শতফুল ফুটতে দাও
দুর্নীতি, সুশাসন ও খাদ্য নিরাপত্তা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের উন্নয়নকে কেন্দ্র করে যেসব বয়ান উচ্চারণ করা হয়, সেসব ক্ষেত্রেও আমরা তীব্র মেরুকরণ লক্ষ করি। একদল বলছে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল হয়ে গেছে। এ রোল মডেলে প্রধানত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে নিয়ামক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির হিসাবনিকাশে বেশ গোঁজামিল রয়েছে বলেই অনেকে দাবি করেন। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে বেশকটি মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। নিন্দুকরা এ প্রজেক্টগুলোকে মেগা দুর্নীতি হিসাবে উল্লেখ করেছে। করবে নাই বা কেন? বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোয় বালিশকাণ্ড ও পর্দাকাণ্ডে জনগণের অর্থের অপচয় যেভাবে হচ্ছে, এর ফলে এসব প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলোদয় সময়ের বিচারে অনেক দূরবর্তী হয়ে পড়েছে।
জিডিপি হিসাব করতে গিয়ে সরকারি ব্যয়কে অন্যতম অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় জিডিপির হিসাবের মধ্যে ঢুকে পড়ে জিডিপিকে অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত করে ফেলে। বাংলাদেশের প্রতিটি মেগা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢালা হচ্ছে। এ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে একই ধরনের একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল।
শুধু দুর্নীতির কারণে জনগণ এক অর্থে লুণ্ঠনের কবলে পড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো মনে করে, এসব দুর্নীতি এবং অপচয় বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশ অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত। যেসব দুর্নীতিবাজ এভাবে দুর্নীতি করে তাদের পকেট ভারী করেছে তারা এ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে না। বিনিয়োগ করতে না পারার বড় কারণ হলো তারা এ অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে সক্ষম নয়।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশন আন্তরিকভাবে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে পারে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তাদের হতে হয় সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তাদের একটি অংশ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ আছে। এনবিআর বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আন্তরিক ও ন্যায়নিষ্ঠ হলে করের জালকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করতে পারতেন।
যদিও করজালের সম্প্রসারণ জাতীয় স্বার্থের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা সত্ত্বেও এ কাজটি আন্তরিকভাবে কেউ করছেন কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতেই পারে। শেষমেশ সমাধান হিসাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে বাকি অর্থ সরকার নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হয়। সরকারের এ নীতি সম্পর্কে অনেক অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন-সৎ করদাতারা কর দিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে চালু রাখার জন্য সরকার ব্যাংকব্যবস্থা এবং বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমেও সরকার ঋণ নিচ্ছে। প্রতিবছর বাজেটে একটি খাত থাকে যেটি ঋণের দায় হিসাবে ব্যয় প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ এখনো বিগত শতাব্দীর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মতো ঋণ সংকটে পড়েনি।
এর বড় কারণ হলো, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পাঠানো রেমিট্যান্স। পোশাক রপ্তানি করেও বাংলাদেশ প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ভরে উঠছে। কোভিড মহামারি দেখা দেওয়ার ফলে রেমিটেন্সের আকার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশ কী করবে, সে সম্পর্কে এখন থেকেই একটি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে আর্জেন্টিনা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে খুবই সচ্ছল একটি রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনার উন্নয়ন টেকসই হতে পারেনি।
আজকের আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিকভাবে পেছনের কাতারে চলে গেছে। বাংলাদেশ যাতে আর্জেন্টিনার মতো সংকটাপন্ন না হয়ে পড়ে, তার জন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? এটা মিলিয়ন ডলারের একটি প্রশ্ন। গ্রামে কৃষকরা একটি কথা বলে, তা হলো ‘বেড়া যদি খেত খেয়ে ফেলে তাহলে কৃষক কীভাবে তার ফসল রক্ষা করবে?’ বাংলাদেশের প্রশাসনে বিভিন্ন স্তরে এ বেড়া সিন্ড্রোম বিস্তার লাভ করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ বাজেটে উল্লিখিত করের বাইরে নানা ক্ষমতা গোষ্ঠীকে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। এ চাঁদাও এক ধরনের কর। তবে এ করের অর্থ রাষ্ট্রের খাজাঞ্চিখানায় জমা হয় না। এ অর্থ স্তূপীকৃত হয় রং-বেরঙের মাস্তানদের সিন্দুকে। যদি এ অর্থ সরাসরি সরকারের হাতে যেত এবং এর নয়ছয় ঘটিয়ে যদি কিছু করা না হতো, তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অনেক কিছুই করা সম্ভব হতো। আসলে সরকার প্রদত্ত কর জিডিপি অনুপাত সঠিকভাবে করের প্রতিফলন ঘটায় না। মাস্তান গোষ্ঠীর হাতে যে অর্থ জমা হয়, সেটাই আমাদের কর জিডিপি অনুপাতকে নিু স্তরে রেখে দিয়েছে।
একটা সময় ছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পাবলিক ফিন্যান্স পড়াতে গিয়ে ট্যাক্সেবল ক্যাপাসিটি সম্পর্কে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হতো। জাতীয় আয়ের কত অংশ সরকার জনগণের কাছ থেকে করের আকারে তুলে নিতে পারে সেটাই ট্যাক্সেবল ক্যাপাসিটি পড়াতে গিয়ে আলোচনা করা হতো। আজকাল পাবলিক ফিন্যান্সের এ অধ্যায়টির কথা আমরা ভুলে গেছি। যদি সরকার ট্যাক্সেবল ক্যাপাসিটির তুলনায় কম কর আদায় করে, তাহলে সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবার ট্যাক্সেবল ক্যাপাসিটির চেয়ে বেশি কর আদায় করতে চাইলে জনগণ উৎপাদনমূলক কাজে প্রেরণা পাবে না।
ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া সরকারের দৃশ্যমান হাত যদি কাম্য মাত্রায় সচল না থাকে, তাহলে বাজারে অদৃশ্য হাতে অনেক ধরনের বাজার বিকৃতি ঘটবে এবং নানা ধরনের বাহ্য প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের দৃশ্যমান হাত এবং বাজারের অদৃশ্য হাতের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন।
অবশ্য অর্থনীতির এ বিষয়টি বিতর্কমুক্ত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিগ্যান কর ছাঁট করার (Tax Cut) নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল কর হ্রাস করলে অর্থনীতি আরও বেগবান হয়ে উঠবে। এ নীতির ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে একসময় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াস বাস্তবায়িত হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে সরকারি মহলের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তারা হরহামেশা দাবি করেন বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হতো তার তুলনায় এখন প্রায় ৩ গুণ খাদ্য উৎপাদিত হয়। অথচ আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি, বরং হ্রাস পেয়েছে। নগরায়ণ, সড়ক নির্মাণ এবং কলকারখানা স্থাপনের জন্য অনেক জমি কৃষির বাইরে অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো এমন একটি জনবহুল দেশে যদি আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে, তাহলে আগামী দিনে এ দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপদের মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশে যে জমি আছে সে জমি আর বড়ানো সম্ভব নয়। তবে একটি কৃষিবর্ষে চাষের নিবিড়তা ৩ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। মূলত সেচের মাধ্যমে বাংলাদেশে চাষের নিবিড়তা বাড়ানো হয়েছে এবং বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। পানি ব্যবস্থাপনা সঠিক না হওয়ার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। উপকূলের ফোল্ডারগুলো সংস্কার ও উন্নয়ন না করার ফলে সেগুলো সাইক্লোনের সময় ভেঙে পড়ছে।
ফোল্ডারগুলো ভেঙে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের লোনা পানি কৃষিজমিকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধ করে ফেলছে। সমুদ্রের লোনা পানির প্রভাবে কৃষিকাজ চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ কারণেও চাষের জমি হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনীতির একটি সাধারণ সূত্র হলো Law of diminishing marginal return. বাংলা ভাষায় একে বলা হয় ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদনবিধি। জমি স্থির রেখে উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ বৃদ্ধি করলে প্রাথমিকভাবে প্রান্তিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলেও একটি পর্যায়ে এসে প্রান্তিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে শুরু করে।
এ রকম অবস্থায় কৃষিকাজ টেকসই হতে পারে না। এ সমস্যার সমাধান হলো উন্নততর প্রযুক্তি। যেমন হাইব্রিড বীজ, উচ্চফলনশীল বীজ, ফসলের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে কাম্য পরিমাণ পানি সেচ এবং বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার। এগুলো যদি করা সম্ভব হয়, তাহলে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির নেতিবাচক প্রভাব থেকে কৃষিকে রক্ষা করা সম্ভব। তবে এ সম্ভাবনা বছরের পর বছর অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বলতে ধান ও গমকে বোঝানো হয়। এ দুই ধরনের ফসলের বার্ষিক উৎপাদনই হলো দেশজ খাদ্যশস্য উৎপাদন।
