করোনায় কাজ হারানোদের জন্য নতুন কাজের সন্ধান

আবু তাহের খান
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

করোনায় গত দেড় বছরে দেশে মোট কত লোক কাজ হারিয়েছে, সে বিষয়ে বেশকিছু প্রাক্কলন ও জরিপের ফলাফল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির (ডিসিসিআই) সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, করোনার কারণে দেশে প্রায় ২২.৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে (ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ৭ আগস্ট ২০২১)। তবে কোনো কোনো সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি হতে পারে। ২৬ লাখ বা ৩০ লাখ যাই হোক না কেন, এটি যে সিকি কোটির বেশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যে কারা কোথায় কাজ হারিয়েছে, সম্প্রতি সে তথ্যের একটি বিবরণীও প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ করোনায় কাজ হারিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ঢাকায় ৭৬ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৫৯ শতাংশ (দ্য ডেইলি স্টার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১)।
কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যা ও স্থান চিহ্নিত করতে পারার পর এখন জানা দরকার কাজ হারিয়ে বর্তমানে তারা কে কোথায় অবস্থান করছে। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষাভিত্তিক পরিসংখ্যান হাতের কাছে না থাকলেও মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর স্থান চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত তথ্য এবং গণমাধ্যমের খবরাখবর ও সামাজিক আচরণের প্রবণতা থেকে প্রতীয়মান হয়, করোনাজনিত লকডাউন প্রত্যাহারের পর মানুষ আবার ক্রমান্বয়ে শহরমুখী হতে শুরু করলেও কর্মচ্যুত এ জনবলের একটি বড় অংশ এখন পর্যন্ত গ্রামেই অবস্থান করছে। অতএব করোনায় কাজ হারানো মানুষদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করতে হলে সর্বাগ্রে তা গ্রামেই করতে হবে এবং তা অবশ্যই উন্নত মানের এবং আধুনিক নাগরিক মানসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, যাতে এসব কাজে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তারা কোনোরূপ দ্বিধাবোধ না করেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, শহর থেকে করোনার কারণে গ্রামে ফেরা মানুষদের গ্রামে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে, গ্রামে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার পরও হয়তো শহরজীবনে অভ্যস্ত এসব মানুষের একটি বড় অংশ গ্রামে থাকতে চাইবেন না, যদি না গ্রামেই তাদের জন্য শহরের কাছাকাছি মানের জীবনযাপন এবং সামাজিক চাহিদাগুলোর ন্যূনতম পরিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ এবং এজন্য আনুষঙ্গিক সেবা ও উপকরণ সহায়তার ব্যবস্থা করলেই হবে না, এ সুযোগগুলো গ্রহণের ব্যাপারে তারা যাতে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্য সামাজিক সুবিধারও সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। অন্যদিকে তাদের মানসিকভাবেও এই মর্মে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যে, শহরের মানবেতর জীবনযাপনকে মেনে নিয়ে অর্ধপঙ্গু মানুষের মতো সেখানে পড়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই। এর চেয়ে স্বাধীন-স্বনির্ভর জীবিকা নিয়ে গ্রামে বসবাস করাটা অনেক বেশি সম্মানের।
এবার সম্ভাব্য কর্মসূচি ও কর্মকৌশল সংক্রান্ত আলোচনায় আসা যাক। প্রথমেই সম্ভাব্য কর্মসূচির কথা বলি। সরাসরি প্রস্তাব হচ্ছে, কৃষির পরিপূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ ঘটাতে হবে। প্রথাগত ধাঁচের কৃষিকাজ ফেলে যে গ্রামীণ তরুণ যন্ত্রে কাজ করার জন্য শহরের কারখানায় বা অফিসে যুক্ত হতে চায়, সে যদি গ্রামেই ট্রাক্টরে চাষাবাদ, অ্যারেটর দিয়ে মাছ চাষ কিংবা ইনকিউবেটর চালিয়ে হাঁস-মুরগির খামার পরিচালনার সুযোগ পায়, তাহলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, এ ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষিত তরুণও হয়তো গ্রামে থেকে যাওয়ার উৎসাহ খুঁজে পাবে। দ্বিতীয়ত, এ তরুণরা শহর বা উপশহরে বসবাস করলে তারা সেখানে বসে যেসব শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ বা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে চাইত, সে কাজগুলো তারা যাতে গ্রামে বসেই করতে পারে, তজ্জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আর সে সুযোগ তৈরির জন্য যে কাজগুলো সর্বাগ্রে করা প্রয়োজন, তার মধ্যে রয়েছে- এক. চাহিদানুযায়ী ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ; দুই. পণ্য ও জনযোগাযোগের জন্য নির্ভরশীল সড়ক ও নৌপরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা নিকটবর্তী মহাসড়ক, রেলপথ ও নৌবন্দরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে; তিন. হয়রানি ও জটিল প্রক্রিয়ামুক্ত স্বল্পসুদভিত্তিক ঋণের ব্যবস্থা করা (কৃষিঋণ না হয়ে এটি হতে হবে পল্লিঋণ, যার সরল সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ); চার. কৃষি ও শিল্প উভয় খাতের জন্য যুক্তিসঙ্গত মূল্যে চাহিদামাফিক উপকরণ ও কাঁচামালের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা; পাঁচ. কৃষিজাত পণ্যের মজুদ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। আর উপরে যে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেটিকে নিছক নৌকা, লঞ্চ, বার্জ ইত্যাদিভিত্তিক প্রচলিত ধাঁচের পরিবহণ ব্যবস্থা না ভেবে ইতালি বা নেদারল্যান্ডসের মতো মূলধারার পরিবহণ ব্যবস্থা হিসাবে ভাবতে হবে।
অন্যদিকে আধুনিক জীবনযাপন ও সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান শিক্ষায়তনগুলোর মানোন্নয়ন ও মানসম্মত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ সরবরাহ করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। মোট কথা, গ্রামকে সব দিক থেকেই এমন একটি আদল দিতে হবে যে, সেখানে আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে বসবাসের একটি আকর্ষণীয় পরিবেশও। পাশাপাশি এরূপ ধারণাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে- আয়ের ব্যবস্থা যদি থাকে, তাহলে শহরের কোলাহলময় পরিবেশের চেয়ে গ্রামের স্নিগ্ধতাই অধিক কাম্য। তবে এসব প্রস্তাবকে শুধু ধারণাগত কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না, এর জন্য একটি সামগ্রিক সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে (বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ডের সীমিত আঙ্গিকের চলমান কর্মসূচিকে বোঝানো হচ্ছে না)। আর উপরে অবকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য যেসব করণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোকে এ সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় এনে একটি অভিন্ন প্যাকেজ আকারে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এর সবই করতে হবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে নয়, আমলাদের মাধ্যমে তো নয়ই। এখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না। তবে তাদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটিই শর্ত- তাদের অবশ্যই একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। বস্তুত, উল্লিখিত কাজগুলো পরিপূর্ণভাবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে করা হলেই কেবল তা সর্বোত্তম কাক্সিক্ষত ফলাফল নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
এ বিষয়ে কেউ যদি সাম্প্রতিক সময়ে করোনাসংশ্লিষ্ট অনুদানের অর্থ বা ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্নীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলতে চান, এ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ঝুঁকি অনেক বেশি; তাহলে এর জবাবে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সে ঝুঁকির মাত্রা আরও অনেক বেশি। অতএব গভীর দূরদৃষ্টি নিয়ে ভাবলে মানতেই হবে, শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষদের গ্রামে ধরে রাখতে চাইলে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারই শেষ পর্যন্ত মূল ভরসা। তবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত করে তোলা যায়, সে ব্যাপারেও সক্রিয়ভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই বারবার বলা হচ্ছে যে, কোভিডে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও লকডাউন বাস্তবায়নে কিংবা দরিদ্র মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় সরকারকে আরও বেশি কাজে লাগানো উচিত। সেই একই ধারণাকে সম্প্রসারিত করেই বলা যায়, উপরে প্রস্তাবিত সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট হলে স্থানীয় সরকারের হাতে তা না ছাড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। ধারণাগতভাবে আমরা যতই বলি না কেন, সমন্বিত পল্লি উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়াধীনে বাস্তবায়িত হবে, কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের সহযোগিতা ছাড়া বাস্তবে তা কখনোই সম্ভব নয়। তবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে উদ্যোগী হলে আমলাতন্ত্র যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের পক্ষে সে বিকেন্দ্রীকরণ ঠেকিয়ে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে তাই বলব, করোনার নানা ক্ষতি সত্ত্বেও পরিবেশসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে তা যে উপকার বয়ে এনেছে তার একটি হলো, এর কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছে। এখন এই গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষদের যদি গ্রামেই কাজ ও আনুষঙ্গিক সুবিধা দিয়ে আটকে রাখা যায়, তাহলে এর চেয়ে বড় উপকার আর কিছুই হতে পারে না। আর এর সুবাদে দেশের অর্থনীতিসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু অতিমাত্রায় শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ার যে প্রবণতা ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে, তা থেকেও কিছুটা রেহাই মিলবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ; সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
atkhan56@gmail.com