Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভোক্তার আচরণ ও পণ্যমূল্য

Icon

এম এ খালেক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভোক্তার আচরণ ও পণ্যমূল্য

প্রতীকী ছবি

উৎপাদনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বাজারে পণ্য ও সেবার জোগান বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোক্তার চাহিদা পূরণ ও সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জনের দ্বারা মুনাফা অর্জনের পথ প্রশস্ত করা। এ জন্য তারা নানা ধরনের কৌশল অনুসরণ করেন। বাজারে পণ্য ও সেবার জোগান বাড়ানোর দুটি পদ্ধতি আছে। প্রথমত, আমদানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পণ্যের জোগান নিশ্চিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, স্থানীয়ভাবে পণ্যটি উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারে জোগান বৃদ্ধি করে ভোক্তা চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা।

আমদানিকৃত পণ্য ভোক্তার রুচি এবং পছন্দের সঙ্গে সমন্বয় বিধানে অধিকতর সক্ষম। কারণ আমদানিকৃত কোনো পণ্য গুণগত মান বা অন্য কোনো কারণে ভোক্তার চাহিদা পূরণে সমর্থ না হলে বিকল্প সূত্র থেকে অধিকতর উপযোগিতা সৃষ্টিকারী পণ্য আমদানি করা সম্ভব। কিন্তু স্থানীয়ভাবে যে পণ্য উৎপাদন করা হয়, তা ভোক্তা চাহিদা পূরণে সমর্থ না হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প পণ্য উৎপাদন ও জোগান দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু আমদানিকৃত অধিকতর ভোক্তা চাহিদা পূরণে সক্ষম হলেও এর একটি অসুবিধা হচ্ছে, এতে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদের রূপান্তর ও ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করা হলে তা দ্বারা চাহিদা মেটানো যায়; কিন্তু এভাবে ভোক্তার রুচি এবং পছন্দের সঙ্গে সব সময় তাল মেলানো সম্ভব নাও হতে পারে।

জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক দেশগুলো ভোক্তা রুচির সঙ্গে কিছুটা আপস করে হলেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমেই চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। ভোক্তার একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, তারা তুলনামূলক কম অর্থ ব্যয় করে অধিকতর গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য ক্রয় করতে চায়। কম খরচে অধিক গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য পেতে তারা যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতেও দ্বিধা করে না। ভোক্তার এহেন আচরণ লক্ষ্য করেই উৎপাদকরাও চেষ্টা করে কীভাবে তুলনামূলক কম খরচে উন্নতমানের পণ্য জোগান দেওয়া যায়।

ভোক্তা চরিত্রের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সবসময়ই ‘কনসেশন রেটে’ পণ্য পেতে চায়; কিন্তু পণ্যের গুণগত মানের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করতে চায় না। তাই দেখা যায়, কোনো একটি ভালো ব্র্যান্ডের পণ্যে মূল্যছাড় দেওয়া হলে অনেকেই সেই পণ্যটি ক্রয় করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এমন কী যার পণ্যটি ক্রয়ের তেমন বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই, তিনিও মূল্যছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করার জন্য পণ্যটি ক্রয় করতে চেষ্টা করেন। কোনো পণ্যের মূল্যের ওপর ছাড় দেওয়া হলে এক শ্রেণির ভোক্তা মনে করেন, কোম্পানি তাদের প্রতি কতই না সহানুভূতিসম্পন্ন। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রেখেই কোম্পানি মূল্যছাড় দিয়েছে। কিন্তু এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, কোম্পানি সাধারণত তার নিজস্ব মুনাফার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেয়। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার প্রতি তার তেমন কোনো দৃষ্টি থাকে না।

কোম্পানি কখনোই ভোক্তার স্বার্থ চিন্তা করে তার উৎপাদিত পণ্য লোকসানে বিক্রি করবে না। যখনই কোনো কোম্পানি তার পণ্যের ওপর মূল্যছাড় দেয়, তখনই বুঝতে হবে-এখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু কারণ কাজ করেছে, যাতে কোম্পানি মূল্যছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছে। সাধারণভাবে কোনো পণ্যের ওপর মূল্যছাড় দিতে হলে কোম্পানি আগেই সেই পণ্যের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করে রাখে, যাতে মূল্যছাড় দিলেও তার কোনো লোকসান না হয়। যেমন, যে পণ্যের প্রকৃত মূল্য ১০ টাকা, সেই পণ্যের দৃশ্যমান মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে যদি ২ টাকা ছাড়া দেওয়া হয় তাহলে কোম্পানির কোনো লোকসান হবে না। কিন্তু পণ্যটি আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক ভোক্তা আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। সাধারণত ব্র্যান্ডের রিজেক্টেড পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যছাড় দেওয়া হয়।

এখানে একটি বিষয় সবসময়ই ভোক্তাকে মনে রাখতে হবে-তার কথা বা স্বার্থ বিবেচনা করে কোম্পানি কখনোই লোকসান দেবে না। কোনো পণ্য ফ্রি হোম ডেলিভারি দিলে আমরা শুনে খুশি হই। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না, কোম্পানি পণ্যমূল্য নির্ধারণের সময় হোম ডেলিভারি চার্জ অন্তর্ভুক্ত করেই তা নির্ধারণ করে। আর ভোক্তা যদি কমে যায় বা প্রচণ্ড আগ্রহ প্রদর্শন না করে, তাহলে কোম্পানি তার পণ্যের মূল্য কমাতে বাধ্য থাকবে।

এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমি ২০১৮ সালে পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য সৌদি আরব গিয়েছিলাম। সেখানে একটি বিষয় অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি। কাবা শরিফের আশপাশের সুপার শপগুলোতে নির্ধারিত মূল্যে জোব্বা বিক্রি হচ্ছে। উন্নতমানের প্রতিটি জোব্বা ৭০ থেকে ৮০ রিয়েল মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেকেই জোব্বা ক্রয় করেন। হজ শেষে মুসল্লিরা মদিনা গমন করতে থাকেন। এ সময় মক্কায় মানুষের উপস্থিতি অনেকটাই কমে যায়। এক পর্যায়ে প্রতিটি জোব্বার মূল্য কমিয়ে ৪০-৪৫ রিয়েল নির্ধারণ করা হয়। পুনঃনির্ধারিত মূল্যে জোব্বা বিক্রি করলেও বিক্রেতার নিশ্চয় লোকসান হয়নি।

পণ্যের মূল্য হ্রাস করার ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। পণ্যটি যদি স্থানীয়ভাবে এবং নিজস্ব কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়, তাহলে সেখানে মূল্যছাড় দেওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। আর স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্য হলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে অধিকতর মূল্য সংযোজন করে। তাই প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কীভাবে স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্য উৎপাদন করা যায়। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তৈরি পোশাক। কিন্তু এ শিল্পটি আমদানিকৃত কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজনির্ভর। ফলে এ শিল্পটি জাতীয় অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম মূল্য সংযোজন করছে। তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে এর রপ্তানি আয়ের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বিদেশে চলে যায়। অন্যদিকে চা শিল্প থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। কারণ, চায়ের কোনো কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতানুগতিক চিন্তা বা ধারণা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আগে মনে করা হতো, একমাত্র কৃষির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমেই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর বিশ্বের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই এটা একবাক্যে স্বীকার করে নেন যে, কৃষি নয়; একমাত্র শিল্পের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বদানের মাধ্যমেই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও সুষমকরণ করা সম্ভব। এ ছাড়া শিল্পায়ন ব্যতীত বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর উপযুক্ত কর্মসংস্থান ব্যতীত দারিদ্র্য বিমোচন করা যাবে না।

কৃষি উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে (অর্থাৎ ১,২ ৩,৪ এভাবে ক্রমান্বয়ে)। আর শিল্প উৎপাদন বাড়ে জ্যামিতিক হারে (অর্থাৎ ১,২ ৪,৮ এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে)। শিল্প উৎপাদন ইচ্ছা করলেই বাড়ানো যায়। এক শিফটের স্থলে দুই শিফট অথবা তিন শিফট চালু করলেই শিল্প উৎপাদন বাড়ানো যায়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে চাইলেই কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ বা তিনগুণ বাড়ানো যায় না। জনসংখ্যা এবং শিল্প উৎপাাদন বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। একটি দেশ শিল্পে সমৃদ্ধ হলে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদা আমদানির মাধ্যমেও পূরণ করা সম্ভব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ’৭৫-পরবর্তী সময় থেকে শিল্পের ওপর অত্যধিক জোর দেওয়া হয়। উপমহাদেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় ইংরেজদের হাত ধরে। কিন্তু অবিভক্ত ভারতে যে শিল্পায়ন হয়, তার বেশিরভাগই হয় বর্তমান ভারতে। ভারতের মোম্বাই, জমশেদপুর ইত্যাদি এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়ন হয়। কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানে।

বর্তমান বাংলাদেশে তেমন কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান এবং ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে অধিকাংশ শিল্পই ভারতের অংশে পড়ে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিল্পের সঙ্গে নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে ভারত অতি দ্রুত শিল্পায়িত হতে থাকে। অখণ্ড পাকিস্তানে যে শিল্পায়ন হয়, তার বেশিরভাগই হয় বর্তমান পাকিস্তানে। বাংলাদেশে তেমন কোনো শিল্প স্থাপিত হয়নি। যে সামান্য কিছু শিল্প ১৯৭১-পূর্ব বাংলাদেশে স্থাপিত হয়েছে, তার বেশিরভাগের মালিকানা ছিল অবাঙালিদের হাতে।

১৯৪৭ সালের পর ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশই শিল্পায়নের ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু দুটি দেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল। ভারত বেসিক শিল্পের ওপর জোর দেয়। আর পাকিস্তান সংযোজন শিল্প নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। সংযোজন শিল্পের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এতে আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা জাপান বা জার্মান থেকে উন্নতমানের যন্ত্রাংশ এনে স্থানীয়ভাবে তা সংযোজন করতেন। এতে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত হয়। কিন্তু ভারত বেসিক শিল্পে জোর দেয়। তারা নিজেরাই স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে শিল্প পণ্য উৎপাদন শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের পণ্যের গুণগত মান ছিল খুবই নিম্ন পর্যায়ের। কিন্তু এখন তারা এ ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি করেছে।

পাকিস্তানের পশ্চাদ্ভূমি হিসাবে বাংলাদেশে তেমন কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। তবে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো শিল্পের স্বরূপ নির্ধারণে সফল হইনি। আমরা এখনো আমদানিকৃত কাঁচামালনির্ভর শিল্পের উপরই নির্ভর করে আছি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশের শিল্প হওয়া উচিত কৃষিভিত্তিক কাঁচামালনির্ভর। আমরা যদি কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে কৃষি ব্যবস্থা আরও উন্নত হতো। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পেত। গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো।

আমাদের মতো দেশে বৃহৎ শিল্পে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে গড়ে তোলা যেতে পারে। অর্থাৎ বৃহৎ শিল্পের উপকরণ আসতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প থেকে। বস্তুত দেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়াকে পরিকল্পিত উপায়ে ঢেলে সাজাতে হবে। এমনভাবে শিল্পায়ন করতে হবে, যাতে শিল্পের কাঁচামাল কৃষি থেকে আসতে পারে।

এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম