লিঙ্গ বৈষম্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ

শানজানা ইয়াসীন খান
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী হলেও সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই নারী নেতৃত্ব এখনো অপর্যাপ্ত। গুটিকয়েক বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নারীদের শীর্ষপদে প্রাধান্য দিলেও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে। যদিও অল্পকিছু আমলাতান্ত্রিক পদে নারীরাও কাজ করছেন, এমনকি কিছুসংখ্যক নারী, যারা প্রচলিত গ্লাস সিলিং ভেঙে ব্যবস্থাপনার শীর্ষপদে আসীন হতে পেরেছেন, তারা এই অর্জনের পরও নানা প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।
একটা অভিযোগ প্রায়ই ওঠে যে, নারীদের পুরুষের তুলনায় কম মূল্যায়ন করা হয়। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পুরুষদের সমপরিমাণ ভূমিকা পালন করলেও তারা তাদের সহকর্মীদের কাছ থেকে কম সমর্থন পায় এবং সেই সঙ্গে অধিক যাচাই আর সমালোচনার সম্মুখীন হয়। নেতৃত্বে আসীন নারীদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। হয়তো এ চ্যালেঞ্জগুলো দেওয়া হয় তাদের হারানোর জন্য অথবা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতির দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য-যে পরিস্থিতিকে ‘গ্লাস ক্লিফ’ বলে-যা নারীদের নিজ প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন হওয়ার পথে আরেক ধরনের গ্লাস সিলিং।
কথায় আছে, হাজার মাইলের যাত্রাও শুরু হয় একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে। আমরা শৈশবে যা শিখি তা আমাদের বাকি জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। আমরা যদি পারিবারিক জীবনে মূল্যবোধ ও নীতিবোধ শিখি, সেগুলো আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত জীবনে প্রতিফলিত হয়। অপরদিকে, যদি আমাদের এমন কিছু শেখানো হয়, যা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, তাহলে সেই কুসংস্কারমূলক বিশ্বাসগুলো আমাদের মনে গভীরভাবে গেঁথে যাবে আর আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, লিঙ্গ বৈষম্য এখনো এদেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের আধুনিক সমাজকেও প্রবলভাবে এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমরা এমন একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি, যেখানে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে প্রাধান্য পায়। পরিবারগুলোয় কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তানের চাহিদা বেশি থাকে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলো লিঙ্গসংক্রান্ত অসংখ্য কারণে ছেলেদের পক্ষে থাকে। ছেলেসন্তানকে অধিক মূল্যবান ও নিরাপদ বিনিয়োগযোগ্য মনে করা হয়। স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রেও ছেলেসন্তানকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এই ভেবে যে, একদিন তো মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি বিয়ের ক্ষেত্রেও মেয়েকে স্বামীর ঘরে পাঠানো হবে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ যৌতুকের খরচ দিতে হবে-এমন চিন্তা করা হয়। অপরদিকে, ছেলেরা পরিবারের সম্পদ বাড়ায় আর বয়সকালে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেয়।
তবে এটা সত্য, বাংলাদেশে এ ধারণাগুলো অতিক্রমের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন প্রাথমিক স্তরেও মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা এসেছে। ২০১৯ সালে দেশে ১৫ বা এর বেশি বয়সি মেয়েদের সাক্ষরতার হার ছিল ৭১.৯৫ শতাংশ। ৩০ লাখ নারী লাভজনক তৈরি পোশাক খাতে নিযুক্ত, যা দেশের বৃহত্তম রপ্তানি শিল্প।
যদিও নারীদের চাকরিক্ষেত্রে অংশগ্রহণ এখনো নিম্নস্তরেই সীমাবদ্ধ। অনেক নারীর ক্ষেত্রে নিজ ঘরের দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের কর্মজীবন মাঝপথে থমকে যায়। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কিত পদে নারীর সংখ্যা এখনো বেশ কম।
এ বিষয়টি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকেই ফিরিয়ে আনে, যেখানে সব ক্ষেত্রে পুরুষদের মূল ক্ষমতায় ধরে রাখা হয় আর নারীদের দেখা হয় তাদের পরিচর্যাকারী হিসাবে। এবং এটা মনে করা হয় যে, পরিবারের যত্ন নেওয়ার জন্য কারও প্রয়োজন হলে শুধু নারীই তার ক্যারিয়ার ত্যাগ করতে বাধ্য। এমনকি কর্মক্ষেত্রের পরিবেশও পুরুষতান্ত্রিক, যেখানে ঊর্ধ্বতনরা সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পুরুষ, তারা তাদের অধীনস্থ নারীদের দুর্বল, নির্ভরশীল, সিদ্ধান্তহীন, আবেগপ্রবণ ও আজ্ঞাবহ হিসাবে বিবেচনা করে।
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেখানে মহিলাদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি, অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব নয়। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানে একটি সাধারণ ঘটনা। এ ব্যাপারটা কর্মজীবী নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে এবং চাকরিতে তাদের কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়।
যৌন হয়রানি নিয়ে প্রতিবাদ করা এদেশে নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয় এবং অনেক নারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন না। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের ভয়ে এ ধরনের হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকে, যার ফলস্বরূপ ভুক্তভোগী নারী চুপ করে চাকরিতে অবস্থান করা অথবা চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়াটাকে বেছে নেয়।
২০১৯ সালের জুরে আইএলও’র জেনেভা সদর দপ্তরে সংস্থাটির ১০৮তম সম্মেলনে সহিংসতা ও হ্যারাসমেন্ট কনভেনশন ২০১৯ নামে একটি নতুন সভা হয়েছিল, যেখানে এটি স্বীকৃত হয়েছিল যে কাজের জগতে সহিংসতা ও হয়রানি একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সেই সহিংসতা ও হয়রানি সরকারি ও বেসরকারি সেবার মানকেও প্রভাবিত করে এবং ব্যক্তি, বিশেষ করে নারীদের কর্ম অধিকার এবং শ্রমবাজারে অগ্রসর হতে বাধা দিতে পারে।
সমাজে কাঠামোগত এবং মানুষের মনোভাব পরিবর্তন না হলে নারী নেতৃত্ব সম্ভব হবে না। নারীদের পরিবারের সমর্থন প্রয়োজন, যা কেবল পুরুষদের তাদের নিজ বাড়িতে আরও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সম্ভব। তাদের একটি নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রেরও প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে হয়রানির ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি সংস্থায় উপযুক্ত কমিটি থাকা উচিত, যাতে এ ধরনের অপকর্মের প্রতি জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করা যায়। কর্মজীবী নারীদের আশ্বাস দেওয়া উচিত যে, কোনো সহকর্মীর দ্বারা খারাপ আচরণের শিকার হলে তাকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।
হয়রানি ও সহিংসতামুক্ত কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে নারীদের কণ্ঠস্বরও শোনা যায়। ভবিষ্যতের নেতা হওয়ার জন্য নারীদের তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসা উচিত এবং প্রয়োজনে তাদের বারবার বলা উচিত নিজেদের কথাগুলো। গবেষণায় দেখা গেছে, ভিন্নধর্মী মত যে কোনো আলোচনার টেবিলে নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করে আর এই নতুন দৃষ্টিকোণগুলো যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক।
দেশে করপোরেট সেক্টরসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ-সমতা নীতি নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি ছাড়া কর্মজীবী নারীদের যত্নের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা বিবেচনা নেই। যেহেতু একজন নারী কর্মীর সমস্যা ও চাহিদা ভিন্ন এবং জটিল, সেহেতু তাদের নীতি, অবকাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত যত্নের ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীর জন্য আলাদা কক্ষ বা বসার ব্যবস্থা, শিশুর যত্নের ব্যবস্থা, নারীদের জন্য সাধারণ কক্ষ- যাতে তারা কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে। যেসব নারী রাতের শিফটে কাজ করেন, তাদের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করা উচিত।
বাড়তি মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং নমনীয় কর্মঘণ্টাও চালু করা যেতে পারে, যাতে নতুন মায়েদের বাড়ি ও কর্মস্থলে তাদের দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কাজ করছেন, তাদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি মায়ের জন্য যেমন সহায়ক, তেমনি নতুন বাবার জন্যও।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে পুনরায় যোগদান কর্মসূচি প্রবর্তন করতে হবে। যেসব নারী বিয়ের পরে বা সন্তান ধারণের পরে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অথবা কর্মক্ষেত্রের সমস্যা ও হতাশাজনিত কারণে কাজ ছেড়ে দেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে তাদের করপোরেট জীবনে ফিরে আসায় উৎসাহিত করতে হবে।
যদি কোনো কর্মচারী সুষ্ঠভাবে কাজ সম্পন্ন করে থাকেন, তিনি অবশ্যই তার প্রাপ্য পাবেন এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হবেন না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই তরুণ কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করতে হবে, যাতে তারা আরও ভালো ব্যবস্থাপক হয়ে উঠতে পারেন এবং ভবিষ্যতে ভালো নেতৃত্ব দিতে পারেন। নারী হওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে তারা যাতে বঞ্চিত না হন। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নারীর সংখ্যা খুবই কম; তাই নারীবান্ধব কাজের পরিবেশ তৈরির জন্য কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
এ দেশের জনগণের প্রায় অর্ধেক নারী, যাদের বেশিরভাগই গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকছেন। এমনকি যারা কর্মশক্তিতে যোগদান করেছেন, তারাও ক্রমাগত কর্মসংস্থানে অসমতার সম্মুখীন হচ্ছেন, পারিবারিক সহিংসতা এবং শারীরিক বা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অতএব, প্রবাদপ্রতিম গ্লাস সিলিং ভাঙা থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে। লিঙ্গ বৈষম্য শুধু নারীর জীবনেই নয়, সমগ্র জাতির কল্যাণকেও ব্যাহত করে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাষায়-‘লিঙ্গ বৈষম্য একটি সুদূরপ্রসারী সামাজিক বৈকল্য, শুধু নারীদের বিশেষ বঞ্চনা নয়।’
অতএব, সময় এসেছে আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য গ্লাস সিলিং ভেঙে দিয়ে অসমতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানোর। আমাদের এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করা উচিত, যেখানে নারীরা তাদের কাজের জন্য উৎসাহিত, সম্মানিত ও প্রশংসিত হয়। এমন সংস্কৃতি যেখানে সমান অধিকার, দায়িত্ব, সুযোগ, লিঙ্গনীতি নির্বিশেষে এবং এমন সংস্কৃতি যেখানে সবাই সমানভাবে স্বীকৃত, সম্মানিত ও মূল্যবান।
শানজানা ইয়াসীন খান : ব্যারিস্টার এট ল, অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট