বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির বিকল্প নেই
এম এ খা লে ক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ দিনের ‘রোড শো’র আয়োজন করে।
সরকারের একজন পরামর্শকসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি এ ‘রোড শো’তে অংশগ্রহণ করে। সেখানে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের বিদ্যমান বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশের তথ্য তুলে ধরা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ‘রোড শো’ চলছিল, তখনই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
সম্পাদকীয়টিতে যে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে, এতে সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন শীতের অতিথি পাখির মতো। শীতের অতিথি পাখি যেমন কোনো জলাশয়ে প্রচুর মাছ ও পোকা-মাকড় এবং জীবনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পেলে আশ্রয় গ্রহণ করে না, বিদেশি বিনিয়োগকারীও তেমনি। কোনো দেশে কার্যকর বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ, পুঁজির পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং ইপ্সিত মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা না দেখলে তারা সেই দেশে বিনিয়োগ করেন না।
কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চাইলেই অন্য যে কোনো দেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা চাইলেও আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে অন্য দেশে বিনিয়োগ করার অনুমতি পান না। তাই তাদের অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজ দেশে বিনিয়োগ করতে হয়।
বিভিন্ন পর্যায় থেকে দেশের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করা হয়। কারও কারও মন্তব্য শুনলে মনে হয়, বাংলাদেশ যেন বিনিয়োগের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। সত্যি যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের দেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের পরিমাণ এত কম কেন?
গত অর্থবছরে বিনিয়োগের হার দাঁড়িয়েছে জিডিপির ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের এ হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । অনেক দিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ২২-২৩ শতাংশে সীমিত রয়েছে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও তা অর্জিত হয়নি। অবশ্য আমাদের দেশে একটি সুবিধা হচ্ছে, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও প্রণেতাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি অর্থবছরের প্রথম ষাণ্মাসিকের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছরও ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু অর্জন হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন, তা অর্থবছরের ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) সময়কে ধারণ করে। আর বাংলাদেশ যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, সেখানে অর্থবছরের পুরো সময় অর্থাৎ ১২ মাসই কভার করা হয়।
তাই তাদের ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রা অধিকতর যৌক্তিক এবং সময়কে ধারণ করে প্রণীত হওয়াটাই ছিল সঙ্গত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়। এটা তারাও জানে। কিন্তু তারপরও অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের ব্যাংক ঋণ প্রবাহের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে।
সেখানে ইন্দোনেশিয়ার ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ১ শতাংশ ও পাকিস্তানের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোর্ট মার্কেটে বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান আমাদের জন্য যতটা না প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা তৈরি করছে ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকা। এ দুটি দেশের ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়েছে।
করোনা সংক্রমণজনিত কারণে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তাই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছেন। কথায় বলে, ‘এক ফোঁটা মধুতে যে সংখ্যক মাছি বসে, এক মণ বিষেও তা বসে না।’ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কারও মুখের কথায় কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। তারা একটি দেশের কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ পর্যালোচনা করেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। এটা ভাড়া বাসার মতো নয় যে ভালো না লাগলে ছেড়ে দিলাম।
বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রী এবং বাড়ি করার সময় জমির মালিকানা ভালোভাবে যাচাই করতে হয়। তা না হলে আখেরে পস্তাতে হয়। বিনিয়োগ করার বেলায়ও কথাটি প্রযোজ্য। একটি দেশের উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ পর্যালোচনা না করে বিনিয়োগ করা হলে পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে গিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়ে পুঁজি হারিয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল নয়।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে সেদেশের কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করেন। আর এ যাচাই-বাছাইয়ের সবচেয়ে বড় উপকরণ বা মাধ্যম হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা সহজে ব্যবসা করার সূচক। বিশ্বব্যাংক ২০২০ সালে যে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৮তম। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৬৩, ভিয়েতনাম ৭০, ইন্দোনেশিয়া ৭৩, ভুটান ৮৯, নেপাল ৯৯, শ্রীলংকা ৯৯ এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১০৮তম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ একটানা শীর্ষস্থানে ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা নিচে নেমেছে; তবে এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে। বাংলাদেশ দুর্নীতি সূচকে শীর্ষস্থান হারালেও দুর্নীতি কমেনি, বরং দিন দিন বাড়ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি এখন উপহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে একশ্রেণির মানুষ দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে; কিন্তু আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছি না। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণে দুর্নীতিই বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের দুর্নীতি আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত একটি প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রতি বছর অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ওপর যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, তার বাস্তবতা বা সঠিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকার যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করে-বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবি তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে। সরকারও তার অবস্থান থেকে সরে আসে না। উন্নয়ন সহযোগীরাও তাদের অবস্থানে অনড় থাকে। এ
কই সময়ে একটি দেশের প্রবৃদ্ধির হার তো দুরকম হতে পারে না। বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে সঠিক পরিকল্পনা প্রণীত হতে পারে না। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সরকারিভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এখন বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির সাময়িক হার দেখানো হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অনেকে মনে করছেন, চূড়ান্ত হিসাবে এটাও ঠিক থাকবে না।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করেছে। এটা কি প্রকৃত রেমিটেন্স নাকি অন্য কোনোভাবে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা রেমিট্যান্সের নামে দেশে আসছে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ কমে গেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ লক্ষণীয়ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল কারা ভোগ করছেন, তাও বিবেচ্য বিষয় বটে। একশ্রেণির মানুষ রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করে নিচ্ছে। বিদেশে পাচার করছে। দেশে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মধ্যে বৈষম্য স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিত্তবান-বিত্তহীনের মাঝে বৈষম্য সূচক ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। ২০১৬ সালে তা শূন্য দশমিক ৪৮৩-এ উন্নীত হয়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েল্থ-এক্স তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১২-২০১৭ সময়ে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ সম্পদে আছে এমন বিত্তবানের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের আর কোনো দেশে অতি বিত্তবানের সংখ্যা এতটা বৃদ্ধির নজির নেই।
দেশে যদি বিনিয়োগের এত মধুর পরিবেশ বিরাজ করে, তাহলে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের অর্থ বিনিয়োগে আসছে না কেন? ব্যাংকগুলো ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগযোগ্য তহবিল নিয়ে বসে আছে; কিন্তু উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য আসছেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিবেশ এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের অবস্থাও বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখেন। কাজেই বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ও কার্যকর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক