সিনিয়র সিটিজেন বোঝা নয়, হতে পারেন সম্পদ
এম এ খালেক
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিনিয়র সিটিজেনদের সমন্বয়ে গঠিত ভ্রমণবিষয়ক অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা ‘কাছে এসো’র উদ্যোগে আমরা প্রায়ই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করি। আমাদের এ সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্ব স্ব কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণের পর নিজেদের সচল রাখার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা। কর্মজীবনে ব্যস্ত থাকার কারণে চাইলেই হুট করে কোথাও বেড়ানোর জন্য বেরিয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। সেই অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা মেটানোর উদ্দেশ্যেই আমাদের এ উদ্যোগ। বেশ কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেন আমাদের এ উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। গত ১৫ জানুয়ারি আমরা কয়েকজন মিলে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ভ্রমণে গিয়েছিলাম। রামগড়ে এক রাত থাকার পর আমরা চলে আসি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সাহাপুরে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সোলায়মানের সমন্বিত কৃষি প্রকল্প সোয়াস এগ্রো প্রকল্প দেখার জন্য। আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাই প্রকল্পে গিয়ে আমরা সহজেই মেজর সোলায়মানকে (অব.) পেয়ে যাই। মেজর সোলায়মানের (অব.) উদ্যোগে প্রায় ৭০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা এ সমন্বিত কৃষি খামারটি ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা দেশের অন্যতম সফল কৃষি খামার। এতে ৩০ জনের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া অনেকেই পরোক্ষভাবে এ প্রকল্পের ওপর নির্ভর করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ ছাড়াও এখানে রয়েছে ২২টি বড় আকারের পুকুর, যাতে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ হচ্ছে। মেজর সোলায়মানের (অব.) এ কৃষি খামার দেখলে যে কোনো মানুষের চোখ জুড়িয়ে যাবে। খামারের উদ্যোক্তা মেজর সোলায়মান (অব.) জানালেন, ছোটবেলা থেকেই এ ধরনের একটি খামার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। এক সময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন। ফলে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী হন। তিনি বলেন, এ খামার থেকে প্রতি বছর যে আয় হয়, তা দিয়ে খুব ভালোভাবেই সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অনুষ্ঠানিকভাবে কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেই মানুষের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় না। অবসর গ্রহণের পরও মানুষ চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। এভাবে অবসরোত্তর ব্যক্তি উদ্যোগে খামার বা অন্য কোনো আয়বর্ধক প্রকল্প গড়ে তোলা হলে একজন মানুষের অবসর সময় খুব ভালোভাবে কাটতে পারে। এমনকি এ থেকে কিছু বাড়তি আয়ও হতে পারে।
মেজর সোলায়মানের (অব.) কথাগুলো বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আয়বর্ধক বিনোদনমূলক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা এখন ৫৯ বছর। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও অনেকেই ১০/১৫ বছর সুস্থভাবে বেঁচে থাকেন। কিন্তু এ দীর্ঘ অবসর জীবনে তাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তারা পরিবারে এক ধরনের ‘বোঝা’ হিসাবেই অবস্থান করেন। উল্লেখ্য, কর্মহীন মানুষ সমাজে এবং সংসারের জন্য কিছুটা হলেও ‘দায়’ হিসাবেই বিবেচিত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে কম করে হলেও প্রায় ২ কোটি মানুষ আছেন, যাদের বয়স ৬০ বছর বা তারও বেশি। এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী কার্যত কোনো ধরনের আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত নন। অথচ পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এদের আয়বর্ধক কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। একজন মানুষ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর নিজেকে সংসারের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। ফলে তারা খুব অল্পতেই বুড়িয়ে যান, স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তারা মনে করেন, আমাদের আর সমাজের জন্য কোনো প্রয়োজন নেই। নিজ সন্তানরাও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যকে অনেকটা অবহেলার চোখে দেখে থাকেন। যদিও এটি কোনোভাবেই উচিত নয়, কিন্তু এটাই সমাজের বাস্তবতা। এ সময় তাদের মনে শুধু মৃত্যু চিন্তাই ঘুরপাক খায়। অথচ তাদের যদি বিনোদনমূলক আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত করা যেত, তাহলে তাদের অবসর সময়টাও ভালো কাটত। আর পরিবারের জন্য কিছু বাড়তি আয় করতে পারতেন। সবাইকে মেজর সোলায়মানের (অব.) মতো বিশাল প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে তা নয়, ছোট ছোট উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এজন্য সরকারিভাবে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যারা প্রবীণ জনগোষ্ঠী, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো কাজে দক্ষতা রয়েছে। তাদের এ দক্ষতা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষ দপ্তর খোলা যেতে পারে। এ দপ্তরের প্রধান কাজ হবে দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের তালিকা এবং পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তৈরি করা। এরপর যারা কর্মক্ষম আছেন, তাদের পছন্দনীয় ট্রেডে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণের পর তাদের জন্য ছোট ছোট প্রকল্পের ডিজাইন তৈরি করে তুলনামূলক স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তিরা ধর্মীয় এবং নৈতিক কারণে সাধারণত ঋণখেলাপি হবেন না। কাজেই তাদের নির্বিঘ্নে ব্যাংক ঋণ দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ছোট ছোট গ্রুপ সৃষ্টি করেও তাদের অর্থায়ন করা যেতে পারে। যারা গ্রামাঞ্চলে বাস করেন তাদের জন্য প্রকল্প নির্মাণের জমির অভাব হবে না। নিজস্ব জমি না থাকলে অন্যের জমি লিজ নিয়ে খামার গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ছাড়া যারা শহরে বাস করেন, তারা বাড়ির ছাদে বাগান করতে পারেন। এমনকি পাখি পালন বা সবজি চাষ করতে পারেন। যাদের বাড়িতে খোলা জায়গা নেই, তারা ইচ্ছা করলে বাসার বারান্দাতেও ছোট ছোট খামার তৈরি করতে পারেন। এখানে ইচ্ছাটাই প্রধান। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। কেউ যদি একটি ছোট পাখির খামার গড়ে তুলতে চান, তাহলে তিনি তার ঘরের ভেতরও তা করতে পারেন। বাড়ির একজন প্রবীণ সদস্য যদি এ ধরনের একটি খামার গড়ে তোলেন, তাহলে সেই বাড়ির ছোট সদস্যরাও তাতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। একটি সাধারণ ছোট ফলের বাগান করা হলে সংশ্লিষ্ট পরিবারের প্রোটিনের চাহিদা সহজেই পূরণ হতে পারে।
বাংলাদেশের মাটি উর্বর এবং আবহাওয়া চাষোপযোগী। এখানে মাটিতে বীজ বপন করলেই তা থেকে চারা গজায় এবং ফল ধরে। কিন্তু আমরা সেই মাটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু অতীতে কৃষি খাতকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। স্বাধীনতার পর শিল্পায়নের ওপর যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কৃষি ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে কৃষির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। কৃষি এবং শিল্পের মধ্যে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নেই বরং এ দুটি খাত পরস্পর পরিপূরক। আমরা এ চিরন্তন সত্যটি প্রায়ই উপলব্ধি করতে ভুলে যাই। বাংলাদেশে অবশ্যই বৃহৎ শিল্প-কারখানা স্থাপনের প্রয়োজন আছে। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং সুষমকরণের জন্যই এটি প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে কৃষিকে অবহেলা করে বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন সম্ভব নয়। বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রচলিত শিল্পায়নের পাশাপাশি কৃষিকে শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ আমাদের এমন সব শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে, যার কাঁচামাল আসবে কৃষি খাত থেকে। এটি করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাবে। কৃষি খাতের এ সম্ভাবনাকে সিনিয়র সিটিজেনদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যারা প্রবীণ, তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের পর ব্যাংক থেকে নামমাত্র সুদে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হলে তারা স্ব স্ব যোগ্যতা অনুযায়ী কৃষির উন্নয়নে কাজ করতে পারেন। পারিবারিক পর্যায়ে ছোট ছোট খামার গড়ে তোলা যেতে পারে। এমনকি শহরের বাসাবাড়িতেও কবুতরের খামার, ঘুঘু পাখির খামার, কোয়েল পাখির খামার গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা চলছে সনাতনী পদ্ধতিতে। বংশপরম্পরায় কৃষক তার অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে কৃষি কাজ করছে। ফলে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা কম। প্রতিটি কাজে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হলে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কৃষকের জন্য খাতভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও কর্মক্ষম ব্যক্তিদের সমন্বিত কৃষি খামারে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়েছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই কর্মক্ষম। কাজেই এদের অর্থনীতির মূল স্রোতের বাইরে না রেখে কীভাবে তাদের অভিজ্ঞতা এবং কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা দেশের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনকালে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা এ ধরনের কিছু খামার প্রত্যক্ষ করেছি। এসব খামারের উদ্যোক্তা সাধারণত প্রবীণ ব্যক্তিরাই। কিন্তু তারা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না বা কোনো আনুষ্ঠানিক সূত্র থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থাও নেই তাদের জন্য। ফলে তারা চাইলেও তাদের প্রকল্পের পরিধি বাড়াতে পারছেন না। প্রতিটি ভালো কাজের জন্য পূর্বপরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু দেশের বিপুলসংখ্যক প্রবীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের কোনো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা নেই। নারীদের অর্থনীতির মূলধারা থেকে বাইরে রেখে যেমন সঠিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হলে কোনোভাবেই সত্যিকার সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের মানবসম্পদ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। মানুষ সৃজনশীল শক্তির অধিকারীও বটে। তারা সুযোগ পেলে যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারেন। তাই তাদের সেই সৃজনশীল কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সিনিয়র সিটিজেন সমাজ বা পরিবারের জন্য বোঝা নয়। তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারাটাই আমাদের ব্যর্থতা। যেহেতু সিনিয়র সিটিজেনদের কর্মকুশলতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না, তাই তারা সমাজ এবং পরিবারে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ অবস্থান অবসানে জরুরি ভিত্তিতে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক