এভাবে ফ্রি স্যাম্পল নেওয়া বা দেওয়া নীতিগতভাবে বৈধ হতে পারে না। আমি অসংখ্য ওষুধের দোকানের কথা জানি, যেখানে হাজার হাজার টাকার ফ্রি স্যাম্পল হিসাবে পাওয়া ওষুধ বিক্রি হয়। এসব ফ্রি স্যাম্পল না নিলে চিকিৎসকদের কী এমন ক্ষতি হয়! শুনেছি, অনেক চিকিৎসক এসব ওষুধ গরিব রোগীদের দান করেন।

ওষুধের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের ফলে রোগী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধের কোনটি প্রয়োজনীয়, কোনটি অপ্রয়োজনীয় বা প্রদত্ত ওষুধের সঙ্গে সৃষ্ট রোগের আদৌ সম্পর্ক রয়েছে কি না-এসব প্রশ্ন উপস্থাপন করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা রোগীরা সচরাচর রাখে না। ফলে রোগী প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ওষুধ কিনতে ও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। প্রেসক্রিপশন মোতাবেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কিনলে রোগী কেবল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হয় না; একই সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক বা ক্ষতিকর ওষুধ খেয়ে রোগী মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। এ ক্ষতির দায়দায়িত্ব থেকে চিকিৎসক অব্যাহতি পেতে পারেন না। উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগীরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। অনুন্নত দেশে রোগী এই সুবিধা বা অধিকার ভোগ করে না।

পরিশেষে একটি কথা। মানবসেবায় চিকিৎসকদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। মানুষ রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যায়, চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে রোগীকে ওষুধ দেন এবং রোগী সেই ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মানুষের কাছে চিকিৎসকদের সম্মান ও মান-মর্যাদা অনেক বেশি। আমাদের মতো গরিব দেশের অসহায় ও দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অসহায়ত্ব, অভাব-অনটন ও দুর্দশার কথা চিকিৎসক সমাজ না ভাবলে, না বুঝলে তাহলে কে ভাববে, কে বুঝবে?

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

drmuniruddin@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম