![কেন এত নৃশংসতা?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/08/27/image-458145-1630011173.jpg)
যে কোনো নৃশংস ঘটনাই মনকে ব্যথিত করে। আর সেটি যদি হয় হত্যাকাণ্ড, তাহলে তো আতঙ্কিতও হতে হয়।
হত্যাকাণ্ড ঘৃণার্হ, একটি হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে শতজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েও সেই মৃত্যুর দায় শোধ হয় না। তাই মানসিকভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক প্রত্যেকেই কায়মনোবাক্যে চান, এ পৃথিবীতে যেন আর একটিও অস্বাভাবিক মৃত্যু না ঘটে, কেউ যেন খুন না হয়।
পরকীয়া, অসহিষ্ণুতা, ক্ষোভ, মাদক সেবন, সম্পত্তিসংক্রান্ত বিরোধ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে মানুষ হিংস্র ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে।
এই তো, গত ২৯ মে রাজধানীর কড়াইল এলাকায় স্ত্রীর হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এক অটোরিকশা চালক। হত্যার পর তার দেহ ছয় টুকরা করে মহাখালীর আমতলী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড ও বনানী লেকে ফেলে দেওয়া হয়। গ্রেফতারের পর স্ত্রী জানায়-‘স্বামী তার দেখভাল করত না, তার উপার্জনের টাকা নিয়ে নিত।’ আর সেই ক্ষোভ থেকে স্বামীকে হত্যার পর মৃতদেহ টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়।
গত মার্চে একইভাবে গাজীপুরে জুয়েল আহমেদ স্ত্রীকে হত্যার পর লাশ সাত টুকরা করে। গ্রেফতারের পর সে পুলিশকে জানায়, পারিবারিক কলহে অতিষ্ঠ হয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার নাওতলা এলাকায় চা দোকানদার নাসির উল্লাহকে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়।
পারিবারিক কলহ ও সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে নৃশংস এ ঘটনাগুলো ঘটছে। কেন মানুষের এ নৃশংস আচরণ? আমাদের সমাজ তথা সমগ্র বিশ্বই একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মানুষ, সে যে বয়সেরই হোক, বড় বেশি অস্থির হয়ে উঠছে। আমাদের মধ্য থেকে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা উঠে যাচ্ছে। ত্যাগে নয়, ভোগেই সবাই তৃপ্তি ও স্বস্তি খুঁজে ফিরছে।
মানুষ অবৈধ ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে, পঙ্কিলতা ও পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি অনুমোদন করে না বিধায় এসব প্রকাশ্যে আনতে পারে না। তাই আলো-আঁধারির এ সম্পর্কগুলো যখন একটু একটু করে জানাজানির পর্যায়ে আসে তখন সংশ্লিষ্টরা এগুলোকে ধামাচাপা দিতে আরও ভয়ংকর ও নৃশংস অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশে নৃশংসতা বৃদ্ধির এটি অন্যতম একটি কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করছেন।
অবৈধ ভালোবাসা ও লোভের বশবর্তী হয়ে অনেকে স্বামী/স্ত্রীকে ত্যাগ করে অথবা খুন করে পছন্দের জনকে নিয়ে ঘর বাঁধছে, কিন্তু মোহভঙ্গ শেষে অশান্তির অতলেই তলিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব ভালোবাসার শেষ পরিণতি সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে, তাহলে অন্তত একজনও যদি সঠিক পথে ফিরে আসে, তবে সেটিই বা কম কিসের।
মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয় হলে অসহিষ্ণু ও হিংস্র হয়ে পড়ে। ফলে যা খুশি তাই করে বসে। এ কারণে খুনের এ নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটছে এবং লাশ টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে খুনি হয়তো মনে করছে, কেউ তাকে আর ধরতে পারবে না।
হতাশা থেকে অনেকেই মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে খুনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। হতাশাগ্রস্ত যখন কেউ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ খুঁজে পায় না, তখন হয়তো আত্মহত্যা করে এবং তার মৃত্যুতে যারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, আশ্রয়হীন ও উপায়হীন হয়ে পড়তে পারে তাদেরও খুন করে। আর তাই প্রায়ই দেখা যায় অবুঝ শিশু-সন্তানদের হত্যা করে হতাশাগ্রস্ত মা-বাবা নিজে আত্মহত্যা করছে। এসব বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারও মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিলেই তার প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনতে হবে।
সমাজে অপরাধমূলক কাজের মাত্রা ও ধরন বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে মাদক সেবনের বিষয়টি আলোচনায় আসছে। মাদক গ্রহণে মানুষের মস্তিষ্কের কিছু কোষের কার্যকারিতা কমে যায়, এতে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেতে থাকে। ফলে তারা ধীরে ধীরে অনেক ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। তাই মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।
বেকারত্ব সমাজে নানা সমস্যা তৈরি করে থাকে। মনে রাখতে হবে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। তাই কর্মে নিয়োগ এবং স্বকর্ম সংস্থানের সুযোগ ও ক্ষেত্র বৃদ্ধির আরও উদ্যোগ নিতে হবে। ‘হতাশার কাফন জড়ানো জীবন্ত লাশ’গুলোকে কর্মচঞ্চল মানুষে পরিণত করতে হবে।
খুনের লাগাম টেনে ধরতে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশসহ বহু দেশেই মানুষ হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে যেহেতু শুধু আইন প্রয়োগ করেই হত্যাকাণ্ড কমানো বা বন্ধ করা যাচ্ছে না; তাই পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারখানা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা আরও শানিত করতে হবে। মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি, মনুষ্যত্ববোধ, সৎচিন্তা, সৎকাজের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার সিলেবাসে মানবিকতা, জীবনের গুরুত্ব ও দায়-দায়িত্ব, সদ গুণাবলির প্রয়োজনীয়তা এবং এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে আমাদের জীবনে পরকীয়া, বিবাহপূর্ব সম্পর্ক, যৌনতা, অশ্লীলতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, হিংসা ইত্যাদি খুব সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। বিভিন্ন নাটক, সিনেমা, গল্প-উপন্যাসে বিষয়গুলো খুব সাধারণভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তাই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে স্বল্প ধারণাসম্পন্ন মানুষ এসব দ্বারা আকৃষ্ট তো হচ্ছেই, এমনকি মনে করছে এতে কোনো পাপ নেই। তাই তারা ওই বিষয়গুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়নে উৎসাহিত হচ্ছে। আর তখনই ঘটে যাচ্ছে চরম ঘৃণিত ও নৃশংসতম কার্যক্রমগুলো। তাই দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেলের সিনেমা-নাটক অথবা কোনো ধারাবাহিক আপত্তিকর প্রতীয়মান হলে তা বাদ দিতে হবে।
যে বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে কু-প্রবৃত্তি, হিংসা, আক্রোশ, কপটতা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং চরিত্রগঠনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে, তা সরাসরি বর্জন করতে হবে। আমাদের পারিবারিক এবং সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধকে যে বিষয়গুলো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ‘খোলা দুয়ার’ নীতির যতটুকু আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ; ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করতে হবে। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ ও সহজলভ্যতার কারণে মানবজীবনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়গুলোকে শুধু নিয়ন্ত্রণই নয়, বাতিল করার দরকার হলে তা-ই করতে হবে।
খুন করে ধরা পড়েনি এমন লোকের সংখ্যা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই নগণ্য। অর্থাৎ খুন করলে ধরা পড়তেই হবে, দুদিন আগে বা দুদিন পরে। খুন বা অপরাধ যে-ই করুক বা যে কায়দাতেই করুক বা যত চালাকির আশ্রয় নিয়েই করুক না কেন-কেউ ছাড় পায়নি এবং ভবিষ্যতেও পাবে না। পৃথিবীতে যত ধরনের পাপকর্ম ও অপরাধ আছে তার মধ্যে খুন অর্থাৎ মানুষ হত্যা নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম অপরাধ। যে কোনো অপরাধই পাপ, আর খুন বা নৃশংসভাবে খুনের শাস্তি ইহকাল ও পরকালে যে কত কঠিন, তা মনে করিয়ে দিয়ে সবাইকে সবসময় সঠিক পথে চলার আহ্বান জানিয়ে যেতে হবে।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী
snagari2012@gmail.com