Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও জোরালো তৎপরতা চাই

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও জোরালো তৎপরতা চাই

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল আসা শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। সেসময় মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নিধন নীতির পরিপ্রেক্ষিতে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তা থেকে প্রাণে বাঁচতেই তারা দলে দলে এ দেশে আশ্রয় নেয় এবং বাংলাদেশ মানবিক কারণেই তাদের আশ্রয় দেয়। তবে আশা ছিল, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রুতই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করা যাবে। দুঃখের বিষয়, গত চার বছরের যে অভিজ্ঞতা তাতে বলা যায়, পরিস্থিতি প্রত্যাবাসন নয়, বরং এদেশে স্থায়ীকরণের দিকেই যাচ্ছে।

বর্তমান সময়ে বিশ্বে মোট শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ। মোট শরণার্থীর ৮৫ শতাংশই আশ্রয় নিয়েছে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর দুই-তৃতীয়াংশের বেশির মাতৃভূমি মাত্র পাঁচটি দেশ-সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও মিয়ানমার। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে। এর সংখ্যা ৪০ হাজার বলা হলেও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত সংখ্যা ১৬ হাজার ৫০০। আর প্রতিবেশী দেশ হিসাবে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রায় পুরো অংশটাই আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোয় প্রতিবছর ৩০ হাজারেও বেশি শিশু জন্ম নিয়ে মোট সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে আমাদের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা কতটা প্রকট হতে পারে।

এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। অন্যদিকে আর্থিকভাবেও আমরা ততটা শক্তিশালী নই। তারপরও রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই। কেননা সেসময়ে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী যে গণহত্যা শুরু করে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা কোনো সভ্য জাতির পক্ষে সম্ভব নয়, আমরা তা পারিওনি, করিওনি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ছিল খুব দ্রুতই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই লক্ষ্যে আশ্রয় দেওয়ার মাত্র দুই মাস পর, অর্থাৎ ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তি স্বাক্ষর করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। তবে সেই স্বাক্ষরের পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত একজনকেও নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি। তারপরও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। এক বছরের মাথায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বন্ধুদেশ হিসাবে চীনের সহায়তা নেয়। সেই হিসাবে তিনটি দেশের প্রতিনিধিরা কয়েক দফা বৈঠকও করেন। এর মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে ঘটে গেছে সামরিক অভ্যুত্থান। যে সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তিনিই এখন সরকারপ্রধান। স্বভাবতই আশার প্রদীপ নিভু নিভু করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। এককভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় চীন যুক্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে চীনবিরোধী শিবির এই প্রক্রিয়া থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে বলে মনে হয়।

এতটা বিরূপ পরিস্থিতিতেও গত চার বছরে বাংলাদেশ একাধিকবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ দফায় বাংলাদেশ ৮ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা জমা দিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে যাচাই-বাছাই শেষে মাত্র ৪২ হাজার রোহিঙ্গার নাম অনুমোদন করেছে মিয়ানমার সরকার। তবে সে পর্যন্তই, কাজটি আর এগোতে পারেনি। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরে নেওয়া প্রথম উদ্যোগটিও ব্যর্থ হয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় সর্বশেষ উদ্যোগটি নেওয়া হয় ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট। চীনা কর্মকর্তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় গিয়ে প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত কাজটিও সম্পন্ন করেন। তারপরও শেষ পর্যন্ত তা সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। কারণটা রোহিঙ্গারা নিজেই। তারা বলেছে, আরাকান রাজ্যে ফিরে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত হয়নি; নিশ্চিত করা যায়নি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনযাপনের ব্যবস্থা। এ অজুহাতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে অসম্মতি জানায়। তারা মোটা দাগে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে পাঁচটি দাবি উপস্থাপন করে। দাবিগুলো হলো : মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া, রাখাইনে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়া, ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং নির্যাতনকারীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার। যেহেতু এই দাবি পূরণ বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া আর হয়নি।