কিন্তু বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির তথ্য বলে দেয় বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হয়নি। ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছরেই বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। আমদানি নির্ভরশীলতা পরিমাপ করার উপায় হলো মোট আমদানিকে মোট উৎপাদন দিয়ে ভাগ করা। আলোচ্য সময়ে সর্বোচ্চ আমদানির হার ছিল ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ২৬.১৪ শতাংশ। সর্বনিু আমদানির হার ছিল ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে। সে বছরের আমদানির হার ছিল ৫.৩৩ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে ১ ডিজিটের আমদানি হার সীমাবদ্ধ ছিল ২০১৩-১৪, ২০১২-১৩ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে। একটি দৈনিক এ ব্যাপারে প্রধান শিরোনাম করেছে-‘খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার মিথ দুর্বল হয়ে পড়েছে।’ পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ‘খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। সর্বশেষ গত অর্থবছরেও ৬৬ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। বরাবরই গমের ঘাটতি থাকলেও চালের ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। চালের এ ঘাটতি সীমিত হলেও বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।’
আমরা জানি খাদ্যশস্যের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে সরকার ও ব্যক্তি খাত চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোর কাছ থেকে কখনো কখনো সন্তোষজনক সাড়া পায়নি। ঘন জনবসতি দেশ বাংলাদেশ যদি কোনো কারণে বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দুর্ভিক্ষের অবস্থা দেখা দিতে পারে। এ কারণে আমাদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি রাষ্ট্রের সামরিক নিরাপত্তার তুলনায় কোনোক্রমেই সামান্য নয়।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে আত্মপোষণশীল কৃষিব্যবস্থা থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আত্মপোষণশীল কৃষিব্যবস্থায় কৃষকের মূল লক্ষ্য থাকে নিজ খাদ্য চাহিদা পূরণ করা। দরিদ্র কৃষকরা ক্ষুদ্র একখণ্ড জমিতে শ্রম এবং নানা রকম যত্ন-আত্তি করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করে। এ ধরনের কৃষিতে মুনাফার তুলনায় নিজের জীবন বাঁচানোই মূল লক্ষ্য। বাণিজ্যিক কৃষিতে বাজারের জন্য উৎপাদন করা হয়।
আমাদের দেশে কৃষিব্যবস্থা যেভাবে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, তাতে কৃষকরা তাদের ভরণপোষণের চাহিদা মিটিয়ে বাকি অংশ বাজারজাত করে। এ রকম কৃষকের জন্য মুনাফা করাটাই প্রধান লক্ষ্য। বাণিজ্যিক কৃষিতে উৎপাদনের উপকরণ বাজার থেকে কেনা হয় অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। বাণিজ্যিক কৃষিতে ভাড়া করা শ্রমই বেশি ব্যবহার করা হয়। এ কারণে কৃষককে আত্মমগ্নভাবে উৎপাদন ব্যয়ের ক্যালকুলাস করতে হয়। খাদ্যশস্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চাতালের ব্যবসা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে।
এছাড়া আছে ব্যাপারী ও ফড়িয়ার মতো মধ্যস্বত্বভোগী। চাতাল ব্যবসা, ফড়িয়া ইত্যাদি মধ্যস্বত্বভোগীর জায়গাটি যদি কৃষক নিজ আয়ত্তে আনতে পারত তাহলে তারা লাভবান হতো। উৎপাদন কার্যক্রমে উৎসাহ পেত। দুর্ভাগ্যবশত কৃষকের কাছে পুঁজি না থাকার কারণে এবং কৃষক সংগঠিত হতে না পারার ফলে প্রতিবছরই কৃষকের দুর্দশার কথা শুনতে হয়। এজন্য প্রয়োজন ঊর্ধ্বমুখী কৃষক সমবায়। ফসল সংরক্ষণের গুদাম, ফসল পরিবহণ এবং শেষ পর্যন্ত ক্রেতার কাছে কৃষকের পৌঁছে যাওয়াই হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী কৃষক সমবায়।
বাংলাদেশের কৃষকদের একাংশ উচ্চমূল্য কৃষিতে ঝুঁকে পড়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মাছের খামার ও দুধের খামার গড়ে উঠছে। গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসার উদ্ভব ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি যেমন বাউকুল, বড় জাতের কুল, আম, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশ থেকে আনা ড্রাগন ফলেরও চাষ হচ্ছে। তরিতরকারির মধ্যে ব্রুকলি, ক্যাপসিকাম ও অন্যান্য সবজিরও চাষ হচ্ছে।
ক্ষুদ্র আকারে এসব ফসল বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে জমির ব্যবহার ধীরে ধীরে মুনাফামুখী হচ্ছে। ফলে জমির ব্যবহার আত্মপোষণশীল কৃষির জন্য হবে, নাকি বাণিজ্য ও বাজারের জন্য হবে-এ দুয়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তবে কোনো দেশই খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে জীবন ও বাঁচা-মরার বিষয়টি।
এজন্য আমাদের কৃষিনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত একদিকে খাদ্যশস্যে স্বয়ম্ভর হওয়ার চেষ্টা করা, অন্যদিকে বাণিজ্যিক কৃষিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। কৃষক খাদ্যশস্যের সঠিক মূল্য পায় না বলে অন্যান্য লাভজনক কৃষির দিকে ঝুঁকছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে সঠিক টার্গেট বেছে নিয়ে সঠিকভাবে ভর্তুকি দিতে পারলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে মন্থরতার সমস্যা জয় করার সম্ভাবনা থাকে। মোদ্দা কথা, কৃষির ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন কখনই অর্জন করা সম্ভব হবে না, যদি সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়। এটি করা সম্ভব না হলে কৃষি উন্নয়ন টেকসই হবে না। শিল্পোন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ শ্রমিকদের মজুরিপণ্য কৃষকরাই উৎপাদন করে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