সাফল্যের পথে ডিজিটাল ভূমিসেবা
ডা. কাজী নাজিব হাসান
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘ভূমিসেবা ডিজিটাল, বদলে যাচ্ছে দিনকাল’-ভূমি মন্ত্রণালয়ের এ স্লোগান সামনে রেখে সারা দেশে সব ভূমি অফিসে ডিজিটাল ভূমিসেবা প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে ভূমি মন্ত্রণালয় তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমিসেবা প্রদানের জন্য ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প’ চালু করেছে।
এ সেবাগুলোর মধ্যে আছে ই-নামজারি, অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর রেজিস্ট্রেশন ও অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান, অনলাইনে মামলার শুনানি, অনলাইনে খারিজ খতিয়ানের ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণ ইত্যাদি।
এর মধ্যে অন্যতম হলো অনলাইনে মামলার শুনানি গ্রহণ। এ পদ্ধতিতে একজন নাগরিক বাড়িতে বসে অথবা পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে তার মিস কেস বা অন্যান্য কেসের জন্য www.land.gov.bd-এই ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনে শুনানির আবেদন করতে পারেন। ফলে শুনানির নির্ধারিত দিনে নাগরিককে ভূমি অফিসে আসতে হয় না। আবেদনকারী নিজ বাড়িতে বসে অথবা যে কোনো ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে বসে অথবা তার কর্মস্থলে বসে অনলাইনে শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি তার আবেদনে তার আদেশের কপি পাওয়ার জন্য ইমেইল ঠিকানা প্রদান করেন, তাহলে তাদের আদেশের কপি ইমেইলেও প্রদান করা হচ্ছে। অনলাইনে শুনানি গ্রহণের ফলে মিস কেসগুলোর দ্রুত সমাধান হবে। এ জন্য মাননীয় ভূমিমন্ত্রী ও ভূমি সচিবের অবদান অনস্বীকার্য।
আগের সময়ের চেয়ে বর্তমান সময়ে ভূমিসেবা আরও সহজ হচ্ছে। ভূমিবিষয়ক আগের জটিলতাগুলোকে মানুষের জন্য সহজ করতে ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা প্রদান শুরু করেছে। এ ছাড়াও বেশকিছু আইন-কানুন-বিধি সংশোধিত হয়েছে ও হচ্ছে। ইতোমধ্যে মিস কেসের মাধ্যমে খতিয়ানের করণিক ভুল সংশোধনের বিষয়ে গত ২৯ জুলাই একটি পরিপত্র জারি হয়েছে। ফলে সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে রেকর্ডের ভুল সংশোধন করতে পারছেন। এতে করে দেওয়ানি আদালতে ভূমিসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কমবে। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক কোনো ব্যক্তির ডাকনাম ‘সোনা মিয়া’, জরিপের সময় ওই নামেই তার খতিয়ান তৈরি হয়েছে, এতদিন তিনি বিষয়টি তেমন আমলে নেননি। হঠাৎ করে তার জমি বিক্রি করার প্রয়োজন হলো।
কিন্তু তার জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম আছে ‘আরিফুল ইসলাম’। জমি বিক্রির জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে তার জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। কিন্তু খতিয়ানের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের মিল নেই। এ ধরনের অবস্থায় কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই খতিয়ান সংশোধন করার এখতিয়ার সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) ছিল না। ওই ভুল সংশোধন করতে বছরের পর বছর সময় লাগত। এ পরিপত্রের ফলে ২৯ জুলাই ২০২১-এর পর থেকে এ ধরনের ভুলসহ খতিয়ানের আরও অনেক ধরনের ভুল সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) উপজেলা ভূমি অফিসে মিস কেসের মাধ্যমে সংশোধন করতে পারছেন। জনসাধারণ যাতে দ্রুত সময়ে এ সেবাটি পান, সে জন্য ওই পরিপত্রে এ ধরনের ভুল সংশোধনের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের আরও একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে অনলাইনে জমির খাজনা প্রদান। বর্তমানে দেশের সব প্রান্তে অনলাইনে খাজনা প্রদানের জন্য রেজিস্ট্রেশন চলছে। এ সিস্টেমে একজন জমির মালিক পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে তার জমির খাজনা প্রদান করতে পারবেন এবং অনলাইনে দাখিলা পাবেন। এ পদ্ধতিতে প্রথমে একজন জমির মালিককে www.ldtax.gov.bd-এই ওয়েবসাইটে গিয়ে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, মোবাইল নম্বর ও জমির খতিয়ানের তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এ ছাড়া ‘ভূমি উন্নয়ন কর’ নামক অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের মাধ্যমেও একজন নাগরিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। ভূমি উন্নয়ন করের অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের জন্য দেশের সব ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও ইউডিসিতে নাগরিকদের বিনামূল্যে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে খাজনা প্রদান পদ্ধতিটিও খুব সহজ।
নিবন্ধিত মোবাইল নম্বরে প্রতি বছর তার জমির খাজনা কত টাকা, তা একটি এসএমএসের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে এবং যদি ইমেইল ঠিকানা দেওয়া থাকে, তাহলে ইমেইলও যাবে। এরপর ওই ব্যক্তি মোবাইল অ্যাপ বা কম্পিউটারে www.ldtax.gov.bd সাইটে গিয়ে তার জমির জন্য অনলাইনে খাজনা পরিশোধ করতে পারবেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে তার খাজনা পরিশোধ করা যাবে। ফলে প্রবাসীরাও তাদের জমির খাজনা বিদেশে বসে প্রদান করতে পারবেন। খাজনা পরিশোধ হলে তার মোবাইলে এসএমএস আসবে ও ইমেইল আসবে এবং তিনি ‘কিউ আর’ কোড যুক্ত একটি দাখিলা পাবেন, যাতে কোনো স্বাক্ষরের প্রয়োজন নেই। পরীক্ষামূলকভাবে বেশকিছু উপজেলায় এর আগে পাইলটিং প্রকল্পে এ ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া গেছে এবং মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে একযোগে অনলাইনে খাজনা প্রদান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকভাবে শুভ উদ্বোধন করবেন।
ভূমি মন্ত্রণালয় ও উপজেলা ভূমি অফিসগুলো এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বর্তমান ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান যখন যশোরের জেলা প্রশাসক ছিলেন, তখন তার একান্ত প্রচেষ্টায় অফিসের কার্যক্রমগুলোতে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় এবং পরে যশোর বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা হিসাবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়। তারই হাতে বর্তমানে ভূমি প্রশাসন পুরোপুরি ডিজিটাল হতে চলেছে।
অনলাইনে খাজনা প্রদান পদ্ধতি চালু হলে দেশের ভূমি প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। মানুষকে আর জমির খাজনা দিতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যেতে হবে না। এতে করে মানুষের সময় সাশ্রয় হবে এবং যাতায়াত খরচ কমবে। দীর্ঘদিন ধরে ভূমি ব্যবস্থাপনায় যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার সমাধান হয়তো অল্পদিনে সম্ভব নয়, কিন্তু সর্বত্র ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারের ফলে এসব সমস্যা ধীরে ধীরে সমাধান হবে ও কাজে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের আরও কিছু উদ্যোগ চালু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- Land
Administration Management Software(LAMS), Land Information Management Software(LIMS), ভূমিসেবা অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস ইত্যাদি।
বর্তমানে নাগরিকরা অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ফি প্রদান করে তাদের জমির খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি পাচ্ছেন। নাগরিকদের ভূমিসেবা সহজীকরণ ও আরও দক্ষতার সঙ্গে ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য আমার নতুন কিছু পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-খাস জমি ও সরকারি নদী-খাল-বিলে অবৈধ দখল রুখতে এবং দক্ষতার সঙ্গে নজরদারির জন্য ‘ড্রোন’ ব্যবহার, হাট-বাজারের দোকান ইজারা গ্রহীতাদের বাৎসরিক ইজারা অনলাইনে নবায়ন ও অনলাইনে লিজ মানি গ্রহণ, নাগরিকদের ভূমি আইন ও কিভাবে সহজে অনলাইনে ভূমিসেবা পাওয়া যায় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধি। ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ প্রণয়ন ও সেই ম্যাপে খাস জমি, অর্পিত সম্পত্তি আলাদাভাবে ও রং প্রদর্শন, গুগল ম্যাপের সঙ্গে বর্তমান মৌজা ম্যাপের সমন্বয় ঘটানো এবং এ সংক্রান্ত অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস তৈরি।
মাঠ পর্যায়ে ভূমি প্রশাসনে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ কিছুটা চ্যালেঞ্জিং, কারণ এখনো মানুষের মাঝে ভূমিবিষয়ক পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি হয়নি। তবে ভূমি মন্ত্রণালয় ও উপজেলা ভূমি অফিসগুলো ইতোমধ্যে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেছে। একবার ভূমিবিষয়ক সব রেজিস্টার অনলাইনে বা ডিজিটাল মাধ্যমে আনা গেলে একটা নির্ভুল ডাটাবেজ তৈরি হবে। কাজেই সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন দেশের শতভাগ মানুষ ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের সুফল ভোগ করবে। একজন মানুষও যেন ভূমিবিষয়ক কোনো জটিলতার সম্মুখীন না হন।
২০২১ সালটি আমাদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ সময় একইসঙ্গে আমরা উদযাপন করছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাব দেশের ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে। আমরা বর্তমান প্রজন্মের তরুণ সরকারি কর্মচারীরা আমাদের কাজ ও উদ্ভাবনী চেষ্টার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে করতে চাই।
ডা. কাজী নাজিব হাসান : সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, ঝিকরগাছা, যশোর