এরপরই শুরু হয় করোনা অতিমারি। করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব একটি স্থবির পরিস্থিতির সম্মুখীন, মৃত্যুবাণে জর্জরিত মানবজাতি। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু অনেকটা আড়ালেই থেকে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থান ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে; বিশ্বের দৃষ্টি এখন সেদিকে। তাই রোহিঙ্গা ইস্যু এখন আড়াল থেকে দূর-আড়ালে চলে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। তাই বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বেগবান করতে হবে। আমাদের এই কঠিন সমস্যাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে হবে। যদিও গত চার বছরে আমাদের কূটনৈতিক সফলতা তেমন কোনো আলোর মুখ দেখাতে পারেনি।

আন্তর্জাাতিক দৃষ্টি এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থেকে ফিরে বোধকরি স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে আত্তীকরণের দিকে নিবদ্ধ। তারা রোহিঙ্গাদের মানবিক দিকটি বিবেচনা করছে, মানবাধিকারের বিষয়টি নয়। শরণার্থীদের জীবনমান নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন; কিন্তু তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা করছে না কিংবা সে বিষয়টিতে আগ্রহী নয়। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক বিশ্বের শরণার্থীদের জন্য ৫৯ কোটি ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে কিছু লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা দেখলে আমাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাবনার প্রতিফলন পাওয়া যাবে। প্রথম লক্ষ্য হলো : শরণার্থী প্রবাহের কারণে হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিপর্যয় কাটাতে স্বাগতিক জনগোষ্ঠী ও শরণার্থীদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ তৈরি করা; দ্বিতীয়ত, শরণার্থী পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশে শরণার্থীদের টেকসই আর্থসামাজিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অথবা তাদের দেশে ফেরানোর মাধ্যমে টেকসই সমাধানকে ত্বরান্বিত করা; তৃতীয়ত, সম্ভাব্য নতুন শরণার্থী প্রবাহ বা নতুন শরণার্থী আসার সম্ভাবনা মোকাবিলায় দেশের প্রস্তুতি জোরদার করা। বিশ্বব্যাংকের এই লক্ষ্যমাত্রাকে আমাদের দেশে দুভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। একদল নিশ্চিতভাবেই বলছে যে, এটা হচ্ছে কেবল শরণার্থীদের স্থায়ীকরণের উদ্যোগ এবং এখানে শুধু শরণার্থীদের স্বার্থই বড় করে দেখা হচ্ছে। অপর দল মনে করছে, এটা ততটা একতরফা নয়। কারণ, শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন হলো একটি প্রত্যাশা, আর রোহিঙ্গারা বর্তমানে বাংলাদেশে বাস করছে এটা হলো বাস্তবতা। তবে বাংলাদেশ যেহেতু রিফিউজি কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি, তাই রোহিঙ্গারা এখানে শরণার্থীর স্বীকৃতি পায়নি। ফলে স্বভাবতই বিশ্বব্যাংকের এসব প্রস্তাব বা লক্ষ্যমাত্রা মেনে নিতে বাংলাদেশ অপারগতা প্রকাশ করেছে।

সবকিছু বিবেচনায় বলা চলে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজটি এখন আর অদূর ভবিষ্যতের মধ্যে পড়ে না। আমরা যাদের মিত্রদেশ বলে ভেবে থাকি সেই চীন ও ভারতকে আমরা এ সমস্যায় কার্যকর ভূমিকায় নামাতে পারিনি। মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্য নিয়ে চীনের বিশাল বিনিয়োগ আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো রেখেছে। তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করা। কিন্তু আমাদের কূটনৈতিক দুর্বলতা সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে পারেনি। তারপরও ভরসার জায়গা এখন একটাই-আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মিয়ানমারের গণহত্যাকে আমলে নিয়েছে। সেখানে যদি অপরাধ প্রমাণিত হয়, তাহলে মিয়ানমার একটি চাপের মধ্যে পড়তে পারে। কিন্তু এর জন্যও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। সে প্রয়োজন মেটাতে হলে আমদের কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। তা করা না গেলে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ উভয়েই এক অনিশ্চিত ভোগান্তিতে পড়বে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম