আশেপাশে চারপাশে
শিক্ষা সুযোগ নয়, মৌলিক অধিকার
চপল বাশার
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
৫৯ বছর আগের কথা। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন ঢাকায় হরতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রাজপথে, সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ঢাকা নগরী। একপর্যায়ে পুলিশের বাধা, লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ। গুলিতে নিহত হলো স্কুলছাত্র বাবুল, পথচারী মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লা। আহত শতাধিক।
সেদিনের আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। আইয়ুব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দখল করেন ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে। জারি হয় সামরিক শাসন। এর পরের বছর ১৯৫৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এসএম শরিফের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনের দায়িত্ব ছিল একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে এবং সে বছর থেকেই এটি বাস্তবায়িত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। কমিশনের সুপারিশ দেখে দেশের শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ হতবাক হয়ে যান। সব দেশেরই শিক্ষানীতি থাকে।
এর লক্ষ্য থাকে শিক্ষার বিস্তার ও সম্প্রসারণ। কিন্তু শরিফ কমিশন যে শিক্ষানীতি তৈরি করেছিল তা শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য নয়, সেটার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার অধিকার সংকোচন করা। সবার জন্য শিক্ষা নয়, সমাজের সচ্ছল ও উচ্চবিত্তরাই শুধু লেখাপড়া করবে, অন্যরা নয়। এটাই ছিল শরিফ কমিশন রিপোর্টের মূল কথা।
রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র পাকিস্তানেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। বেশি প্রতিক্রিয়া হয় বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিরা সবসময়ই পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি সচেতন। অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বাঙালি সব সময়ই রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ করেছে।
সচেতন বাঙালি জাতির কাছে শরিফ কমিশনের গণবিরোধী শিক্ষানীতি গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন, এই শিক্ষানীতি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে শিক্ষার অধিকার শুধু সংকুচিতই হবে না, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাবে।
শরিফ কমিশনের রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা একটি অবাস্তব কল্পনা মাত্র। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধনিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষা করত; শরিফ কমিশন তাই ধনিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য বলেছে, বিনামূল্যে কোনো শিক্ষা নয়। কমিশন শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের কথাও বলে জোর দিয়ে।
উচ্চশিক্ষার প্রসার রোধ করার জন্য যা যা করার দরকার, তার সবই সুপারিশ করে শরিফ কমিশন। যেমন পরীক্ষায় পাশ নম্বর হবে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। প্রথম বিভাগ পেতে ৭০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। এইচএসসি ক্লাসে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হতে বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হবে বলে সুপারিশ করা হয়। এর আগে সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষের অধীনেই এ পরীক্ষা হতো।
ডিগ্রি পাশ কোর্সের মেয়াদ দুই বছর দীর্ঘকাল থেকেই বহাল ছিল। শরিফ কমিশন এ মেয়াদ বাড়িয়ে তিন বছর করে দেয়। মেয়াদ এভাবে বাড়িয়ে উচ্চশিক্ষাকে নিরুৎসাহিত ও ব্যয়বহুল করা হয়। শরিফ কমিশন ইংরেজি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এটা করতে গিয়ে এইচএসসি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ওপর অনর্থক বইয়ের বোঝা বাড়ানো হয়। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ইংরেজিতে সাতটি বই বাধ্যতামূলক করা হয়। আগে এত বই পড়তে হতো না।
রিপোর্ট ও সুপারিশ দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, বিশেষ করে কলেজ ছাত্রদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিটি কলেজের এইচএসসি ও ডিগ্রি ক্লাসের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন এবং শরিফ কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেন। আন্দোলন শুরু হলো ঢাকা শহর থেকেই। অগ্রভাগে ছিল জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজ। অন্যান্য কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও আন্দোলনে যোগ দিলেন। একপর্যায়ে ক্লাস বর্জন শুরু হলো, মিছিল শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজপথে নামল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনকে সমর্থন করলেন। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনের নেতারা এবং কলেজ ছাত্র প্রতিনিধিদের যৌথ সভায় আন্দোলনের কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়। কর্মসূচিতে ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও হরতাল।
হরতালের আহ্বানে জনগণের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে পথে নামে। বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে যোগ দেয়। বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী মানুষ, এমনকি সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গার নৌকার মাঝিরাও বৈঠা হাতে সমাবেশে যোগ দেয়।
সেখান থেকে ছাত্র-জনতার এক বিরাট মিছিল বেলা ১১টার পরে স্লোগান দিতে দিতে নবাবপুর রোডের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলটি জজকোর্টের সামনে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ বাধা দেয়, লাঠিচার্জ শুরু করে, তারপর কাঁদুনে গ্যাস। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। সে সময় রাবার বুলেট ছিল না, প্রতিটি গুলিই প্রাণঘাতী বুলেট। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, কিন্তু আহত হয় অনেক মানুষ।
গুরুতর আহতদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায় ছাত্ররা। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে আরেকটি সমাবেশ চলছিল। নবাবপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর পেয়ে সেখান থেকেও ছাত্ররা মিছিল বের করে। মিছিলটি আবদুল গনি রোডে প্রবেশ করার পর পুলিশ সেখানেও গুলি চালায়। গুলিতে স্কুলছাত্র বাবুল এবং আরও দুজন নিহত হয়। আহত হয় অনেক। নবাবপুর রোড ও আবদুল গনি রোডে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা তিন বলা হয়। কিন্তু সেদিন দুই দফা গুলিবর্ষণের কারণে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে অনেকের ধারণা।
পুলিশের গুলি ও মানুষ হত্যার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য স্থানে। ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা একপর্যায়ে প্রাদেশিক মন্ত্রী খাজা হাসান আসকারির গাড়িতে আগুন দেয়। সেদিনের পুলিশি নির্যাতন ও গুলিবর্ষণ ছাত্র আন্দোলন থামাতে পারেনি। আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরও কয়েকটি জেলা শহরে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
আন্দোলন যখন তীব্র, ছাত্র অসন্তোষ অব্যাহত, সে সময় বিরোধীদলীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সঙ্গে দেখা করেন এবং শরিফ কমিশন প্রণীত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল করতে বলেন। সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে, তবে বাতিল করেনি। এরপর ছাত্র আন্দোলন সাময়িকভাবে থেমে যায়। ছাত্রছাত্রীরাও ক্লাসে ফিরে যান।
১৯৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের ছাত্র-গণবিক্ষোভ দেশে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের একটি মাইলফলক। সেদিন থেকেই এদেশে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সূচনা হয়, যা চলেছিল পুরো ষাটের দশকজুড়ে। প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে সে সময় থেকে।
ছাত্রসমাজ ও সচেতন জনগণ শরিফ কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সবার জন্য শিক্ষা-এটাই ছিল দাবি। বর্তমান সরকারও ‘সবার জন্য শিক্ষা’-এই নীতিতে বিশ্বাসী। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কোনো সুযোগ দেওয়ার বিষয় নয়, শিক্ষা মৌলিক অধিকার। শিক্ষার্থীদের এ অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব অভিভাবক, সমাজ, সরকারের নীতিনির্ধারক ও রাষ্ট্রের।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com